বাবাকে ঘিরে কিছু সৃতি
লিখেছেন লিখেছেন রেজাউল ইসলাম ১৬ জুন, ২০১৩, ১১:১৫:৫৪ রাত
আমার জন্মের সময় আব্বার জাতপুর হাঁটের দিন ছিল, ১৩৮৭ সালের ২৭ বৈশাখ রবিবার বেলা ২টার সময়। এর আগের দিন আব্বা নানার বাড়ি থেকে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলেন, আকাশ জুড়ে তখন ঘন কালো মেঘ, যে কোন সময় নেমে আসবে বজ্রাঘাত সহ বৃষ্টি। মায়ের প্রশব বেদনার খবর পেয়ে আব্বা দ্রুত সাইকেল চালিয়ে আমার নানা বাড়িতে চলে এলেন।আব্বাকে আবার পাঠানো হল ফকিরের থেকে পানি পড়া আনতে, দ্রুত সাইকেল হাকিয়ে তিনি ফিরে এলেন।আমাকে পৃথিবীতে আনতে মায়ের অনেক কষ্ট হল। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর আমি ছিলাম কান্না বিহীন, অবস্থা বেগতিক দেখে এরশাদ আলি মামু বাশের চোঙ দিয়ে আমার মুখে ফুখ দিতেই আমি চিতকার দিয়ে কেদে উঠি। সবার মনে প্রশান্তি নেমে এলো। আব্বা বাড়ি ফিরে এলেন।
আব্বা কপর্দকহীন অবস্থায় সংসারের হাল ধরেন সামান্য কাপড়ের বাবসার দিয়ে। আয় রোজগারের দিকে তার সব সময় খেয়াল ছিল। ঝড়, বৃষ্টি উপেক্ষা করে কাপড়ের গাঁট নিয়ে হাটে গেছেন। ১৯৯১ সালের প্রচণ্ড ঝড়ের এক পূর্বে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যেও আব্বা চুকনগরের হাঁটে রওয়ানা হলেন, সারাদিন বৃষ্টির পর সন্ধার পর এলো তুমুল ঝড়, সেই রাতে আব্বা অনেক চেষ্টা করেও বাড়িতে ফিরতে পারেন নি। আম্মা আমাদেরকে নিয়ে খাটের নিচে কাটিয়ে দেন। ভালো ভালো খাবারের প্রতি আব্বার সর্বদা ঝোঁক ছিল। বিশেষ করে বিল থেকে মাগুর, কৈ আর শিং মাছ কিনে আনতেন আর মাঝে মাঝে আমিও আব্বার সাথে মাছ ধরতে যেতাম, আর খালই ভরে মাছ ধরে আনতাম। টাটকা সেই মাছের মিষ্টি সাধ যা এখনও আমার মুখে লেগে আছে, তা এখন টাকা দিলেও পাইনা।
মা প্রায় অসুস্থ থাকতেন আর ঝাল দিয়ে রান্না করা তরিতরকারি খেতে পারতেন না, ফকিরের খব্রা পড়া তাকে শুধু দুধ চিনি দিয়ে ভাত ছাড়া আর কিছুই খেতে দিতেন না। সুতরাং আব্বা মাঝে মাঝে আফসোস করে বলতেন “এত তাজা মাছ খেয়েও তোদের গায়ে যদি রক্ত না হয়”। আমার প্রায় ডাইরিয়া বা আমাশায় লেগেই থাকত, যার কারনে আমার গায়ে হাড় ছাড়া তেমন মাংশ ছিল না, বুকের পাঁজরার হাড় দৃশ্যমান ছিল। শফিকুলের সাথে একদিন পাটকেলঘাটা বাজারে গেঞ্জি কিনতে যেয়ে যখন আব্বার সামনে গায়ের শার্ট খুললাম, আমার বুকের হাড় দেখে আব্বা দুঃখ করে বললেন “দেখ, বুকের ভেতর কিছুই নেই”। ভালো ভালো কাপড় কিনতে তিনি কৃপণতা করতেন না। আব্বার কেনা কাপড় গুলো সবই ছিল ভালো মানের।দামেও কম।
আব্বা সবসময় হাস্যরস পসন্দ করতেন, বেশ রসিক মনের মানুষ ছিলেন তিনি। যারা হাস্যরস পছন্দ করত এরকম মানুষগুলো সবসময় আব্বার পাশে ভিড় জমাত। কিন্তু তিনি জ্ঞান অর্জন কে সবসময় গুরুত্ব দিতেন। জ্ঞানী লোকদের সম্মান করতেন। প্রায় তিনি একটা কথা বলতেন, “জ্ঞানী বোঝে ঠারে ঠরে, মূর্খ বোঝে কলি, আর অতি বোকা বোঝে কিল গোঁড়া দুই চার দিলি”। আমাদের সবসময় উপদেশ দিতেন, কিন্তু আমাদের অনেকেই তার কথামত না চললে কিংবা কেউ তার দাবিতে অবিচল থাকলে তিনি বলতেন, “যে দেবতা যাতে সন্তুষ্ট, তাকে তাই দিয়ে দাও।“
আব্বা আমাদের লেখাপড়ার উপর খুবই গুরুত্ব দিতেন। আব্বা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিলেন।আমার বড় চাচার অনেক সম্পদ ছিল, কিন্তু বারবার ডাকাতের কবলে পড়েছেন। এইজন্য আব্বা বলতেন ধন সম্পদ চোঁরে কেড়ে নিতে পারবে, কিন্তু বিদ্যা, বুদ্ধি কখনও নিতে পারবে না। আমার আম্মার মনে দুঃখ ছিল যে, আব্বা তাকে বিয়ের সময় কোন সোনার গহনা দিতে পারেনি, তো আমি যখন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার পড়তে গেলাম, আব্বা আম্মাকে প্রায় বলতেন ওরে মইরেম, সোনা তুই গায়ে দিয়ে কি করবি, সোনা দেখ তোর পেটে। আব্বার এই কথা শুনে মা সহ অনেকেই হাসতেন।
২০০৪ সালের অক্টোবর মাসে কুয়েট থেকে বের হলাম হাঁতে মাত্র ১০০০ টাকা সম্বল নিয়ে। চাকরি একটা জরুরী। ঢাকায় একটা ভাইভা দিয়েও আসলাম। পরে একটা পলিটেকনিকে মাত্র ৫০০০ টাকার বিনিময়ে একটা চাকরি জোগাড় করলাম। প্রথম ৯ দিন পর ১৫ই নভেম্বর রোজার ঈদ এলে প্রতিষ্ঠান থেকে মাত্র ১৩০০ টাকা পেলাম, যা দিয়ে আমার খরছ করতে করতে শেষ হয়ে গেল। আব্বার হাঁতে একটি টাকাও দিতে পারলাম না। ঈদ শেষে চাকরিতে ফেরার পথে আব্বা আমাকে জাতপুর বাজার পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলেন। বাজারে এসে বাসের জন্য অপেক্ষে করছি, সেই সময় আব্বা আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন “টাকা পয়শা আল্লাহ এক সময় দিবে, শুধু আল্লাহর কাছ থেকে জ্ঞান চেয়ে নিবা” ব্যাস, এতটুকু, তারপর বাস এলে আমি উঠে পড়ি আর চিন্তাও করিনি আব্বার সাথে এটা আমার শেষ মোলাকাত, শেষ একটা উপদেশ।
এরপর নভেম্বরের বেতন পাবার সময় একবার ফোন করলাম আব্বার কাছে কিছু টাকা পাঠাচ্ছি বলে। আব্বাও সেই ভাবে বাবসার জন্য পরিকল্পনা করতে লাগলেন। কিন্তু মানুষ চায় এক, হয় আর এক। আল্লাহ আব্বার সে ইচ্ছা আর পুরন হতে দিলেন না। ৩০ নভেম্বর সকাল বেলায় ফজরের নামাজ পড়লেন। একটা বিড়ি খেয়ে হেটে এসে সবেদা তলার ইট উঠাতে লাগলেন, এমন সময় বুকে বাথা অনুভব করলেন শরীর থেকে ঘাম ঝরতে লাগল। উনি বুঝতে পারছিলেন বড় কোন সমস্যা হয়েছে তাই মাকে ডাক্তার আনতে বললেন। কিন্তু মা আব্বার পাঞ্জাবীর পকেটে হাত দিয়ে দেখলেন তেমন কোন টাকা নেই, অগত্যা একটা সস্তা ডাক্তার আনা হল, যিনি গ্যাসের সমস্যা মনে করে ওষুধ দিলেন, কিন্তু কোন ফল হল না।কেউ কিছু বুঝতে না পেরে, আব্বার পাশে বসে এ গল্প সে গল্পে মেতে উঠলেন, ইতিমধ্যে আব্বা ঢুলে পড়ে গেলেন এবং তার মুখ থেকে রুহ বেরিয়ে গেল।
আজও আমার কানে বাজে তার শেষ উপদেশ। শেষ কথা।“টাকা পয়শা আল্লাহ এক সময় দিবে, শুধু আল্লাহর কাছ থেকে জ্ঞান চেয়ে নিবা” আমিও আল্লাহর কাছে দোয়া করি রাব্বি জিদনি ইল্মা। রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বা ইয়ানিস সাগিরা।
সবাই আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন
বিষয়: বিবিধ
১৯৭১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন