পূর্ব বঙ্গ ও আসাম প্রদেশ এবং পাকিস্তান আন্দোলন: ০৭
লিখেছেন লিখেছেন বিজয় ১৮ জুন, ২০১৩, ০২:২৪:৫৫ দুপুর
১৪ আগস্ট, ১৯৪৭ সাল একটি ঐতিহাসিক দিন. ভারতে থেকে যাওয়া মুসলমানদের জন্য এই দিনটি অন্য আট-দশটি দিনের মতই, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য এ এক অবিস্বরনীয় দিন. 'কত পথ অতিক্রম করে, কত আধার রাতের সীমানা পেরিয়ে, কত তিতুমীরের শাহাদাত, কত ফকির মজনু ও শমসের গাজীর সংগ্রাম...১৮৫৭ সালের আজাদী আন্দোলন, সৈয়দ আমির আলী ও নওয়াব আব্দুল লতিফের বুদ্ধিবৃত্তিক সাধনা, খেলাফত আন্দোলনের পথ ধরে অবশেষে মুসলিম হোমল্যান্ড এর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো. আমরা পেলাম আজাদ ওয়াতান, স্বাধীন পাকিস্তান'.
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের অন্তর্গত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুর্শিদাবাদ এবং মালদাহ জেলাতেও সেদিন পাকিস্তানের পতাকা উড়ানো হয়েছিল. সেদিন দলে দলে মুসলমানরা ভারতের পশ্চিম বঙ্গ থেকে, বিহার রাজ্য থেকে, উত্তর ভারত থেকে নিজেদের ধন-সম্পদ, বাড়ি-ঘর সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে হিজরত করে চলে এসেছিল আমাদের কাছে. আমরাও তাদেরকে সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছিলাম মুসলিম ভাই হিসেবে. পশ্চিম বঙ্গ থেকে আগত মুসলমানেরা বাংলা ভাষী হবার কারণে আমাদের সাথে একাকার হয়ে গেলেও বিহারী এবং উত্তর ভারতের মুসলমানেরা উর্দু ভাষী হবার কারণে বিহারী / আটকে পরা পাকিস্তানি হিসেবে আজও পরিচিত. ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে আগত এসব উর্দু ভাষী মুসলমানরা আমদের ভাই হিসেবে বিবেচিত হলেও পরবর্তিতে বাংলাদেশের বামপন্থীরা যখন পশ্চিম বঙ্গ থেকে বাঙালি চেতনা আমদানি করতে থাকলো তখন থেকে বাঙালি মুসলিমদের সাথে ভারত থেকে আগত উর্দু ভাষী মুসলিমদের বিভিন্ন বিষয়ে দ্বন্দ দেখা দিল, আদমজী জুট মিল সহ বিভিন্ন জায়গায় বিহারী-বাঙালি মারামারি হলো. কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভাষার পরিচয়টা বড় পরিচয় ছিল না . বড় বিষয় ছিল আমরা সবাই ব্রাহ্মণ্য অত্যাচারের স্বীকার, আমরা সবাই মুসলমান. সকলে মিলে মহা উত্সাহ-উদ্দীপনায় দেশ গড়ার কাজ শুরু করে দিল, একটি টিনশেড বিল্ডিং এ ঢাকায় প্রশাসনিক কাজ শুরু হয়ে গেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের একটি অংশ সংসদ ভবন হিসেবে ব্যবহার হতে থাকলো, অন্যদিকে ভারত থেকে আগত মুসলমানদের ভরণ-পোষণ থাকা-খাওয়ার জন্য ফান্ড কালেকশন চলতে থাকলো.
এদিকে অনেক হিন্দু বিশেষত শিক্ষিত হিন্দুরা ভারতে চলে যাবার কারণে প্রশাসনিক কাজে স্থবিরতা দেখা দেয়, কেননা তত্কালীন সময়ে পূর্ব বঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষিতের হার একেবারে কম ছিল. অন্যদিকে ভারত থেকে আগত মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষিতের হার তুলনামূলক বেশি ছিল. ফলে প্রশাসনিক কাজে ভারতীয় মুসলমানদের থেকে ভালো সহযোগিতা পাওয়া যায়.
