বাংলাদেশে মুসলিম শাসন ও বাংলা সাহিত্য :

লিখেছেন লিখেছেন বিজয় ১১ মে, ২০১৪, ০৪:৩৭:০৪ বিকাল



মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজীর ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলার রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের সুচনা হয়. বখতিয়ার খলজীর জন্ম আফগানিস্তানে, তবে খলজী বংশের উত্পত্তি তুরস্কে সে কারণে বখতিয়ার খলজীকে অনেকে তুর্কি বীর বলে থাকে. এই ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত (মাজখানে ৫ বছর রাজা গনেশের শাসন ব্যতিত) পুরা সময়টাই মুসলমানরা শাসন করে. তবে মুসলিম শাসনের প্রথম দেড় শত বছর বাংলা সাহিত্যের কোনো চর্চা হয়নি. অনেকে বলে থাকেন আরব, আফগান, তার্কিশ, ইরানি মুসলমানরা প্রথমে নিজ নিজ ভাষা নিয়েই ছিলেন পাশাপাশি রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী ছিলেন. পরবর্তিতে স্থানীয় বাঙালিরা ইসলাম গ্রহনের কারণে বাহির থেকে আগত মুসলমানরা বাংলা ভাষার সংস্পর্শে আসতে থাকে, তাছাড়া মুসলিম সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সদস্যই ছিল বয়সে তরুণ এবং অবিবাহিত. তারা এদেশে বিয়ে করেন এবং বাংলা ভাষার সংস্পর্শে আসেন. এছাড়াও মুসলমানরা চিন্তা করতে থাকেন যে এদেশ শাসন করতে হলে, মানুষের কাছাকাছি পৌছতে হলে, ইসলামের বাণী ছড়িয়ে দিতে হলে সেটা বাংলা ভাষাতেই করতে হবে. ফলে মুসলমানরা বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে.

পাঠান মুসলমান সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত এবং বিভিন্ন নামে পরিচিত বাংলা ভাষাভাষী সমগ্র অঞ্চলকে একত্রিত করে সমগ্র অঞ্চলের নাম বাংলা রাখেন, সম্পূর্ণ দিল্লির প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে বাংলা পরিচালনা করেন.

মূলত সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ এর শাসনামল থেকেই বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ভাবে উত্সাহ দেয়া হতে থাকে. রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কারণে হিন্দুরা সংস্কৃত বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্য চর্চায় আগ্রহী হয়. শুধু তাই নয়, মুসলিম শাসকদের উত্সাহে হিন্দুরা তাদের রামায়ন বাংলায় অনুবাদ করে. সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের শাসনামল ছিল ১৩৩৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত. এই সময় থেকেই বাংলা সাহিত্যের মধ্য যুগের শুরু ধরা হয়. আর ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সুচনা ধরা হয়. তবে বাংলা সাহিত্যের আদি যুগ / প্রাচীন যুগে পালদের দ্বারা চর্যাপদ ছাড়া বাংলা ভাষায় আর কিছুই রচিত হয়নি.

বাংলা সাহিত্যের মধ্য যুগের আরেকজন অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ (১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪০৯ খ্রিস্টাব্দ ). তার শাসনামলেই রচিত হয় বাংলা সাহিত্যের প্রথম কাব্য গ্রন্থ বড়ু চন্ডিদাসের লেখা শ্রীকৃষ্ণকির্তন. বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি শাহ মুহাম্মদ সগীরের লেখা ইউসুফ-জুলেখা কাব্য গ্রন্থও এই সময়ে রচিত হয়.

সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের পুত্র ছিল সুলতান সিকান্দার শাহ, আর সুলতান সিকান্দার শাহের পুত্র ছিল সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ. এই গিয়াসুদ্দিন আজম শাহের কবর নারায়ণগঞ্জের সোনারগায়ে অবস্থিত. বাংলার আরেক শাসক আলাউদ্দিন হুসেন শাহও বাংলা ভাষার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন.

তবে কিছু কিছু বাঙালি হিন্দু কবি বাংলা সাহিত্য চর্চা পছন্দ করতেন না, তারা সংস্কৃতের মায়া ত্যাগ করতে পারেনি. তাদেরকে উদ্দেশ্য করে কবি আব্দুল হাকিম একটি কবিতা লিখেন--

"যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী

সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি."

বর্তমানে একুশে ফেব্রুয়ারিতে এ কবিতাটি ব্যবহার করা হয়, যদিও এটি ৫২র প্রেক্ষাপটে নয়, বরং বাংলা সাহিত্যের মধ্য যুগের সংস্কৃত প্রেমীদের নিয়ে লেখা একটি কবিতা.

