'পূর্ববঙ্গ ও আসাম' প্রদেশ এবং পাকিস্তান আন্দোলন: ০২
লিখেছেন লিখেছেন বিজয় ০৭ জুন, ২০১৩, ০৫:৫২:৫৮ বিকাল
ব্রিটিশ শাসনের প্রথম একশ বছর শুধু মুসলমানরাই ব্রিটিশ বিরুধী আন্দোলন করেছে আর হিন্দুরা ব্রিটিশদের থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেছে, এতে একদিকে যেমন মুসলমানদের শক্তি ক্ষয় হয়েছে, মুসলমানদের স্বাভাবিক জীবন-যাপন ব্যাহত হয়েছে অন্যদিকে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনাস্থা তৈরী হয়েছে. ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পরাজয়ের পর মুসলমানরা স্বর্বশান্ত হয়ে পরে. মুসলমানদের একটা বড় অংশ আফগানিস্তানে হিজরতের সিদ্ধান্ত নেয়. অন্যদিকে মওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী ফতওয়া দেন যে দারুল হরব এবং দারুল ইসলাম এর মাজামাজি একটা অবস্থা আছে যেটাকে তিনি দারুল আমান নাম দিয়েছেন যেখানে সরকারী বাধা ছাড়া ইসলামের মৌলিক বিধি-বিধান পালন করা যায় এবং তত্কালীন ভারতে সেই অবস্থা বিরাজ করতেছিল. দারুল আমান ফতুয়ার কারণে স্যার সৈয়দ আহমদের আলিগর আন্দোলন সফলতা পায়. ফলে হিজরতের চিন্তা এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ বাদ দিয়ে মুসলমানরা পড়াশুনা-চাকুরীতে মনোযোগী হয়. ব্রিটিশ সরকারও মুসলমানদের প্রতি কিছুটা নমনীয় হয়. মুসলমানরা যখন পড়াশুনায় এগিয়ে আসার কারণে চাকুরিতে হিন্দুদের প্রতিদ্বন্দী হওয়া শুরু করলো হিন্দুরা এটাকে ভালোভাবে নিতে পারলনা. তারা ব্রিটিশ বিরুধী আন্দোলনের চিন্তা শুরু করলো এবং মুসলমানদেরকে আবারও ব্রিটিশ বিরুধী আন্দোলনের আহ্বান জানালো. এ প্রসঙ্গে হিন্দু-মুসলমানদের এক সমাবেশে "ডা: বিধান রায় বলিলেন: তা হলে মুসলমানদের কথা এই: স্বাধীনতা সংগ্রামে যাব না, কিন্তু চাকুরিতে অংশ দাও.' পাল্টা জবাবে উস্তাদ স্যার আব্দুর রহিম বলিলেন: তা হলে হিন্দুদের কথা এই: চাকুরিতে অংশ দিব না, কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামে আস" (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর-আবুল মনসুর আহমদ). তত্কালীন সমাজের চিত্র তুলে ধরে আবুল মনসুর আহমাদ বলেন শিক্ষক হিন্দু-ছাত্র মুসলমান, ডাক্তার হিন্দু রুগী মুসলমান, উকিল হিন্দু ক্লায়েন্ট মুসলমান........
এর বাইরে মুসলমানদেরকে হিন্দুদের পূজায় চাদা দিতে বাধ্য করা হত, অনেক জায়গায় মসজিদে নামাজ চলাকালীন সময়ে হিন্দুরা মসজিদের সামনে দিয়ে গান-বাজনা করতে করতে যেত যেটা হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি ঘটায়. হিন্দু জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মুসলমানদেরকে জুতা হাতে করে নেয়া লাগত. হিন্দু জমিদাররা মুসলিম প্রজাদের সাথে দেখা করতে আসলে জমিদাররা বসত চেয়ারে, প্রজারা বসত মাটিতে, এমনটি প্রজাদের পাটি বিছিয়ে বসার অধিকারও ছিল না.
এদিকে হিন্দুদের বঙ্গভঙ্গ বিরুধী আন্দোলন মুসলমানদেরকে দারুণভাবে মর্মাহত করে, মুসলমানদের অগ্রযাত্রা হিন্দুরা মেনে নিতে পারে না এটা আবারও প্রমানিত হয়. ১৯১১ সালে বঙ্গ ভঙ্গ রদ হওয়ার ফলে থেমে যায় ঢাকাসহ পূর্ব বঙ্গ ও আসামের অগ্রযাত্রা, অপেক্ষা করতে হয় ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত. বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য হিন্দুরা এত উগ্র আন্দোলন শুরু করে যে ব্রিটিশ সরকার রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়. অন্যদিকে বাঙালি হিন্দুরা বাঙালি মুসলমানদেরকে বাঙালি হিসেবে স্বীকার করত না. তখন বাঙালি মুসলমানদের ফুটবল টিম ছিল মোহামেডান, আর বাঙালি হিন্দুদের টিম ছিল মোহনবাগান. এই দুই টিমের মধ্যে খেলা হলে হিন্দুরা বলত বাঙালিদের সাথে মুসলমানদের খেলা হচ্ছে. অর্থাত মুসলমানরা বাঙালি না. (ফেলে আসা দিনগুলি-ইব্রাহিম হোসেন)
যেই হিন্দুরা নিজেদেরকেই একমাত্র বাঙালি মনে করতে থাকলো এবং কথায় কথায় বাঙালিপনা জাহির করত তারাই একসময় সুর পাল্টে ভারতীয় হয়ে গেল. আবুল মনসুরের ভাষায় "উনিশ শতকের শেষে বিশ শতকের গোড়ার দিকে হিন্দু কবি সাহিত্যিক ও রাষ্ট্র নেতারা 'বাংগালি জাতিত্ব' 'বাংলার বিশিষ্ট' 'বাংলার কৃষ্টি' 'বাংলার স্বাতন্ত্র' ইত্যাদি প্রচার করিতেন. অনেকে বিশ্বাসও করতেন. কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভোটাধিকার প্রসারে বাংলার রাষ্ট্রীয় অধিকার মেজরিটি মুসলমানের হাতে চলিয়া যাইবে এটা যেদিন পরিষ্কার হইয়া গেল, সেদিন হইতেই হিন্দুর মুখে বাংগালি জাতিত্বের কথা, বাংলার কৃষ্টির কথা আর শুনা গেল না. তার বদলে 'ভারতীয় জাতি' 'ভারতীয় কৃষ্টি' 'মহাভারতীয় মহাজাতি' ও 'আর্য সভ্যতার' কথা শোনা যাইতে লাগিল".
হিন্দুরা মেজরিটি মুসলমানের অধীনে থাকার ভয়ে বাঙালিত্বের খোলস পাল্টে ভারতীয় হয়ে গেল. আর সেই পশ্চিম বঙ্গের ভাইদের জন্য আমাদের দেশের নাস্তিকদের আর আ:লীগের লোকদের কতই না দরধ. মজার বিষয় হচ্ছে যেই আমাদেরকে তারা কোনদিন বাঙালি বলতনা শুধু মুসলমান বলত সেই আমরাই যখন মুসলমান আইডেন্টিটির কারণে ১৯৪৭ সালে তাদের থেকে আলাদা হয়ে গেলাম এখন তারা আমাদেরকে মুসলমান না বলে বাঙালি বলতেছে যাতে করে আমরা তাদের কাছে ফিরে যাই, বিসর্জন দেই আমাদের দুই দুইটি স্বাধীনতা একটি ১৯৪৭ সালের, একটি ১৯৭১ সালের.
শুধু আবুল মনসুরই নয়, বঙ্গবন্ধুও তার জীবনীতে হিন্দুদের বিভিন্ন আচরণ তুলে ধরেছেন যাতে দেখা যায় তারা কখনো আমাদেরকে মন থেকে মেনে নিতে পারত না. মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দুদের মানষিকতা ছিল মুসলমানরা নামে মাত্র মুসলমান থাকবে এবং জীবনাচরণ-সংস্কৃতি সবকিছুতে হিন্দুদের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে. অথচ মুসলমানরা জীবনের সর্বক্ষেত্রে সবধর্ম থেকে আলাদা. মুসলিম নেতৃবৃন্দ শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই ঐক্যে বিশ্বাসী ছিল. আবুল মনসুরের ভাষায় হিন্দু-মুসলিম হাজার বছর একসাথে থাকলেও সামাজিক ঐক্য হয় নাই. হয় নাই এইজন্য যে হিন্দুরা চাহিত 'আর্য-অনার্য শক-হুন যেভাবে 'মহাভারতের সাগরতীরে 'লীন' হইয়াছিল, মুসলমানরাও তেমনি মহান হিন্দু সমাজে লীন হইয়া যাউক. তাদের শুধু ভারতীয় মুসলমান থাকিলে চলিবে না, হিন্দু মার্কা মুসলমান হইতে হইবে, এটা শুধু কংগ্রেসী বা হিন্দু-সভার জনতার মত ছিল না, রবীন্দ্রনাথেরও মত ছিল.
ব্রিটিশবিরুধী আন্দোলনে প্রথম একশ বছর হিন্দুদের অংশ গ্রহণ না করা, বঙ্গভঙ্গ রদের নামে হিন্দুদের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বঙ্গের উন্নয়নকে মেনে নিতে না পারা, চাকুরীতে মুসলমানদের সুযোগ-সুবিধা দিতে না চাওয়া, পূজায় মুসলমানদেরকে চাদা দিতে বাধ্য করা, মুসলমানদেরকে নামে মাত্র মুসলমান রেখে হিন্দু ধর্ম মুখী করার মানুষিকতা, হিন্দু কালচারে টেনে নেয়ার মানুষিকতা সবকিছু মিলে হিন্দু-মুসলিমের একসাথে থাকা অসম্ভব হয়ে পরে. (চলবে )
বিষয়: বিবিধ
১৭৩৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন