"চলে গেলেন নাফেরার দেশে"
লিখেছেন লিখেছেন মাহবুবা সুলতানা লায়লা ২৩ নভেম্বর, ২০১৬, ০৭:০৭:১২ সন্ধ্যা
"খসে গেলো মু'মিনের আকাশ থেকে একটি নক্ষত্র" তাই গতকাল থেকে মনটা খুবই খারাপ। কেন? পড়তে থাকুন...... জানতে পারবেন। কালকেই লেখাটা পোস্ট করতে চাইলাম কিন্তু কী বোর্ডে হাত চলল না। তাই লেখাটা শেষ করতে পারিনি। উনার সাথে খুব বেশিদিনের পরিচয় নয় কয়েক বছরের সম্পর্ক। আমি প্রবাসে আসার আগে মনে হতো একাকি সেখানে থাকতেই পারবোনা। অথচ এই ভাবি আমাকে এতটা ভালোবেসেছেন যে, মনে হয়েছে আমার মায়ের কাছেই আমি আছি। সামান্য অল্প কয়েক বছরেই এত আপন হয়েছেন যে, মনে হচ্ছে আমার শরীরের একটি অংশ হারিয়ে ফেলেছি। মসজিদে নববীতে বসে কত সন্ধ্যা কথা বলেছি। যখন আমার কলিজার টুকরোকে হারিয়ে আমি হতাশিত তখন কত শান্তনা দিয়েছেন আমাকে। নিজের দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝিয়েছেন আমাকে। ধৈর্যের কথা বলেছেন ধৈর্য ধরতে পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি প্রত্যেকের জন্যই ছিলেন উদার আকাশের মতন। নিজের প্রিয় প্রিয় বস্তু গুলো হাদিয়া দিয়ে গেছেন সবাইকে। আর বলতেন আল্লাহ্ তো প্রিয় জিনিস গুলোই দিতে বলেছেন তাই দুনিয়ার ভালো ও প্রিয় জিনিস গুলো দিচ্ছি দোয়া করবেন আল্লাহ্ যেন কবুল করে। আমি বলতাম ফি আমানিল্লাহ। যার সাথেই দেখা হতো মনে হতো তিনি হয়তো আমাকেই বেশী ভালোবাসেন কিন্তু তিনি সবাইকেই প্রাধান্য দিতেন, চিকিৎসা দিতেন, কখনো কোন বাঙালি থেকে ফি নেননি বরং সবার জন্যে না হলেও বেশীরভাগ মহিলাদের জন্যেই ঔষুধ নিজের টাকায় কিনে দিতেন। কারো সমস্যা শুনলে দেখতে যেতেন, মানুষকে উৎসাহ দিতেন রোগী দেখতে গেলে কি সওয়াব হয় বলে বলে। একজন ডাক্তার হিসেবে যতটুকু মুড দেখানোর তা কখনোই দেখাতেন না। কে কোন জেলার সেটা না ভেবে নির্বিশেষে সবারই উপকার করতেন। এসব কারনে উনার সাথে কথা বলতে সুযোগ পেতাম না। মানুষের এতবেশী আনা-গোনা ছিলো যে, আমি কখনোই উনার সাথে মন খুলে কথা বলতে পারিনি। কিন্তু যখন উনার ক্যান্সার ধরা পড়লো তারপর থেকে উনার নিজ জেলার লোকেরাও উনার থেকে আলাদা হয়ে গেলো।
মানুষের মাঝে কতটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন তা বুঝতে পারলাম যখন মানুষে উনার কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেলো। ক্যান্সার রোগ ছোঁয়াচে মনে করে উনার সাথে কেউ বসতেও চাইতো না। উনার হাত থেকে কিছু দিলে কেউ নিতে চাইতো না। বয়সে যতটা না বুড়িয়েছেন শারীরিক রোগে, সন্তান হারানোর শোকে, মানুষের অবহেলায় ঠিক তার দ্বি-গুণ বয়স বেড়ে গেছিলো উনার। উনার জেলার লোকসকল যখন উনাকে অবহেলা করে দুরে সরে গেলো, একাকি নিঃসঙ্গতা বেড়ে গেলো শারীরিক রোগে মনের কষ্টে যখন হতাশ তখন আমি উনার কাছে থাকার একটা বিশেষ সুযোগ পেয়ে গেলাম আলহামদুলিল্লাহ্। এই কষ্টের সময় থেকে আমি চেষ্টা করলাম উনার পাশে থাকতে। দেশে যাবার কয়েকমাস আগে এতটাই নিঃসঙ্গ হয়ে ছিলেন যে, কথা বলার জন্যেও কাউকে পেতেন না। আমি খোজ নিতাম ফোন করে, আমার খোজ নিতো ফোন করে, হারামে আমি উনার জন্যে অপেক্ষা করতাম, উনিও আমার জন্যে অপেক্ষা করতো। শেষের দিনগুলোতে আমি এতটা কাছের ছিলাম যে, তিনি বলতেন ভাবিঃ যখন সবার চিকিৎসার দরকার ছিলো আমি চিকিৎসা দিতে পারতাম তখন ডাক্তার সানোয়ারার অনেক দাম ছিলো কিন্তু এখন আমিই রোগী তাই আমার এখন কোন দাম নেই। আমি শান্তনা দিতাম ভাবি; মানুষের দেয়া দাম দিয়ে কি করবেন? আল্লাহই আপনাকে দামী উপহার দিবেন কারন আপনি মানুষের কল্যাণে জীবনের উপার্জন ব্যয় করছেন, মানুষকে সেবা দিয়েছেন, এখনো দিচ্ছেন, যার কিছু দরকার নেই তাকে ভালো পরামর্শ দিচ্ছেন সেগুলো আল্লাহ কবুল করলে আপনিই মহা ভাগ্যবতী হয়ে যাবেন। আমরা দোয়া করি আল্লাহ সেগুলো কবুল করুন। তিনি আমিন বললেন॥ আমিও আমিন বললাম॥
যাবার আগে আমাকে অনেক কিছু উপহার দিলেন আর বললেন ভাবি এসব আপনি নিজে ব্যবহার করবেন কাউকে দিবেন না। আমি বললাম কেন ভাবি? তিনি বললেন এটা আপনি ব্যবহার করবেন আর আমাকে মনে করে দোয়া করবেন। আমি বলেছিলাম ভাবি দোয়া করার জন্য এসবের দরকার নেই। আপনি এমনিতেই মনের মাঝে প্রিয় হয়ে আছেন থাকবেন আপনার জন্যে সবসময়ই দোয়া। মহান আল্লাহ আপনাকে সুস্থতা দান করুন। আপনি আবারো সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসেন। তিনি ইন-শা-আল্লাহ্ বললেন। ৭ই মে মসজিদে নববীতে একসাথে মাগরীব ও এশার সালাত আদায় করে অনেকক্ষন পাশাপাশি বসে ছিলাম। কতকথা বলে গেলেন আমাকে। প্রত্যেক কাজে সবরের পরামর্শ দিলেন। আমার মেয়েকে দ্বীন শিখানো কথা বললেন। আরো অনেক অনেক কথা। কে জানতো আর দেখা হবেনা সেই দেখাই ছিলো আমাদের শেষ দেখা। আমি উনার সন্তানের বয়সের তারপরও উনি কখনো আমাকে তুমি বলেননি। আমাকে এতটাই ভালোবাসতেন যে, নিজে চেয়ার ছেড়ে বলতেন ভাবি এখানে বসেন। আমি বলতাম না ভাবি আপনি বসেন আমি আরেকটা চেয়ার খুজে বসতাম নয়তো মসজিদে নববীর মেঝেতেই বসতাম। তিনি কাউকে অনুরোধ করে হলেও চেয়ার আনাতেন আমার জন্যে। সত্যিই মহীয়ষী ব্যক্তিগণ ছোটদেরকেও সম্মান করে এই ভাবিকে না দেখলে, উনার সাথে পরিচিত না হলে আমি ও হয়তো জানতাম না। উনি বাঙালি জাতির সেরা সন্তানদের একজন। বাংলার মুখ উজ্জল করে দীর্ঘ পঁয়ত্রিশবছর প্রবাসী মানুষের সেবা ও বাঙালি পরিবারের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন আল্লাহর রাজি খুশির জন্য। বাঙালি পরিবারগুলোর যত সন্তান প্রবাসে পৃথিবীর আলোর মুখ দেখেছে বিশেষ করে মদিনায় তাদের সবগুলোই এই ভাবির নিঃস্বার্থ অবদান। এমন ডাক্তার বাংলার বুকে আর একজন ও আছে কিনা সন্দেহ আছে। এই ভাবির জন্যে প্রবাসী বাঙালি পরিবারগুলো প্রত্যেকেই আজকে কাঁদছে। গতকাল বাংলাদেশ সময় প্রায় সাড়ে পাঁচটার সময় উনার স্বজনসহ আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে তিনি চলে গেলেন আল্লাহর সান্নিধ্যে।
এক নজরে ডাঃ সানোয়ারা- মদীনার প্রবাসী বাংলাদেশী পরিবারগুলোর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক রহমতের নাম ছিলেন। তিনি বহু বছর মদীনার ওহুদ হাসপাতালের গাইনী বিভাগে ছিলেন। চেনা-অচেনা নির্বিশেষে তিনি ছিলেন সবার জন্য উদার সহযোগিতার এক বিরল উদাহরণ। বিগত কয়েক বছর যাবৎ দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। তার আকুল আকাংখা ছিল বারযাখী জীবন মদীনায় কাটাবেন, কিন্তু মহান আল্লাহর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আলহামদুলিল্লাহ্! তিনি গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশের চট্টগ্রামে অবস্থানকালে প্রতিপালকের নিকট পৌঁছে গিয়েছেন। ইন্না-লিল্লা-হি ওয়াইন্না-ইলাইহি রা-জীউন! তিনি আমাদের সবার প্রিয় ডাঃ আনিস ভাবী।
আল্লাহ্ তার জীবনের সমস্ত ভালো কাজগুলো কবূল করুন এবং প্রতিদানে বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিন। ইচ্ছা-অনিচ্ছায় ঘটে যাওয়া জীবনের ভুলগুলো তাঁর করুণায় ক্ষমা করে দিন এবং পূণ্য দ্বারা বদল করে দিন। তার জন্য কবরের প্রশ্নোত্তর গুলো সহজ করে দিন এবং কবরের সাথে জান্নাতের একটি শান্তিময় জানালার সংযোগ স্থাপন করে দিন- এই আমাদের আল্লাহর কাছে প্রার্থনা। উনি একজন ডাক্তার হয়েও সারা জীবন ইসলামের বিধি-বিধান মেনে চলতে চেষ্টা করেছেন। সুন্নতী পন্থায় চলেছেন। ডাক্তারী পেশায় থেকেও মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। মানুষকে আল্লাহর বিধান শিখিয়েছেন মহান আল্লাহ উনার সকল জনকল্যাণ মূলক কাজকে কবুল করুন। আপনারা সকলে এই দ্বীনি বোনের জন্যে দোয়া করবেন।
বিষয়: বিবিধ
১৬৩৬ বার পঠিত, ২৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ একজন নিরব সেবিকার কথা আমাদের জানানর জন্য।
একজন দ্বীনি বোনের চলে যাওয়া আসলেই এক বিরাট শূন্যতা।
তোমার সাথে আমরাও সমব্যথী হলাম। মহান রব উনাকে উত্তম পুরুস্কার নসীব করুণ। আমীন।
আমীন ।
মহান আল্লাহ এই দ্বীনি বোনকে জান্নাত দান করবেন।
ভালো মানুষরা বেশি দিন থাকেন না, সবাইকে কাঁদিয়ে বিদায় নেন।
আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দিকে মাফ করে দিক, আপন করুনায় জান্নাত দান করুক। আমীন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন