মেঘ বালিকার মানসিক বিড়ম্বনা

লিখেছেন লিখেছেন আজব মানুষ ১২ জুন, ২০১৩, ১০:২১:২১ রাত

এয়ার কন্ডিশন রুমে সুন্দর একটি সেক্রেটারিয়েট টেবিলের এক পাশে রিভলভিং চেয়ারে বসে আছে মেঘ বালিকা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো বেড়ে ক্রমেই মুখ-গলা ভিজিয়ে দিচ্ছে। এসি রুমে মাথার ওপর হাই স্পিরিডে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি সাইজের বৈদ্যুতিক পাখা ঘুরছে। তবুও পুরো শরীর তার ঘামে বিজবিজ করছে। কিন্তু সে দিকে তার মোটেও খেয়াল নেই। কিসের ভাবনা যেন তাকে আবগাহন করে রেখেছে।

মেডাম আসবো? ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে যেন বাস্তবে ফিরে এল মেঘ বালিকা। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো অফিসের পিয়ন সুদীপ্ত দাঁড়িয়ে আছে। হাতে তার মুখ বন্ধ একটি খাম। সেটি হাতে দিয়ে সুদীপ্ত বের হয়ে গেল রুম থেকে। খামটির মুখ খুলে এ ফোর সাইজের একটি অফিসিয়াল প্যাডে লেখা রিপোর্টটি পড়েই চমকে উঠলো মেঘ বালিকা। যা ভেবেছে তাই হল, তারই ভুল প্রমাণিত হল! হাত দু’টি কাঁপছে যেন। রিপোর্ট লেখা কাগজটি তার হাত থেকে খসে পড়ল। ফ্যানের বাতাসে সেটিকে উড়িয়ে নেয়ে ফেলে একেবারেই দরজার সামনে। কিন্তু সে দিকে তার কোন খেয়াল নাই।

দামি রিভলভিং চেয়ারে এলিয়ে দিল তার শরীর। চোখ বুজে আবার সে ভাবনায় ডুব দিল। এ তার পুরনো রোগ। আগেও সে এরকম সীন ক্রিয়েড করেছে। তার চেখের সামনে ছোট বেলার সেই স্মৃতিগুলো ভেসে উঠছে।

বাবা-মায়ের বেশ আদুরে মেয়ে। খুবই চটপটে মেঘ বালিকা। সারা দিন একান্নবর্তি পরিবারটিকে হইচই করে মাতিয়ে রাখে। চাচাত ভাই-বোনদের সাথে খুনসুটি লেগেই থাকে তার সবসময়। প্রচন্ড অভিমানী এই মেঘবালিকা। ছোট চাচা কোন দিন চুইঙ্গাম আনতে ভুলে গেলে কিংবা বাবা পছন্দের কোন জিনিস কিনে না দিলে কান্নাকাটি করে বাড়ি মাথায় তোলে সে দিন।

যেমন পাকা দুষ্টুমীতে, তেমনি ঝানু পড়ালেখায়। শুধুই কি পড়ালেখায়! না বরং সাহিত্য চর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে, খেলাধুলায়, আবৃত্তি সব বিষয়ে সে সমান পারদর্শি। রাস্তা দিয়ে যখন সে হেটে যেত, তখন মনে হত যেন আকাশের বুকে এক খন্ড শুভ্র মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। তাই সবাই তাকে আদর করে মেঘ বালিকা। তখন থেকেই তার আসল নাম এই মেঘ বালিকার তরে হারিয়ে গেছে।

এত এত গুণের মাঝেও যে তার কোন বদগুণ থাকবে না, তা কি হয় ? তারও রয়েছে ছোট একটি বদ অভ্যাস। আর এই বদ অভ্যাসটি তার জীবনকে সংকটে ফেলেছে অনেক বার। তার সেই বদ অভ্যাসটেকে এক কথায় বলা চলে মনরোগ। মাঝে মাঝে একজন লোককে অন্য আরেক জন লোক মনে করে বসে থাকে।

সে যখন ক্লাশ ফাইভে পড়ে তখনকার গটনা। তার পাশের বাসার এক ভাবি, স্বামির সাথে গেছে সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে। সিনেমা শেষে বাসায় আসার জন্য যখন রিক্সায় উঠছিল, তখন মেঘ বালিকা স্কুল থেকে বাসায় ফিরছে। পথে উভয়ের দেখা হয়, কথা হয়। কিন্তু ঐযে তার মাসিকরোগ! কয়েকদিন পর সে ঐ মহিলার শ্বাশুড়ির কাছে গিয়ে বলে, ভাবিকে সেদিন দেখলাম তার দেবরের সাথে সিনেমা দেখছে। ভাগ্যিস ভাবির স্বামি জানতেন তার রোগের বিষয়ে, তা না হলে যে কি হত তা অনুমান করতেই গা শিউরে ওঠে।

এরকম আরো কতক্ষণ তাকে ভাবনার রাজ্যে থাকতে হত কি জানে! কিন্তু হঠাৎ গলা খেকরানোর আওয়াজে তার চিন্তার ছেদ পড়ে। আরে আব্দুল্লাহ তুমি! কখন এলে? এইতো কিছুক্ষণ হল, হাতের কাগজটির দিকে দেখিয়ে আব্দুল বলল তোমার তন্ময় ভাব দেখে অনুমতি না নিয়েই ঢুকে গেলাম। এক নজর দেখেই মেঘ বালিকা চিনলো তার হাত থেকে খসে পড়া কাগজটিকে।

আব্দুল্লাহ এই হাসপাতালেরই একজন পরিচালক এবং প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা। মেঘবালিকা আর আব্দুল প্রায় সমবয়োসী। ছোট বেলা থেকেই দু’জনে তুখোড় ছাত্র। একসাথে বেড়ে উঠলেও তারা যতটা না বন্ধু, তার চেয়েও যেন বেশি শত্রু। সারাদিন তাদের খুনসুটি আর ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকতো। এই বয়সেও তার এতটুকুন কমতি নেই।

আব্দুল্লাহর হাতে কাগজটি দেখে মেঘ বালিকার শরীর যেন অপমান আর ক্ষোভে রিরি করে উঠলো। এখনই যেন তার উপর হামলে পড়বে। আব্দুল তার মুখের দিকে তাকিয়েই ছিল। সে বুঝে গেল মেঘ বালিকা তার হাতে কাগজটি দেখে নিজেকে অপমানিত মনে করছে। তাই সে মুচকি হেসে বলল, দেখ মেঘ সব সময়তো প্রতিধ্বন্ধি ভাব! কিন্তু আজ একটি বারের জন্য কি বন্ধু ভাবতে পার না?

মেঘ বালিকা চকিত একবার তাকাল আব্দুলের দিকে। আব্দুল্লাহ হেসে বল্ল, দেখ তুমি এই হাসপাতালের একজন ডাক্তার, আর আমি হলাম এর প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা। তুমি কিভাবে মনে করতে পারলে এরকম একটি দুর্ঘটনা আমি না জেনে থাকতে পারি? মেঘ বালিকা কিছু না বলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো। আরে বোকা মেয়ে! এসব সমাধান করার জন্যইতো আমাকে রাখা হয়েছে। বিশ্বাস কর, আব্দুল ভাই! এটি কিভাবে গটলো, আমি কিছুই বলতে পারবো না।

বল্লামতো কোন চিন্তা কর না। আমি সব মোটামুটি ম্যানেজ করতে পেরেছি। আর তুমি হয়তো জাননা! ঐরোগী মরেনি, একজন ভাল বিশেষজ্ঞ প্রফেসর আনিয়ে প্রোফার ট্রিটমেন্ট করিয়েছি। এখন সে সুস্থ।

সত্যি বলছো আব্দুল্লাহ? আমি তোমার কাছে চির ঋণী হয়ে থাকলাম আব্দুল ভাই! আপনার এই ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না।

আব্দুল মেঘ বালিকার এরকম আপনি- তুমি আর নাম আবার কখনো ভাইয়া বলে ডাকা লক্ষ্য করে নিজে নিজে মুচকী হাসলো। তারপর বলল্লো হয়েছে এবার চল, তোমাদের বাসায় সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। হ্যা চল, মেঘবালিকা বলল।

দাঁড়াও, তার আগে তোমাকে একটা কথা বলি শুন। এখন তুমি একজন ডাক্তার। এখন থেকে অন্তত দেখে শুনে কাজ করবে। আজ তুমি যে রোগীকে গ্যাসট্রোয়েটিজ রোগের জন্য এপেনডিসাইটিজের ঔষধ দিলে, এ যাত্রায় হয়তো তুমি রক্ষা পেয়েছ, কিন্তু ভবিষ্যতে আর নাও পেতে পার।

কিছুটা দুশ্চিন্তা গ্রস্থ হয়ে মেঘ বালিকা বল্ল, কি যে করি! তুমিতো জান, এইটা আমার খুব পুরনো রোগ। একজনকে অন্যজনের চরিত্র মনে করা। আল্লাহই জানেন এ সমস্যা আমার কোন দিন যাবে।

আব্দুল কিছুটা হেসে বল্ল, তাড়াতরি দূড় করাও। না হয় তোমার জন্য আবার পাগলা........... আব্দুল! ভাল হচ্ছে না কিন্তু, এই বলে আব্দুলের পিঠে একটা আলতো কিল দিল। আব্দুলও যখন দিতে গেল মেঘ বালিকা দৌড়ে রুম থেকে বাহির হয়ে গেল

বিষয়: বিবিধ

১৯৪০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File