বাবার স্মৃতি- ১

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ লোকমান ৩০ মার্চ, ২০১৪, ০৭:০৯:৩০ সন্ধ্যা

অধিকাংশ প্রবাসীর অপ্রাপ্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বদেনাদায়ক হলো- মৃত্যু পথযাত্রী আপনজনদের সাথে শেষ দেখাটুকু না হওয়া। আমার র্দীঘ প্রায় সিকি শতাব্দীর প্রবাস জীবনে অনকে আপনজন হারিয়েছি শেষ দেখাটি ছাড়াই। মা’কেও হারিয়েছি এভাবে। বাবার মৃত্যুর সময় তাঁর সান্বিধ্যে থাকার তাওফিক দিয়েছিলেন মহান আল্লাহ্। এজন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ চিত্তে শোকরিয়অ আদায় করছি- আলহামদু।

গত ২৫/১১/১৩ সকাল ৮:৪৫ টায় আমার প্রিয় আব্বা দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে মহান আল্লাহর সান্বিধ্যে পাড়ি জমিয়েছেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৮৩ বছর। আল্লাহর কৃপায় তিনি এতটাই সুস্থ-সবল ছিলেন, মৃত্যুর একমাস আগেও তাঁর সাথে হাঁটতে গিয়ে আমাকে প্রায় দৌঁড়াতে হতো। সুস্থ সবল এই মানুষটি মাত্র কয়েকটি দিন অসুস্থতায় ভুগে এক প্রকার কথা বলতে বলতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। মৃত্যুর প্রায় ১৫দিন আগে থেকে তাঁর মুখ একটু ফোলা ফোলা হয়ে গিয়েছিল এবং ৪/৫ দিন আগে থেকে তিনি কিছুটা অস্বাভাবিক আচরণ এবং অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতেছিলেন। তখনই নিয়ে যাওয়া হলো স্পেশালিষ্ট ডাক্তারের নিকট। ডাক্তার রক্ত পরীক্ষা করে দেখতে পেলেন আমার আব্বার থাইরয়েড হরমোনের পরিমান ৯০, যা স্বাভাবিক অবস্থায় থাকার কথা ০.৪০ - ৪.৮০। রোগ নির্নয়ের পর একদিন মাত্র ঔষধ দিতে পেরেছিলাম, দ্বিতীয় দিন দেওয়ার সুযোগ হয়নি।

মৃত্যুর আগের রাতে আমাদের সাথে অনেকক্ষণ বসেছিলেন সোফায়। ছোট শিশুর মতো নড়বরে হয়েগিয়েছিলেন, তাই একপাশে আমি এবং অন্যপাশে আমার ছোট বোন জেসমিন তাঁকে আগলে ধরে বসেছিলাম, বাচ্চাদেরকে যেভাবে আদর করা হয় সেভাবে বাবার মুখের সাথে আমার মুখটা অনেক্ষণ লাগিয়ে রেখেছিলাম। এর মধ্যে দুই ছোট ভাই ফোরকান এবং হান্নান আবুধাবী থেকে ফোন করে বাবার নিকট থেকে শেষবারের মতো মাফ-দোয়া চেয়ে নিয়েছে। আমি পাশে বসা, তবুও বাবাকে মুত্যু পথযাত্রী মনে করে তাঁর নিকট থেকে শেষ বিদায়ের মতো করে মাফ চেয়ে নিতে মন সায় দেয়নি। আমি ভেবেছি, ওকাজটি করতে গেলে বাবা নিজেকে মৃত্যু পথযাত্রী মনে করে মানসিক ভাবে আরো বেশী বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারেন। আব্বার নিকট থেকে মাফ চেয়ে নিতে না পারার দুঃখের মধ্যেও শান্তনার কারণ হলো, আমার সামান্য টুকটাক ব্যবসায়-বানিজ্য দেশের বাহিরে হওয়াতে বছরে বেশ কয়েকবারই প্রবাসে যেতে হয়। এই সুবাদে প্রতিবার বাহিরে যাওয়ার সময় ‘আবার দেখা হবে কি হবে না’ এই ভেবে খুবই আন্তরিকতার সাথেই ক্ষমা চেয়ে নিতাম এবং তিনিও দোয়া করে দিতেন।

বাবা কথা বলতে, গল্পগুজব করতে খুবই পছন্দ করতেন। অসুস্থ অবস্থায় জড়ানো কণ্ঠেও অনেক কথা বলেছেন। পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশ্যে বার বার বলতেছিলেন- ‘ইনসাফ -ইনসাফ, ইনাসাফ করিও’ মানে কাউকে ঠকাইও না। কিছুক্ষণ পর পর বলতে ছিলেন; ‘অনেকক্ষণ বসেছি এবার চলে যাই’, ‘কালকে সকালে চলে যাবো’ ইত্যাদি...। অনেকক্ষণ বাবার সাথে কাটানোর পর রাত প্রায় ১২টার দিকে তাকে শুইয়ে দিয়ে সবাই জেগে না থেকে কয়েকজনকে জেগে থেকে বাকীদেরকে ঘুমাতে বলে আমি স্ত্রী-সন্তানদেরকে নিয়ে আমার বাসায় চলে আসি। ফজরের নামাজ পড়তে উঠে ভগ্নিপতি হারুনকে ফোন দিয়ে বাবার অবস্থা ‘আগের চেয়ে একটু উন্নত’ হয়েছে বলে জানা গেলো। একটু আশ্বস্ত হলাম এবং মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম গোসল নাস্তা সেড়ে তাঁকে দেখতে যাবো এবং অবস্থা পর্যালোচনা করে উল্লেখ যোগ্য অগ্রগতি না হলে ক্লিনিকে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করবো।

সকাল আটটার দিকে সংবাদ পেলাম আব্বা অনেকটা সুস্থ বোধ করছেন, কথাবার্তার জড়তা চলে গেছে, জিহ্বার একপাশে ঘা এর মতো হয়েছিল তাও সেড়ে গেছে। তিনি গোসল করার ইচ্ছে ব্যক্ত করাতে ছোট বোন জেসমিন গোসলে সাহায্য করলেও অনেকটা নিজে নিজেই নাকি গোসল সেড়েছেন। গোসল সেড়ে পরিস্কার পাজামা পাঞ্জাবী চেয়ে নিয়ে পরিধান করেছেন। বাবাকে এভাবে সুস্থ হয়ে উঠতে দেখে উপস্থিত সকলেই যথেষ্ট অনন্দিত।

সে আনন্দ কিন্তু খুব বেশী সময় টেকেনি, কাপড়-চোপড় পরিধান করার অল্পক্ষণ পর আবার অবস্থা খারাপ হতে লাগলো। আমার এক বাগিনী ফোনে জানালো, নানার অবস্থা খুব খারাপ তাড়াতাড়ি এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করেন। আমি তখন তাঁকে দেখতে যাবার পথে। আমাদের জামাতা ডাক্তার আরমান মেডিকেলেই আছে, এম্বুলেন্স পাঠানোর জন্য তাকে ফোন করতে গিয়ে মানসিক টেনশনের কারণে তার ফোন নাম্বার বের করতে একটু সময় লাগতেছিল। এরই মধ্যে আবার ভাগীনির ফোন পেলাম, ‘নানা আর নেই’ ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। এভাবে অবসান ঘটলো একটি ঘটনা বহুল দীর্ঘ জীবনের।

চলবে...

বিষয়: Contest_father

১৬০৪ বার পঠিত, ২৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

200465
৩০ মার্চ ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৪৪
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : রাসুল (সাঃ) দুই ধরনের মৃত্য থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতে বলেছেন। এক হঠাৎ মৃত্যু দুই দির্ঘদিন অসুস্থ থেকে মৃত্যু। আল্লাহ আপনার আব্বাকে এই দুই থেকেই মুক্তি দিয়েছেন। আল্লাহতায়লা তাকে জান্নাত নসিব করুন।
৩১ মার্চ ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৩৭
150604
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : হাদীসের কথাগুলো খুব সুন্দর লাগলো।

আপনার দোয়ায় আমীন।
200467
৩০ মার্চ ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৫৬
সিটিজি৪বিডি লিখেছেন : Amader babader golpo sunte valo lagche..
৩১ মার্চ ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৩৮
150605
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : অনেকগুলো পড়লাম। আরো পড়ছি বাবাদের গল্প।
200484
৩০ মার্চ ২০১৪ রাত ০৮:৩৪
মেঘ ভাঙা রোদ লিখেছেন : পড়ে অনেক ভালো লাগলো তাই অনেক ধন্যবাদ
৩১ মার্চ ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৪২
150606
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : পড়ার জন্য আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
200487
৩০ মার্চ ২০১৪ রাত ০৮:৪০
ফাতিমা মারিয়াম লিখেছেন : মহান আল্লাহ আপনার বাবাকে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করে নিন। আমীন।
৩১ মার্চ ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৪২
150607
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : আমীন।
200492
৩০ মার্চ ২০১৪ রাত ০৮:৫৬
মেঘ ভাঙা রোদ লিখেছেন : পড়ে কষ্ট পেলাম। আল্লাহ আপনার বাবাকে বেহেশত নসিব করুন আমিন
৩১ মার্চ ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৪৩
150608
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : আমীন।
201106
০১ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০৪:২০
ইবনে আহমাদ লিখেছেন : অধিকাংশ প্রবাসীর অপ্রাপ্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বদেনাদায়ক হলো- মৃত্যু পথযাত্রী আপনজনদের সাথে শেষ দেখাটুকু না হওয়া।
একেবারে সত্য ও বাস্তব কথা। দোয়া করবেন যারা প্রবাসী তারা যেন সবাই বাবা মার পাশে থাকতে পারেন। মূহর্তটা এরকমই যে, একবার তা হারিয়ে বসলে আর কখনো পাওয়া যায় না।
০৩ এপ্রিল ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:০২
151758
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : চাকুরিজীবি প্রবাসীদের জন্য প্রথম সমস্যা হচ্ছে চাহিবা মাত্র ছুটি না পাওয়া, কম বেতনের প্রবাসীদের বেলায় অসময়ে ফ্লাইট ভাড়া সংগ্রহ করতে না পাওয়া আর সকল প্রবাসীদের কমন সমস্যা হচ্ছে সঠিক সময়ে ফ্লাইট না পাওয়া। তারপরও আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি তিনি যেন সকল প্রবাসীদেরকে অন্তত মৃত্যু পথযাত্রী মা বাবার পাশে থাকার তাওফিক দান করেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য এটা কোন ব্যাপারই না।
যেদিন আমার আব্বা মারা গেলেন সেদিনই ছিল আমার ফ্লাইট। কি একটা কারণে এর সপ্তাহ খানেক আগে ফ্লাইট ডেইট পিছিয়েছিলাম, অথচ তখন আমার আব্বা মারা যাবেন এমন লক্ষণ ছিল না। সূতারাং আল্লাহ চাইলে সব কিছুই পারেন।
202054
০৩ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০১:০৯
বিন হারুন লিখেছেন : "বাচ্চাদেরকে যেভাবে আদর করা হয় সেভাবে বাবার মুখের সাথে আমার মুখটা অনেক্ষণ লাগিয়ে রেখেছিলাম"
ইচ্ছে করছে এক্ষুনি দেশে যাই বাবার সাথে এমনই করি.আপনার মা-বাবাকে আল্লাহ জান্নাতবাসী করুন
০৩ এপ্রিল ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:০৮
151759
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : বাবার প্রতি আপনার আবেগ আমাকে অশ্রুশিক্ত করলো।
আল্লাহ আপনাকে সহসা মা বাবার সাথে সাক্ষাত করার তাওফিক দান করুন। এবং তাদেরকে সুস্থ রাখুন।
০৩ এপ্রিল ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:০৯
151760
বিন হারুন লিখেছেন : আ-মীন
202074
০৩ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০২:৩০
মামুন আব্দুল্লাহ লিখেছেন : পৃথিবীতে যার বাবা নেই সেই বুঝে বাবার প্রয়োজনটা । বাবার স্মৃতিগুলো আজো সতেজ হয়ে ভাসে । বাবাকে নিয়ে আমিও ছোট্ট একটি লেখা পোষ্ট করেছি । দোয়া করবেন ।
০৩ এপ্রিল ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:২১
151767
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : আপনার লেখাটি পড়েছি।
আপনার বাবার স্মৃতি বিজড়িত ঘটনাগুলো পড়ে খু্বই আবেগাপ্লুত হলাম। আল্লাহ আপনার বাবাকে জান্নাতের মেহমান বানিয়ে নিন আর আপনার আম্মাকে সুস্থ রাখুন।
202796
০৫ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৪:৪৯
ইবনে হাসেম লিখেছেন : আল্লাহ আপনার বাবাকে জান্নাতের মেহমান করে নিন এই প্রার্থনা। আমার বাবার অসীমের পথে যাত্রাও প্রায় একইরূপ সামান্য অসুস্থতার মাঝে হয়েছিল গত বছর ১৫ই এপ্রিল, বয়স প্রায় ৮০ ছিল। তবে আপনার মাতো ভাগ্যবান ছিলাম না, তাই সেসময় এই হতভাগা ছেলেটি তাঁর পাশে থাকার সুযোগ হয়নি.....
০৫ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৫:২১
152298
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : দোয়া এবং সমবেদনা জ্ঞাপনের জন্য অনেক ধন্যবাদ সৈনিক ভাই।
আল্লাহ আপনার বাবার প্রতিও রহম করুন। আমীন।
১০
225438
২৪ মে ২০১৪ দুপুর ০১:৫৫
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : ভালো লাগছে!
১৩ জুলাই ২০১৪ দুপুর ০৩:৩০
189791
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : ধন্যবাদ বাদশা ভাই। অনেক দেরীতে জবাব দেয়ার জন্য দুঃখীত।
১১
226522
২৬ মে ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৩২
নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা লিখেছেন : প্রিয়জনের চলে যাওয়াটা সত্যিই অনেক কষ্টের। আল্লাহ উনাকে জান্নাতুল ফিরদৌস নসীব করুন।
১৩ জুলাই ২০১৪ দুপুর ০৩:৩১
189792
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : আমীন। দেরীর জন্য খু্বই দুঃখীত।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File