১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে ২০০ বছরের ইংরেজদের গোলামী থেকে এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচার থেকে আমাদের মুক্তি মিলে. বলা হয়ে থাকে ব্রিটিশ পূর্ববর্তী সময়ে সমাজে তেমন অভাব-অনটন লক্ষ্য করা যেত না, আর বৃটিশরা চলে যাবার সময় হিন্দুদের আর্থিক অবস্থা বিশেষ করে ব্রাহ্মনদের আর্থিক অবস্থা ভালো হলেও মুসলমানরা একটা চরম অভাবগ্রস্থ জাতিতে পরিনত হয়. অনেকেই ৪৭ এবং ৭১ কে একই রেখায় টানার চেষ্টা করেন এই বলে যে দুটিই দু:শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, অতপর মুক্তি. কথাটি সত্যি হলেও মনে রাখতে হবে দুই দু:শাসনের মধ্যে রয়েছে যোজন যোজন পার্থক্য. ২০০ বছরের ইংরেজ আর ব্রাহ্মণ্য অত্যাচারের তুলনায় পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরের শোষণ কিছুই না.
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ১৯৭০ সালে মানুষ আ:লীগ কে ভোট দিয়েছিল স্বায়ত্তশাসনের জন্য, স্বাধীনতার জন্য নয়. অর্থাত ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানিদের শোষণ সেই মাত্রায় পৌছে নাই যেই মাত্রায় মানুষ স্বাধীনতা চায়. বঙ্গবন্ধুর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে মিলিটারী আক্রমনের ফলেই মূলত স্বাধীনতার দাবিটি আসে. অন্যদিকে মুসলমানরা প্রথমে ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন, পরবর্তিতে ব্রিটিশ এবং ব্রাহ্মন দুটি থেকে মুক্তির আন্দোলন করেছে, এটি কোনো স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ছিল না. ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশে উন্নয়ন বলতে কিছুই হয়নি, অন্যদিকে পাকিস্তানের ২৩ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাদবাকি বড় বিশ্ববিদ্যালয় গুলি যেমন চট্রগ্রাম, রাজশাহী, কৃষি, বুয়েট, জাহাঙ্গীর নগর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় সকল মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশের বর্তমান সংসদ ভবন, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, মংলা বন্দর, চট্রগ্রাম বন্দর, আদমজী জুট মিল সহ ৭৬ টি জুট মিল এসবই পাকিস্তান আমলের. সুতরাং শোষণ যেমন হয়েছে তেমনি অনেক উন্নয়নমূলক কাজও হয়েছে. কিন্তু ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশে উন্নয়নের কোনো ছোয়া নেই, আছে শুধু ইংরেজ আর ব্রাহ্মনদের অত্যাচার, নির্যাতন আর শোষনের কাহিনী, লক্ষ লক্ষ লোক দুর্ভিক্ষে মারা গেছে ব্রিটিশ আমলে. সুতরাং ৭১ সালের যুদ্ধ চলাকালীন সময়টা ছাড়া পাকিস্তান আমলের শোষণ-নির্যাতনকে ২০০ বছরের ব্রিটিশ আর ব্রাহ্মণ্য অত্যাচারের সাথে তুলনা করাটা কোনোভাবেই চলে না, যদি কেউ তুলনা করে সেটা হবে পকেট মাইরের ঘটনার সাথে হলমার্ক লুটপাটের তুলনা করা. সবশেষে বলব আমরা একবার ৪৭ এ একবার ৭১ এ স্বাধীন হয়েছি, দুটি স্বাধীনতাকেই তার অবস্থান থেকে যথাযথ মূল্যায়ন করে আমাদের কে সামনে এগিয়ে যেতে হবে.
বিষয়: বিবিধ
২৯৬৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন