বাবার স্মৃতি - ৪
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ লোকমান ০৫ এপ্রিল, ২০১৪, ১০:৫৮:২৫ সকাল
বাবাকে শৈশবে যতখানি ভয় পেয়ে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম বড় হয়ে তার চেয়েও বেশী চেষ্টা করতাম কাছে থাকার। তিনিও আমাকে যথেষ্ট সময় দিতেন। তাঁর সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল আমার। বাবা যথেষ্ট আল্লাহ ভীরু ছিলেন, কিন্তু শৈশবে ইসলামের সঠিক শিক্ষা না পাওয়ার কারণে কিছুটা ধর্মীয় কুসংস্কর লালন করতেন। তাঁর সাথে ভালো সম্পর্ক এবং আলাপ আলোচনার সুযোগ কাজে লাগিয়ে ওসব কুসংস্কারের মূলোৎপাটনের চেষ্টা করতাম। এতে অনেকখানি সফল হয়েছি, আলহামদু লিল্লাহ্।
তাঁর জন্ম চট্টগ্রামের উত্তর অংশে। বাবার শৈশবে অত্র এলাকায় সুন্নী(!) মুসলমানদের নিকট ধর্ম বলতে যা বোঝানো হতো- মাইজভান্ডারীর ওরসের নামে গরু, মহিষ জবেহ করা, জিকিরের নামে লম্ফঝম্প করা, মুশকিল আসানের জন্য মাজারে ধর্ণা দেয়া, কারবালার পুঁথি পড়া, শরীয়তি মারেফতি গান শুনে ছাওয়াব অর্জন করা সহ নানা কিসিমের ধর্মীয় অনাচার। ধর্মের নামে এসব ধর্মীয় কুসংস্কার মানুষের মস্তিস্কে গেঁড়ে বসার ফলে বর্তমান যুগেও তা লালন করছেন অসংখ্য মানুষ। আল্লাহ আমাকে হেদায়াত না করলে আমি নিজেও হয়ত জড়িয়ে থাকতাম ওসবের মধ্যে। শৈশবে বাবার হাত ধরে অনেক ঘুরতে হয়েছিল মাজারে মাজারে। আমার পরিকল্পনা ছিল যে কোন মূল্যেই হোক, বাবাকে ফেরাতে হবে এসব কুসংস্কার থেকে। আমার এটাও জানা ছিল যে, কারো মনের মধ্যে গেঁথে যাওয়া বিষয় পরিবর্তনা করা খুব সহজ কাজ নয়। মানুষ অনেক কিছুই ত্যাগ করতে পারে কিন্তু বাপদাদার রসম রেওয়াজ যা একবার মাথায় ঢুকে গিয়েছে তা বের করা বড়ই কঠিন।
বাবাকে সরাসরি এসবের বিরুদ্ধে কটাক্ষ করে কিছু বললে তিনি ভাববেন, তাঁর ছেলে ওয়াহাবী হয়ে গেছে। ফলে আমার সাথে আড়িও হয়ে যেতে পারে। তাই খুবই কৌশল অবলম্বন করে তাঁকে বুঝাতে লাগলাম। একদিন বাবাকে বললাম, ‘আপনি আমার বাবা আর আমি আপনার সন্তান, আপনি যেমন দুনিয়া এবং আখিরাতে আমার কল্যাণ কামনা করেন আমিও তেমনি আপনার কল্যাণ কামনা করি এবং সাথে সাথে কিছু বাড়তি দায়িত্বও আমার ঘাড়ে চেপেছে। সে বাড়তি দায়িত্বটুকু হলো- কুরআন হাদীসের উপর কিছু লেখাপড়া করার ফলে দ্বীনের কিছু সঠিক তত্ব পেয়েছি, দ্বীন সম্পর্কে আমার জানা বিষয়গুলি যদি আপনাকে না জানাই তাহলে হাশরের ময়দানে আমি আল্লাহর নিকট পাকড়াও হয়ে যেতে পারি। সেজন্যই বিষয়গুলো আপনার সাথে আলোচনা জরুরী, যদি আপনি এটাতে অপমান বোধ না করেন এবং শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।’
বাবা খুবই আগ্রহের সাথে আমার কথা শুনতে রাজী হওয়াতে আমি আমার যোগ্যতানুযায়ী চেষ্টা করেছি তাঁদের সময়ের ধর্মীয় রসম রেওয়াজ এবং ভুলগুলোর উপর সঠিক বিষয়গুলো তুলে ধরতে। কোন বিষয় তাঁর বুঝে না আসলে তিনি প্রশ্ন করে সেটা বুঝে নেয়ার চেষ্টা করতেন। আমার সাথে কথা বলার পর অতিমাত্রায় মাজার প্রীতি এবং সংশ্লিষ্ট অনেক বদ রসম ত্যাগ করেছিলেন তিনি। দেশে থাকা অবস্থায় প্রতি বছর আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেবের তাফসীর মাহফিলে গমন করতেন। সাঈদী সাহেবের বিশাল পান্ডিত্যে তিনি মুগ্ধ হতেন। সাঈদী সাহেবকে বন্দী করে প্রহসনের বিচারের জন্য তিনি সরকারের সমালোচনা করতেন, যদিও বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালবাসার কারণে তাঁর ভোটটি সবসময় নৌকায় পড়তো। তিনি হযরত তৈযব শাহ’র (রহমাহুমুল্লাহ) নিকট ব’য়াত করেছিলেন এবং তাঁর নির্দেশে চট্টগ্রাম ষোল শহরস্থ জামেয়া আহমদিয়া সুন্নীয়া মাদ্রাসায় প্রতিমাসে তার আয় থেকে একটি অংশ দান করতেন। আমরাও সিদ্ধান্ত নিয়েছি তার রেখে যাওয়া যতসামান্য সম্পদ থেকে প্রতি মাসে ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ এবং উক্ত মাদ্রাসায় দান করবো।
আমি প্রবাসে আসার পর আমার স্ত্রীকেও নিয়ে আসার জন্য তিনি বার বার তাগাদা দিতেন। তাঁর দোয়া এবং সহযোগীতার ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমার স্ত্রীকেও আমার সাথে প্রবাসে নিয়ে আসার সুযোগ হয়েছিল। অথচ অনেক মা-বাবা এটি সহযে মেনে নিতে চাননা। এদিক দিয়ে আমার বাবা ছিলেন যথেষ্ট উদার এবং বাস্তববাদী।
আমরা বাবাকে নিয়ে আরব আমিরাতের বিভিন্ন যায়গায় ভ্রমন করার সময় যখনই দেখতেন ইন্ডিয়ান, পাকিস্থানী অথবা ভিন্ন কোন দেশের লোকেরা তাদের নড়বড়ে বৃদ্ধ বাবাকে ধরে ধরে ভ্রমন করাচ্ছেন, তখন সে দৃশ্যটির প্রতি তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। তিনি হয়ত আশা পোষণ করতেন, তিনি এভাবে নড়বড়ে বৃদ্ধ হয়ে গেলে আমরাও তাঁকে এভাবে ধরে ধরে ভ্রমন করাব। অথবা মনে মনে ভাবতেন তিনি এরকম নড়বড়ে হয়ে গেলে তাঁর প্রতি আমরা কেমন আচরণ করব।
বাবার মৃত্যুতে আমরা গভীর শোকাহত তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে তিনি যে থুড়থুড়ে-নড়বড়ে বৃদ্ধ না হয়ে এবং অনেক দিন অসুস্থতায় না ভূগে মাত্র কয়েকটি দিন অসুস্থতার পর মৃত্যুবরণ করেছেন এটি তাঁর প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত বলে আমি মনে করি।
হে আল্লাহ্! আমার বাবা এখন সম্পূর্ণরূপে আপনার জিম্মায়। আমাদের কোন সুযোগ নেই তাকে সামান্য পরিমান সাহায্য করার। আপনি দয়া করে আমার বাবার সমস্ত গোনাহ খাতা এবং ত্রুটি বিচ্যুতি মাফ করে দিন। " রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বা ইয়ানি ছাগিরা" হে প্রভু, আমার পিতা-মাতাকে ভাল রেখ, শান্তিতে আদরে সূখে রেখ, যেভাবে তারা আমাদেরকে রেখেছের আমাদের শৈশবে; কিংবা তারচেয়েও বেশি। -আমীন।।
সমাপ্ত
বিষয়: Contest_father
১৬৪৭ বার পঠিত, ২৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার জন্যও দোয়া রইলো।
আমীন।
ষোল শহরস্থ সুন্নীয়া মাদ্রাসাকে ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতটুকু কাছ দেখেছি তাদেরকে দাম্ভিক ফেরকাবাজ মনে হয়েছে । বেদাতের লালন পালন তো আছেই । প্রতিমাসে দানটা অন্য কোন ভাল প্রতিষ্টানে দেওয়া যাই কিনা দেখতে পারেন ।
রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি ছগিরা ।
ধন্যবাদ।
দোয়া করবেন আল্লাহ যেন আমার আব্বাকে সুখী এবং দীর্ঘজিবী করেন।
আপনার আব্বাকে আল্লাহ দীর্ঘ এবং নেক হায়াত দান করুন।
********************************
সফল একটি লেখা....!!!
বাবার মৃত্যু জীবনের গতি বদলে দিলো
যৌবনের প্রারম্ভেই পরিণত হলাম
জীবন যুদ্ধের নবীন সৈনিক
ঝাপিয়ে পড়লাম কর্ম যজ্ঞের অতল সমুদ্রে
মানিক্য তালাসের প্রানান্তকর চেষ্টায়
বারে বারে ঢেউয়ের আঘাত পেলাম
পিছু ফিরিনি ফেরার পথ ছিল রুদ্ধ,
বাবার মুখখানা বারে বারে মনে পরে
মনে পরে স্নেহময় ভালোবাসার পরশ
আজ বাবা বুকের মধ্যে বাসকরে
আমায় শাসায় আদর করে
বাবার হাতেই প্রথম লিখতে শিখি
তাই প্রতিটি শব্দে বাবার স্পর্শ পাই,
বাবা ছিলেন শতকষ্টের শান্তনা
ছিলেন আমার আদর্শ শিক্ষক
আজ বাবা নেই পৃথিবী শূন্য লাগে
চলার পথ মনে হয় সঙ্গীহীন দুর্গম
শেষ হয়না পথচলা ফেরা হয়না ঘরে
যেখানে বাবার স্মৃতিগুলো-
শুধু আমার জন্য অপেক্ষা করে।
***************************
বাবাকে খুবই মনে পরে....
মন্তব্য করতে লগইন করুন