মুসলিম শাসকরাই মূলত হিন্দুদেরকে বাংলা সাহিত্য মুখী করে তুলে. মুসলিমদের রচিত বাংলা সাহিত্য ও হিন্দুদের রচিত বাংলা সাহিত্যের মধ্যে একটা তফাত ছিল. হিন্দুদের রচিত সাহিত্যের ধারাকে মঙ্গল কাব্য বলা হয়. এগুলি ছিল মূলত দেব-দেবীদের কাহিনী কেন্দ্রিক-শ্রীকৃষ্ণকির্তন, মনসামঙ্গল ইত্যাদি. কিন্তু মুসলমানদের রচিত সাহিত্য ছিল মূলত মানুষ কেন্দ্রিক--ইউসুফ-জুলেখা, লায়লী-মজনু, শিরি-ফরহাদ ইত্যাদি. হিন্দুদের সাহিত্তে যেমন দেব-দেবীর বিষয়গুলি ছিল তেমনি মুসলমানদের রচিত সাহিত্য মানুষ কেন্দ্রিক হলেও সেখানে ধর্মীয় বিষয়গুলি বিভিন্নভাবে নিয়ে আসা হত. কিন্তু হিন্দু-মুসলিম কেউ কাউকে কটাক্ষ করে কিছু লিখতনা.

হিন্দু-মুসলিম এই দুটি ধারার বাইরে শ্রী চৈতন্য দেব একটি নতুন ধারা শুরু করেন যেটা বৈষ্ণব পদাবলী নামে পরিচিত. শ্রী চৈতন্যদেব বৈষ্ণব ধর্ম নামে একটি নতুন ধর্ম চালু করেন আর তার সাহিত্যের উদ্দেশ্য ছিল এই ধর্মকে প্রচার করা. তার ধর্মের মূল বক্তব্য ছিল মানব প্রেম, ভালোবাসা. মঙ্গল কাব্যের তুলনায় বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের বিচারে অনেক উন্নত ছিল এবং অনেক বেশি জনপ্রিয় ছিল. অনেকে বলে থাকেন হিন্দুরা যেভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে ছিল, শ্রী চৈতন্য দেবের আবির্ভাব না হলে হিন্দুদের এই স্রোত আটকানো যেত না. বাংলা সাহিত্যের মধ্য যুগে মুসলমানদের আরেকটি বড় অবদান হচ্ছে হাজার হাজার পুথি রচনা করা যেগুলে এখনো গ্রামে-গঞ্জে মানুষের মুখে মুখে শুনা যায়.

১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ ধরা হয়. মুসলিম শাসনের পরিবর্তে ব্রিটিশ শাসন শুরু হয়. ব্রিটিশরা খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলা শিখার আগ্রহ প্রকাশ করেন. কিন্তু তারা দেখল বাংলা ভাষায় কোনো গ্রামার নাই এবং কোনো গদ্যও নাই. মুসলমানদের হাতে বাংলা সাহিত্যের গোড়াপত্তন হলেও সেটা কবিতা, ছড়া, গান, পুথি এসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল. ব্রিটিশরা নিজেরা বাংলা ভাষা শিখা এবং বাংলা গ্রামার ও গদ্য রচনার জন্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করলেন. কিছু হিন্দু পন্ডিতকে এই কলেজে নিয়োগ করলেন. তারা গ্রামার এবং গদ্য রচনার কাজ শুরু করলেন ভালো কথা কিন্তু যেই আকামটি তারা করলেন সেটি হচ্ছে দীর্ঘ মুসলিম শাসনামলে যেসব মুসলিম টার্ম, আরবি শব্দ, ফার্সি শব্দ বাংলা ভাষায় মিশে গিয়েছিল সেগুলুকে বহিষ্কার করতে থাকলেন এবং সে জায়গায় সংস্কৃত শব্দ রিপ্লেস করতে থাকলেন. নতুন dictionary করা হলো যেখানে বাংলার সমার্থক শব্দ হিসেবে সংস্কৃত শব্দ বসানো হলো. ফলে নতুন বাংলা গদ্য খুব বেশি গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও নতুন dictionary 'র কারণে বাংলা ভাষা সংস্কৃতায়ন হতে থাকলো.

একদিকে ক্ষমতা হারানোর কারণে মুসলমানরা অভিমান করে শিক্ষা-দীক্ষা থেকে দুরে চলে গেল, আর যারা শিক্ষা-দীক্ষায় ছিল তাদের একটা বড় অংশ বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতায়নের প্রতিবাদে বাংলা সাহিত্যের পরিবর্তে উর্দু সাহিত্য চর্চা শুরু করলো. এভাবে মুসলমানদের অভিমানে অভিমানে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগে হিন্দুদের কর্তিত্ব অনেক বেড়ে গেল. অন্যদিকে সারা ভারতে হিন্দুদের কমন ভাষা ছিল হিন্দি, ফলে বাঙালি মুসলমানসহ সারা ভারতের মুসলমানরা তাদের কমন ভাষা হিসেবে উর্দুকে গ্রহণ করে নিল. এই কারণেও কিছু কিছু বাঙালি মুসলমান উর্দুমুখী হয়ে গেল. কিছু কিছু মুসলমান বাংলা সাহিত্য চর্চা করবে, নাকি উর্দু সাহিত্য চর্চা করবে এই নিয়ে দিদ্বা-দ্বন্দে পরে গেল. এমনকি কিছু কিছু বাঙালি মুসলমান বাংলা ভুলে গেছি এই ধরনের কথা বলে গর্ব বোধ করত. এত কিছুর পরও বাঙালি মুসলমানদের একটি অংশ বাংলা সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত ছিল.

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে মুসলমানরা হিন্দুদেরকে রামায়ন বাংলা অনুবাদে উত্সাহিত করলেও মুসলমানরা কোরান-হাদিসকে বাংলা অনুবাদ করেনি, অনুবাদ করেছে ফার্সি ভাষার যত প্রেম কাহিনী. সে সময়ে মুসলমানদের একটা ধারণা ছিল কোরান-হাদিস আরবি ভাষাতেই পড়তে হবে, বুজতে হবে. যদি সে সময়ে কোরান-হাদিসকে বাংলায় অনুবাদ করা হত তাহলে সমাজে এখন এত শিরক-বিদাত থাকতনা. আবার বাংলা ভাষার আধুনিক যুগে খ্রিস্টান মিশনারীরা যখন মুসলমানদের খ্রিস্টান বানানোর চেষ্টা করতেছিল তখন মুসলিম কবি সাহিত্যিকরা মুসলমানদের সচেতন করার লক্ষ্যে উর্দু ভাষায় বই লিখেন. কিন্তু এগুলি খুব বেশি কাজে আসেনি. অন্যদিকে মুন্সী মেহেরুল্লাহ বাংলা ভাষায় বই লিখে মুসলমানদের সচেতন করেন এবং এই বইগুলি বাংলায় হওয়ার কারণে অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করে.

বাংলা ভাষার মধ্যযুগে হিন্দু-মুসলিম কেউ কারো বিরুদ্ধে কিছু না লিখলেও আধুনিক যুগে এসে হিন্দুরা ব্রিটিশদের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে মুসলিম বিদ্ধেষী সাহিত্য রচনা শুরু করেন. এ সময়ে 'রঙ্গিলা মুহাম্মদ' নামে রাসুল (সাHappy কে অবমাননা করে এক হিন্দু একটি বই লিখেন. পরবর্তিতে মুসলমানরা সেই লোককে হত্যা করে এবং সরকার বইটি বাজেয়াপ্ত করেন. বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ ছিল মূলত বাঙালি হিন্দুদের উত্থানের সময় আর বাঙালি মুসলমানদের পতনের সময়. তবে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বাংলা সাহিত্য থেকে আরবি-ফার্সি শব্দকে বিদায় করলেও কবি নজরুল আর ফররুখ এর আগমনে বাংলা সাহিত্যে আবারও আরবি-ফার্সি শব্দের আগমন ঘটে.

এখন প্রয়োজন আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া শব্দগুলুকে খুঁজে বের করে নতুন বাংলা dictionary করা আর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ঘটনার অভিমান ভেঙ্গে বাংলা সাহিত্যের জগতে ফিরে আসা এবং নেতৃত্বর আসনে অধিষ্ঠিত হওয়া.

বিষয়: বিবিধ

৩৭৮২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

220299
১১ মে ২০১৪ বিকাল ০৫:৫৬
মেঘ ভাঙা রোদ লিখেছেন : ভালো লাগলো। অনেক অজানা তথ্য সম্পর্কে অবগত হলাম। ধন্যবাদ আপনাকে।
220422
১১ মে ২০১৪ রাত ১১:৪১
শুভ্র আহমেদ লিখেছেন : আরো চাই, তথ্য প্রমান রেফারেন্স সহ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File