রমাদ্বান উপলক্ষ্যে ব্লগ আয়োজনের ৩য় পর্বে "গরীব দুঃখী ধনী সকল আয়রে ছুটে" "রমাদ্বানের সব ফজিলত নেরে লুটে"
লিখেছেন লিখেছেন মাহবুবা সুলতানা লায়লা ১৪ জুন, ২০১৬, ০৬:৫১:২৪ সন্ধ্যা
"গরীব দুঃখী ধনী সকল আয়রে ছুটে
রমাদ্বানের সব ফজিলত নেরে লুটে"
আল্লাহ তা'য়ালা বলেন: “হে ঈমানদারগণ, তোমাদের জন্য রোযা ফরয করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি ফরয করা হয়েছিল, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।”(সূরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩)।
মূলত সিয়াম আল্লাহর পক্ষ হতে অনেক বড় একটি নিয়ামত। এটি যে কত বড় নিয়ামত ও ফজিলতপূর্ণ তা হাদীসে কুদসীতে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ( أنَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ: «قَاَلَ اللَّهُ: كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ إِلَّا الصِّيَامَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ». (خ, م) صحيح
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ তা'আলা বলেন, সিয়াম ব্যতীত বনি-আদমের প্রত্যেক আমলই তার জন্য, আর শুধামাত্র সিয়ামই আমার জন্য, আমিই এর প্রতিদান দেব”।
[বুখারি ও মুসলিম] ।
আরেকটি হাদীসে কুদসীতেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছেঃ “আল্লাহ্ তা'য়ালা ইরশাদ করেন : সে (সায়িম) আমার জন্য তার খাওয়া-দাওয়া, পানীয় পান, কামাচার প্রভৃতি পরিত্যাগ করে, সিয়াম আমারই জন্য এবং আমি নিজেই তার প্রতিদান দেবো। (বুখারী শরীফ) “
আল্লাহপাক স্বয়ং এর প্রতিদান দিবেন। শুধু ৭০ গুণ কেন ৭০০০ গুণ বা ৭ লক্ষ বেশি প্রতিদান দিলেও আল্লাহর ভান্ডারের কমতি হবে না।
হাদীসে বলা হয়েছে : রোযা মানুষের জন্য ঢাল স্বরূপ। যুদ্ধের ময়দানে ঢাল যেমন প্রতিপক্ষের আঘাত কে প্রতিহত করে। রোযাও ঠিক তেমনি আমাদের বাস্তব জীবনে শয়তানের কুমন্ত্রনা থেকে ফিরিয়ে রাখে। তাই নিছক উপবাস থাকার নাম রোযা বা সিয়াম পালন নয়। সিয়াম হচ্ছে আল্লাহভীতি বা তাকওয়া অর্জন করার প্র্যাকটিস। একমাত্র আল্লাহকে ভয় করে সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌনসম্ভোগ বর্জন করে ইসলামের অন্যান্য সকল বিধিবিধান পালন করা, সকল অন্যায়, পাপাচার বর্জন করা ও যাবতীয় কু-প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয়ী হওয়ার নামই সিয়াম।
হাদীসে সুন্দর ভাবে বলা হয়েছেঃ “যে ব্যত্তি রোযা রাখা সত্ত্বেও মিথ্যা কথা নিষিদ্ধ কাজ ত্যাগ করতে পারলো না, অযথা তার পানাহার বর্জন করে উপবাস থাকার আল্লাহ তা'য়ালার কোনো প্রয়োজন নেই। (বুখারী )”
রমাদ্বান পবিত্র কোরআন অবতীর্ণের মাস। এ মাসেই বিশ্বমানবতার মুক্তির সনদ, চিরন্তন, শাশ্বত, সর্বজনীন জীবনবিধান, কল্যাণ ও সফলতার একমাত্র চাবিকাঠি কোরআনুল কারিম অবতরণ করা হয়। এ প্রসঙ্গে স্বয়ং আল্লাহু সুবাহানাহু তায়ালা বলেন, ‘এই রমজান মাসেই কুরআন নাজিল করা হয়েছিল’(সূরা আল বাকারাহ : ১৮৫)।
রমাদ্বানের মধ্যেই রয়েছে হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ‘লাইলাতুল কদর’। পবিত্র কোরআনুল কারিমে বলা হয়েছেঃ
سْمِ اللَّـهِ الرَّحْمَـٰنِ الرَّحِيمِ সরল অর্থঃ
إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ ﴿١﴾ وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ ﴿٢﴾ لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ ﴿٣﴾ تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمْرٍ ﴿٤﴾ سَلَامٌ هِيَ حَتَّىٰ مَطْلَعِ الْفَجْرِ ﴿٥﴾ সরল অর্থঃ রাহমান, রহীম আল্লাহর নামে। ১- নিশ্চয়ই আমরা কোরআন নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে। ২- আর আপনাকে কিসে জানাবে "লাইতুল কদর কী? ৩- "লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। ৪- সে রাতে ফিরিশতাগণ ও রুহ নাযিল হয় তাদের রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে। ৫- শান্তিময় সে রাত ফজরের আবির্ভাব পর্যন্ত। :কোরআনুল কারীম (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর থেকে)
রমাদ্বান শুধু ইবাদতের মাসই নয় শিক্ষা গ্রহণের মাসও বটে। রাসূল (সঃ) এর জীবনী পড়ে পড়ে ও সাহাবা (রাযিঃ)গণের জীবনী পড়ে পড়ে শিক্ষা নিয়ে আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন
করা ও আগামির জন্য সঠিক ইসলামকে প্রচারের কাজেও নিজেদেরকে পরিচালিত করা। শুধুমাত্র রমাদ্বান মাসে কল্যাণকর কাজ করলে চলবেনা। সারাবছরও এর রীতি ধরে রাখতে হবে। অনেকেই রমাদ্বানে বাধ্য হয়ে দান করেন বা কারো চাপে পড়ে দান সদকাহ করেন। এটা উচিৎ নয়। আপনার আখেরাতের মুক্তির জন্য যেমনী ইবাদত করেন তেমনী দান সদকাহ করবেন একমাত্র আল্লাহ জাল্লাহ শানহুর সন্তুষ্টির শানে। আগে নিজেকে বাঁচাই সকল প্রকার ছোট ছোট গুনাহ থেকে, নিজের চোখকে বাঁচাই, নিজেকে বাঁচাই ও নিজের পরিবারের সকলকে বাঁচাতে ট্রাই করি।
সবাইকে ক্ষমা করি ও ক্ষমা চেয়ে নেই। কারো সাথে কোন ব্যপারে মনো-মালিন্যভাব থাকলে শুধুমাত্র আল্লাহর ভালোবাসার জন্য তা ঠিক করে নেই। আত্মীয়-স্বজনদের কারো সাথে কোন সম্পর্কের সমস্যা থাকলেও তা ঠিক করে নেই আল্লাহর ভালোবাসা পাবার আশে। এরমাদ্বান মাসে বেশী তাফসীর পড়ি কোরআন বুঝতে চেষ্টা করি, বেশী বেশী হাদীস পড়ি ও হাদীস বুঝার চেষ্টা করি আর সে মতেই জীবন গড়ি। আর যে যেখানে আছেন সেখানে থেকেই ইসলামের সঠিক বিধান প্রচার করি। আমাদের সংসার থেকে সমাজে ও সমাজ থেকে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে পৌছে দেই রমাদ্বানের প্রকৃত ও কল্যাণময় পয়গম, দান সদকাহ করি এভাবে যেন সে আগামিতে নিজেও মানুষকে দান সদকাহ করতে পারে।
কোরআন অধ্যয়ন করি বেশী বেশী। কেননা হাদীসে আছে, আনাস বিন মালিক (রাঃ) বর্ণনা করেছেন
রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, কতক লোক আল্লাহ্র পরিজন। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ্র রাসূলাল্লাহ (সঃ)! তারা কারা? তিনি বলেন, কোরআন তিলাওয়াতকারীগণ আল্লাহ্র পরিজন এবং তাঁর বিশেষ বান্দা। [২১৩]
সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ২১৫
আর সম্পূর্ণ ত্রুটি মুক্ত রোজা রাখার চেষ্টা করি। কেননা হাদীসে আছে, সাহ্ল বিন সা’দ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, জান্নাতের একটি দরজার নাম ‘রাইয়ান’। কিয়ামাতের দিন সেখান থেকে আহ্বান করা হবেঃ রোযাদারগণ কোথায়? যে ব্যক্তি রোযাদার হবে, সে উক্ত দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে এবং যে উক্ত দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে, সে কখনও পিপাসার্ত হবে না। [১৬৪০]
সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১৬৪০
যারা কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা দেহকে ক্ষুধার্থ রেখে তার আত্নাকে খাবার দিয়ে তার নফসকে ‘মুতমাইন্নাহ’পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছ তাদের সম্পকে আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেন “ হে প্রশান্ত মন তুমি তোমার পালন কর্তার নিকটে ফিরে যাও সন্তূষ্ট ও সন্তষভাজন হয়ে। অতঃপর আমার বান্দাদের অর্ন্তভুক্ত হয়ে যাও। এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর। (৮৯- ২৭--৩০) ।
পরিশেষে মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে তার প্রিয়পাত্র-পাত্রি বানিয়ে নিন। শুধু রমাদ্বান মাস নয়, সারা বছর নয় জীবনের বাকিদিনগুলো আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা-বান্দি হয়ে পৃথিবীতে থাকতে পারি ও প্রকৃত মু'মিন হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করে আল্লাহর সান্নিধ্যে যেতে পারি মহান আল্লাহ আমাদের কবুল করে নিন। আমিন।
@@ মাহে রমজানের উপকারিতা - বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ।
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলীর এক গবেষনায় দেখা গেছে যে রোজা রাখার (ফাস্টিং) ফলে তা স্বাস্থ্যের জন্য বিভিন্ন উপকার বয়ে আনে। যেমনঃ
১/ ক্যান্সারের ঝুকি কমে যাওয়া।
২/ বুড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটিকে মন্থর করে দেওয়া এবং জীবনচক্রটিকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে বাড়িয়ে দেওয়া।
৩/
অর্গানিজমের জীবনচক্রটিকে (লাইফ স্পান) বাড়িয়ে দেওয়ার একমাত্র প্রমানিত পদ্ধতি হলো কম ক্যালরী গ্রহন করা।
ক্যালরী রেসট্রিকসন ডায়েটের মত রোজাও ক্যালরী গ্রহনকে কমাতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। এটি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এজিং এর নিউরোসাইন্সের যে ল্যাবরেটরি রয়েছে তার প্রধান প্যাটারসনের অভিমত।
ন্যাশনাল একাডেমি অব সাইন্সের মতে রোজা (ফাস্টিং) রাখার মধ্যে অন্যান্য উপকার হল গিয়ে স্ট্রেস রেজিস্ট্যান্স বা স্ট্রেস কমিয়ে দেয়া ইনস্যুলিন সেনসিটিভি বাড়িয়ে দেওয়া মরবিডিটি ( morbidity) কমিয়ে দেওয়া এবং আবার জীবনচক্র বা লাইফস্প্যান বাড়িয়ে দেওয়া।
একজন সুস্থ্য মানুষ রোজা রাখলে তা স্বাস্থ্যের জন্য সুফল বয়ে আনে।
৪/
রোজা একটি কার্যকরী ডিটোক্সিফিকেশন থেরাপি। যার ফলে শরীরে জমে থাকা বিষাক্ত পদার্থ গুলি ভেঙে পরে শরীর থেকে বেরিয়ে আসে।
যাদের শরীরের ওজন বেশি এবং যাদের কম, উভয়ের জন্যই রোজার উপকারিতা রয়েছে। এটা সহজেই অনুমেয় যে রোজা শরীরের ওজন কমায়। রোজার সময়টুকুতে শরীরে জমে থাকা চর্বি গুলো ব্যবহৃত হয়, পুড়ে নি:ষেশিত হয় এবং এইভাবে শরীরের ওজন কমে যায়।
৫/
যাদের শরীরের ওজন কম রোজা রাখার ফলে তাদের হজমের প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক হয়ে আসে। রোজা রাখার ফলে তারা যে খাদ্য খায় তা হজম করতে ও তার থেকে পুষ্টিকে গ্রহন করার জন্য শরীর তৈরি হয়ে উঠে।
৬/ রোজা অনেক ধরনের চর্ম রোগের সমস্যা থেকে আমাদের মুক্তি দেয়। এটি হয়ে থাকে শরীর থেকে বিষাক্ত দ্রব্যগুলো বেরিয়ে যাওয়ার ফলে এবং রক্ত পরিশুদ্ধ হওয়ার ফলে।
৭/ রোজা সিগারেট এবং মদের মত অনেক ধরনের আসক্তি থেকেও আমাদের মুক্তি দিতে পারে।
এছাড়া পুরোপুরি অভুক্ত থাকার প্রধান সমস্যার দুটি হলঃ হাইপোকালেমিয়া এবং কার্ডিয়াক এরিথমিয়া। প্রথমটিতে রক্তে পটাসিয়ামের লেভেল অনেকটা নীচে নেমে যায় আর দ্বিতীয়টিতে হার্টবিট অস্বাভাবিক হয়ে পরে। কিন্তু রোজা টোটাল ফাস্টিং নয়, রোজাদারেরা নিয়ম করে ইফতার এবং সেহেরীর সময় খাদ্য গ্রহন করে থাকেন।
রক্তে সুগারের যে ঘাটতি দেখা দেয় তাও পুরন হয়ে যায়।
অতএব এব্যাপারে কোন মতভেদ নেই যে, রোজা একজন সুস্থ্য মানুষের স্বাস্থ্যের আরো উন্নতি ঘটায়। কিন্তু যারা অসুখ বিসুখে ভুগছেন তাদের ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে রোজা রাখা উচিত।
(লেখার নিচের অংশটুকু সংগৃহীত)
বিষয়: বিবিধ
১৩০১ বার পঠিত, ২৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মাশাআল্লাহ একটি লিখায় অনেক বিষয় অতি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছো।
স্বাস্থ্যগত বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে সন্নিবেশিত হয়েছে।
আশাকরি সবার জন্য উপকারী লিখাগুলো পড়ে সকলেই উপকৃত হবেন।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আর রোজা রাখার সায়েন্টিফিক বিষয়টার অনেকটাই আমার জানা ছিলোনা। উপকৃত হলাম। জাজাকাল্লাহ।
আমি খাদক লোক কিন্তু রোজায় অআমার ভালো লাগছে। ক্ষুধা পিপাসা লাগলেও বুঝতে পারছি শরীরের অনেক লাভ হচ্ছে
মহান আল্লাহ এভাবেই মানুষকে সবর শক্তি দান করেন।
জাযাকুমুল্লাহ পড়ে মন্তব্য করার জন্য।
ছুম্মা আমিন।
ছুম্মা আমিন।
অনেক অনেক শুকরিয়া, জাযাকিল্লাহ খাইর
মন্তব্য করতে লগইন করুন