ফ্লাই দুবাই বনাম বাংলাদেশ বিমান : ভ্রমনের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ লোকমান ২৪ অক্টোবর, ২০১৩, ১০:৩২:১৭ সকাল





অনেকটা বাধ্য হয়েই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে ভ্রমন করতে হয় আমাকে। কারণ আবুধাবী থেকে চট্টগ্রামের সরাসরি ফ্লাইট শুধু এটিই। যে কারণে অন্য এয়ার লাইন্সের সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি নিয়ে নানা রকম মুখরোচক কথাবার্তা চালু থাকলেও তা বাস্তবে যাচাই করা হয়নি এতদিন।

ফ্লাই দুবাই’র ফ্লাইটের সাথে বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের তুলনা করার একটু সুযোগ পেয়ে গেলাম গত ১৪ অক্টোবর। ঈদুল আযহা উপলক্ষে দেশে আসবো, কিন্তু আবুধাবী থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের কোন সিট পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই ফ্লাই দুবাইর শরণাপন্ন হলাম।

ফ্লাইট ছিল ১৪ অক্টোবর দুপুর ১:৩০ টায়। প্রায় ৫ ঘন্টা আগে, সকাল ৮:৩০ টায় বের হয়ে গেলাম দুবাই আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, টার্মিনাল-২ এর উদ্দেশ্যে। আবুধাবী থেকে ফ্লাইট হলে ঘন্টা দু’য়েক আগে বের হলেও হয়ে যেত। দুবাই যাওয়ার বাড়তি ভাড়া আর প্রায় তিন ঘন্টার অতিরিক্ত সময় ব্যয় তেমন কিছুই মনে হলো না, নতুন এয়ার লাইন্সে ভ্রমনের আগাম আনন্দে। দুবাইর মতো ধনী দেশের ফ্লাইট, বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের চেয়ে ‍সুযোগ সুবিধা একটু বেশীইতো হবে; এসব কল্পনা করতে করতে এসে পৌঁছলাম দুবাই বিমান বন্দরে।

চেক্ইন এর জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম বেশ কয়েকজন যাত্রী তাদের লাগেজ নির্ধারিত ওজনের চেয়ে বেশী হওয়াতে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছেন। মনে মনে বলতে লাগলাম, বোকা লোকেরা! অতিরিক্ত ওজন চার্জ পরিশোধ করলেইতো ল্যাটা চুকে যায়। এমন দৌঁড় ঝাপের কী দরকার? ওসব যাত্রীদের দৌঁড় ঝাপের কারণ বুঝতে পারলাম যখন আমার পালা এলো। আমার লাগেজের ওজন এক কেজি বেশী হওয়াতে তা বের করে নিতে বললেন। আমি বললাম সমস্যা নেই, এই এক কেজির জন্য ওজন চার্জ দেবো। না, ওজন চার্জ নেবেন না, অতিরিক্ত মাল লাগেজ খুলে বের করে নিতে হবে। আমার লাগেজটা চেইন টেনে তালা লাগানো ছিল, তাই এক মিনিটেই এক কেজি ওজনের একটি চকোলেটের প্যাকেট বের করে নিয়ে ঝামেলা মুক্ত হলাম। যারা ঘন্টা খানেক ধরে রশি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে লাগেজ বেঁধেছেন তারা বেশী ওজন নিয়ে কী পরিস্থিতিতে পড়েছেন তা সহেজেই অনুমেয়। এমন পরিস্থিতিতে আবুধাবীতে বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সে দেখেছি মাঝে মধ্যে এক-দেড় কেজি ছাড় দিয়েছেন অথবা আরেকটু বেশী হলে ওজন চার্জ নিয়েছেন। তারপরও ৫/৬ কেজি বেশী ওজনের লাগেজ ফ্রিতে নেয়ার জন্য যাত্রীদের সে কী দর কষাকষি, দেশী বিমান বলে কথা!

নির্ধারিত সময়ে বিমানে আরোহন করে সিটে গিয়ে বসলাম। এই বিমানের সিটগুলো বাংলাদেশ বিমানের সিটের চেয়ে অনুন্নত দেখতে পেলাম। এয়ার ট্রাফিক জ্যামের কারণে বরাবর এক ঘন্টা দেরীতে বিমান আকাশে ওঠলো। এই একটি ঘন্টা যাত্রীরা একেবারে সুবোধ বালকের মতো নিরবেই বসে রইলেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিমান হলে যাত্রীরা কেমন আচরণ করতেন তার একটি বাস্তব উদাহরণ পেশ করছি- গত কয়েক মাস আগে বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সএ দেশে যাওয়ার সময় আবুধাবী এয়ার পোর্টে ট্রাফিক জ্যমের কারণে উড্ডয়নে ঘন্টা খানেক দেরী হয়েছিল। দেরী ওয়ার কারণ বার বার ব্যাখ্যা করার পরও যাত্রীরা ক্ষিপ্ত হয়ে নানা রকম মন্তব্য করতেছিলেন। কেউ বিমানের চৌদ্দ গোষ্টি উদ্ধার করছেন, কেউ পাইলটকে গালি দিচ্ছেন, কেউ কেবিনক্রুদেরকে বলতে লাগলেন দরজা খুলে দিন, আমরা নেমে যাব। সে কী তোলপাড়; যেমনটি করা হয় সিটি সার্ভিস বাসের ড্রাইভার আর কন্ডাক্টরদের সাথে। আজকের এই ঘটনা দেখে মুরুব্বীদের সেই ক্ষেদোক্তিটি বার বার মনে পড়তে লাগলো যে, ‘বাঙ্গালীরা বিদেশী শাসনেই কাবু থাকে’। একবার নাকি ফিল্ড মার্শাল আইউব খান পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার নির্দেশ দিয়ে তা কার্যকর না হলে শাস্তি আর জরিমানার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আর যায় কই, পুকুর-ডোবার কচুরীপানা থেকে শুরু করে ঘরের পৈঠার নিচের ব্যাঙের ছাতাও নাকি বাদ যায়নি পরিস্কারের হাত থেকে। আর বৃটিশ আমলে দারোগা-পুলিশ দেখেই নাকি অনেকের কাপড় খারাপ করতো।

আগে থেকেই জানা ছিল ফ্লাইটে কোন খাবার পরিবেশন করা হবে না, তবে সেখানে খাবার বিক্রয়ের ব্যবস্থা থাকবে, কেউ ইচ্ছে করলে কিনে খেতে পারবেন। বিমান উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পর খাবার বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে কেবিনক্রুদের কয়েকজন ট্রলি নিয়ে এগোতে লাগলেন। তাদের ম্যানুতে ছিল কয়েক প্রকার স্যান্ডউইচ, কফি আর চিপস্। ভেতো বাঙালী, নিরুপায় হয়ে স্যান্ডউইচ দিয়ে এই বেলা সেরে নিচ্ছেন। ওমা! প্রায় এক তৃতীয়াংশ যাত্রীকে অভুক্ত রেখেই তাদের স্যান্ডউইচ আর অবশিষ্ট নেই- ঘোষণা এলো। সব ধরণের অব্যবস্থাপনা সহ্য হলেও পেটের ক্ষুদা নিয়ে এমন তামাশা সহ্য করার মতো নয়।

তারপরও ‘বিদেশী শাসন’ তাই নিরবে হজম করে চিপস্ আর কপি পান করতে থাকলেন যাত্রীরা। আমার ভাগ্যেও স্যান্ডউইচ জোটেনি।

তবে ভাগ্য ভালো, বিমানে আরোহণের পূর্বে এয়ারপোর্টের খাবারের দোকান থেকে কিছু সাদা ভাত আর আলু-গোস্তের রেজালা খেয়ে নিয়েছিলাম। নাহলে গ্যাস্টিকের সমস্যার উপর কফি আর চিপস খেয়ে রুগ্ন হয়ে বিমান থেকে বের হতে হতো। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স থেকে তুলনামূলক কিছুটা কম ভাড়ার বিমান এটি। সুতরাং খাবার নগদে কিনে খেতে হবে- সমস্যা নেই, কিন্তু খাবারের যোগান তো থাকা চাই।





পক্ষান্তরে বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের বিমানে চিনিগুড়া চালের খুশবুদার পোলাউর সাথে খাসী বা মুরগী ভূনা, সালাদ, বন, বাটার এবং ডেজার্ট হিসেবে ফিরনী-পায়েস থাকেই। তাছাড়া চা-কফি, জুস বা কোল্ড ড্রিংকস ও থাকে মেন্যুতে। ফ্লাই দুবাইর তুলনায় ভাড়া একটু বেশী হলেও বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের খাবার পরিবেশনের বিষয়টি সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে।

আমাদেরকে বহনকারী ফ্লাই দুবাই ফ্লাইটটির পাইলট থেকে শুরু করে কেবিনক্রু সকলেই ছিলেন আরব এবং আফ্রিকান। ফলে অধিকাংশ যাত্রী তাদের সাথে কথা বলে খুব সুবিধা করতে পারছিলেন না। তাই যাত্রীদের মধ্য থেকে কয়েকজন বলাবলি করছেন, ‘এই ফ্লাইটে দু’য়েকজন বাঙালী ক্রু হলেই ভাল হতো’। আমি রসিকতা করে বললাম, ‘ঝগড়া করার সুবিধার্থে দু’য়েকজন বাঙালী দরকার ছিল’। রসিকতা করলেও ওই যাত্রীদের দাবী একেবারে ফেলে দেয়ার মতো নয়। কারণ শতভাগ বাঙালী যাত্রী বহনকারী ফ্লাইটের জন্য বাঙলা ভাষা ভাষী ক্রু থাকা যৌক্তিক দাবী ছিল।

ওই ফ্লাইটের কেবিনক্রুগণ খুবই আন্তরিকতার সাথে যাত্রীদের আসন চিহ্নিত করণ, সিট বেল্ট বাঁধা এবং হাতে বহনযোগ্য লাগেজ ইত্যাদি গুছিয়ে রাখার ব্যপারে সাহায্য করেছেন, কোন বিরক্তির ছাপ ছিলনা তাদের মধ্যে। আমাদের বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের কেবিনক্রুরাও বেশ সহায়ক, তবে মাঝেমধ্যে দুয়েকজন একটু ব্যতিক্রমী হয়ে থাকেন। তাদের সাথে কিছু কিছু যাত্রির আকাশ ঝগড়া উপভোগ করতে হয় মাঝে মধ্যে। হাওয়াই জাহাজের চাকুরী আর যাত্রী বলে কথা!

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ফ্লাই দুবাইর এই কম ভাড়ার বিমান সংস্থাটি বেশ লাভবান হচ্ছে প্রতিবছর। আর আমাদের বিমান প্রতিমাসে নাকি দেড় থেকে দুই লক্ষ টাকা লোকসান দিয়ে আসছে। নিঃসন্দেহে দুর্নীতি ছাড়া অন্য কোন কারণে এই লোকসান নয়। আমাদের সরকারগুলো ভোট আর জোট হারানোর ভয়ে দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দেয়ার ফলে এমনটি হচ্ছে বলে মনে করেন বিজ্ঞজনেরা।

বিষয়: বিবিধ

৩৯৫৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File