বাবার স্মৃতি - ২
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ লোকমান ৩১ মার্চ, ২০১৪, ০৬:০৬:১৯ সন্ধ্যা
শাসনের কঠোরতার কারণে বাবাকে শৈশবে জমের মতো ভয় করে যথা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম, খুব বিরক্ত হতাম । কঠোর শাসনের পেছনেও যে বাবার ভালবাসা লুকিয়েছিল তা বুঝে আসতে একটু সময় লেগেছিল বৈকি। মহল্লার দুষ্টু ছেলেদের সাথে মিশে লাঠিম-মার্বেল খেলতে দেখলে শাসন করতেন এই জন্যই, যেন আমিও তাদের অনেকের মতো ধূমপায়ী আর দুষ্ট চরিত্রের হয়ে না যাই। বাজার থেকে সময় মতো ফিরে না এসে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বানরের খেলা, তাবিজ বিক্রেতার লেকচার আর যাদু দেখতে গিয়ে সময় ক্ষেপন করার কারণে বকা দিতেন সময়ের প্রতি গুরুত্ব এবং সময়ের কাজ সময়ে করা শেখানোর জন্য। লেখা পড়ায় ফাঁকি দিতে দেখলে বকা দিতেন ভালো ছাত্র হওয়ার জন্য।
শাসনের কড়াকড়ির মধ্যে ভালোবাসার প্রকাশ বাহ্যিকভাবে করতে না চাইলেও প্রকাশ হয়ে পড়তো তাঁর অজান্তেই। কি এক কারণে একবার খুব বেশী পিটুনি দিয়েছিলেন। পিটুনি খেয়ে আমি রাগ করে ফুফুর বাড়ীতে চলে গিয়েছিলাম। অনেক খোঁজা খুঁজির পর তিনি বিষন্ন মনে আমার ফুফুর বাড়ীতে আসতেছিলেন আমার খোঁজে। বাবাকে দূর থেকে দেখতে পেয়ে ফুফু আমাকে আড়াল করে রাখলেন এবং বাবা ঘরে এসে আমার কথা জিজ্ঞেস করাতে তিনি বললেন, ‘লোকমান তো এখানে আসেনি’! একথা শুনে বাবা শিশুর মতো হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলেন। অতপর আর কখনো এভাবে না মারার ওয়াদা নিয়ে আমাকে বাবার সামনে হাজির করলেন ফুফু। আমাকে বুকে নিয়ে বাবার সে কী কান্না। সে স্মৃতি এখনো আমাকে কাঁদায়। এর পর থেকে বাবা আর কখনো আমাকে শারিরীক শাস্তি দেননি। একবার গভীর রাতে আমার ডাইরিয়া হয়েছিল। আমাকে মেডিকেল নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর ভাল জামাটি পর্যন্ত পরিধানের কথা ভাবেননি, আমি সুস্থ হয়ে না ওঠা পর্যন্ত আল্লাহর নিকট দোয়া করতে থেকেছেন এবং ‘হায় পুত, হায় পুত’ বলে আহাজারী করতেছিলেন- এই স্মৃতি ভোলার মতো নয়। বাবার ভলোবাসা শুধু শৈশবেই সীমাবদ্ধ ছিল না, আমার এ পঞ্চাশোর্ধ বয়সে এসেও তাঁর ভালোবাসা পেয়েছি অকাতরে। প্রত্যেকবার প্রবাসে আসার সময় তিনি আমাকে এয়ার পোর্টে পৌঁছে দিতেন। চেকইন হয়ে গেলে তাঁকে চলে যেতে বলতাম। তিনি বিমান উড্ডয়ন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইতেন, অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে তাঁকে চলে যেতে রাজী করাতে হতো। স্বাভাবিক অবস্থায় তিনি অসুস্থ বোধ করলে আমার সান্নিধ্য কামনা করতেন। কিন্তু বিগত সময়গুলোতে তিনি অসুস্থতায় ভুগলে রাতে আমাকে জানাতে নিষেধ করতেন এই ভয়ে যে, সে সময় জামায়াত-শিবির নির্মূলের নামে দেশে যে সন্ত্রাসী এবং পুলিশি নির্যাত চলতেছিল তার খপ্পড়ে পড়তে না হয়, যদিও ২৪/২৫ বছর যাবৎ প্রবাসী ওয়ার কারণে রাজনীতির সাথে জড়িত নই, তথাপী মুখে দাড়ি থাকাতে অনাকাঙ্খিত বিপদের ভয় করতেন। তাঁর শেষ অসুস্থতায়ও এমনটি ঘটেছিল। রাতে ডাক্তারের নিকট নিয়ে যাওয়ার জন্য ছোট মা আমাকে ফোন করতে চাইলে তিনি নিষেধ করেছিলেন এবং আমার ছোট বোন জেসমিনকে ডাকতে বলেছিলেন। জীবনের শেষ মুহুর্তে নিজে মৃত্যু যন্ত্রনায় কাতরিয়েও আমাকে নিরাপদ রাখতে চাইলেন আমার প্রিয় বাবা। ভালোবাসার এই আত্মত্যাগ কি ভুলার মতো?
তিনি খুব সহজে তাঁর প্রতিপক্ষ বা যারা তাঁকে কষ্ট দিতো তাদেরকে ক্ষমা করে দিতে পারতেন। চরম প্রতিশোধ স্পৃহা কখনো দেখিনি তাঁর মধ্যে। তাঁর নিকটজনদের মধ্যেই অনেকে তাঁকে ভুলবুঝে কষ্ট দিতে দেখে আমি ধরে নিতাম হয়ত এখানেই তাদের সাথে আব্বার দফারফা হয়ে গেলো। কিন্তু না, আবার কিছুদিন পর দেখতাম তারা আব্বার নিকট থেকে ঠিকই আগের মতো সুবিদা নিচ্ছে। বিষয়টি আমাকে খুবই ভাবনায় ফেলে দিতো এবং আমিও আব্বার সেই বৈশিষ্ট অনুসরন করে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছি।
পরোপকার ছিল তাঁর অন্যতম ব্রত। গরীব অসহায়দের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ দরদ ও ভালোবাসা। প্রায় দেখতাম রাস্তা থেকে ক্ষুধার্ত ভিক্ষুক এবং পাগলদেরকে ধরে এনে খাবার খাওয়াতেন, পরিধানের কাপড় ছেড়া দেখলে নতুন দিতে না পারলে পুরানো কাপড় হলেও দিতেন। গরীব অসহায় মেয়েদের বিয়ে দেয়ার ব্যপারে যথেষ্ট সহযোগীতা করতেন। নিজে উদ্দ্যেগ নিয়ে অনেক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। আবুধাবী প্রবাসী অবস্থায় তিনি পরিচিত বেকার লোকদেরকে চাকুরী না হওয়া পর্যন্ত নিজের রুমে থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। তিনি বছরে বেশ কয়েকবার তাঁর মরহুম মরহুমা পিতা-মাতার স্মরন এবং তাদের বিদেহি আত্মার মাগফেরাত কমনায় গরীব মিসকিন এবং স্থানীয় মসজিদের ইমাম মোয়াজ্জিনদেরকে খাবার খাওয়াতেন। এতে আত্মীয় স্বজনরাও বাদ যেতো না।
চলবে....
বিষয়: Contest_father
১৫৭৭ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অ.ট. আপনি ক’দিন যাবৎ মোবইলে মনে হচ্ছে? দেশে এসেছেন?
(রব্বির হামহুমা কামা রব্বাইয়ানী সাগির)
ভাগ্য আমাদের যখন এই বাবা মার প্রয়োজনটা বেশী তখন আমরা প্রবাসে।
মাঝে মধ্যে খুবই আপসেট হই। কিন্তু করার কিছু নেই ভেবে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাই্। দোয়া প্রার্থী ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন