"রমাদ্বান উপলক্ষ্যে ব্লগ আয়োজনের প্রস্তুতি ও বিষয়ে একটি ছোট্ট শিক্ষনীয় ঘটনাঃ কালো বাঁদী! "
লিখেছেন লিখেছেন মাহবুবা সুলতানা লায়লা ০২ জুন, ২০১৬, ০৮:০১:৫০ রাত
নিঝুম রাত অন্ধকার পৃথিবী! এপৃথিবীতে এখন গুটি কয়েকজন মানুষ ছাড়া বেশির ভাগই নিজেকে সপে দিয়েছে ঘুমের কোলে! মাঝে মাঝে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় নানা রকম প্রশ্ন এসে মনের মাঝে ভীড় করে! আসলে আমরা মানুষ আল্লাহকে কতটা ভয় করি? কতটা তাকে মেনে চলি? জীবনের বাঁকে বাঁকে কতটাই বা তার নির্ধারিত পথে চলতে ট্রাই করি! কখনো কখনো মনের পাতায় ভেসে ওঠে নিজ জীবনের চিত্র! কি করেছি? কি উপায় হবে অবশেষে? কি জবাব দেব সেই মহান সত্তার কাছে? মনের মাঝে নানা হতাশার উদয় হয়! আজও মনে পড়ছে নানা রকম কথা! আসলে কি জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পেরেছি? জীবনের বাঁকে বাঁকে কত যে ভুল করেছি তার হিসেব কখনো করিনি! যখন হিসাবের খাতাটা খুলেছি তখন দেখি নেকের সে পাতা শূন্যই রয়ে গেছে! মনে পড়ছে ছোট্ট বেলায় আরবী শিক্ষকের নিকট শুনে ছিলাম এক কালো বাঁদীর গল্প! আজকে হঠাৎ মনে পড়ে সেই কথা। ঘটনা বলা উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হলো ঘটনা থেকে কিছু শিখা ও শেয়ার করা।
ذَلِكَ الْكِتبُ لاَرَيْبَ فِيْهِ هُدًى لِّلْمُتَّقِيْنَ الَّذِيْنَ يُؤِْنُوْنَ بِالْغِيْبِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلوةَ وَمِمَّا رَزَقْنَهُمْ يُنْفِقُوْنَ البقرة:
এ কোরআন আল্লাহর কিতাব এতে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। এটা পরেহযগার, আল্লাহ ভীরু লোকেদরকে দুনিয়ার জীবেনর সঠিক ও সোজা পথ প্রদশর্ন করে। পরেহযগার তারাই যারা অদৃ্শ্যকে বিশ্বাস করে, নামায কায়েম করে, এবং আমরা তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে।
সূরা আল বাকারা: ২-৩
اُوْآئِكَ عَلى هُدًى مِّنْ رَّبِهِمْ وَاُولئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ البقرة : 5
বস্তুত এরাই রব প্রদত্ত হেদায়াত লাভ করেছে এবং এরাই সফলকাম।
সূরা আল বাকারা : ৫
ঘটনাঃ কোন একদেশের বাদশাহ তার কালো বাঁদীর প্রসংশায় পঞ্চমুখ। আর এখবর বাতাসের গতিতে ছড়িয়ে যায় অন্যান্য দেশে। রাজা যখন সফরে যায় তখনো সবাই তার মুখে কালো বাঁদীর কথা শুনে শুনে অন্য দেশের সাত রাজাও খুবই বিরক্ত। কারন একটাই সে এতো বড় একজন বাদশাহ তার মুখে কালো বাঁদীর কথা বেমানান। তাও আবার আরেক বাদশাহের দরবারে বসে সত্যিই এই রাজা পাগল হয়ে গেছে। তখন অন্যান্য রাজাগণ তাকে পরামর্শ দিলো আপনি এতবড় মানের একজন রাজা আপনার মুখে ছোটজাতের একজন কালো বাঁদীর কথা মানায় না। শুনে তো বাদশাহ মুখ কালো করে সেখান থেকে চলে আসলো। নিজ দেশে এসে দূত পাঠালো অন্য সাত রাজাকে তাদের স্ত্রীসহকারে দাওয়াত করে।
যদিও সবাই তার কাজে খুবই বিরক্ত তথাপি রাজা বলে কথা সবাই সময়মত উপস্থিত হলো কালো বাঁদীর প্রেমীকের দরবারে। রাজা সবাইকে খুব করে আপ্যায়ন করালো। এরপর বিশ্রামের জন্য সবাই বসলে রাজা কালো বাঁদীর গল্প বলা শুরু করলোঃ একদিন আমার শখ হলো আমার রাজকোষ তো ধন-রত্নে ভরপুর তাই আমি আমার রাজ্যের সবার জন্য একদিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমার রাজকোষ উম্মুক্ত করে দিলাম। সবাই যে যার প্রয়োজন মতো রত্নভান্ডার থেকে ধন-রত্ন নিতে থাকলো কিন্তু আমার কালো বাঁদী আমার পাশে বসে বসে আমাকে পাখা করলে লাগলো আমি তার দিকে খেয়াল করে বললাম তুমিও যাও তোমার প্রয়োজন মতো কিছু নিয়ে নাও। সে আমাকে যা বলল আমি তাতে তার প্রতি খুবই সন্তুষ্ট। তার এসবগুণ শুনলে আপনারাও তার প্রতি আসক্ত হবেন বলে............কিছুক্ষন সময় রাজা চুপ থাকলো।
এবার প্রসংঙ্গ পরিবর্তন করে বলল; আজকের সম্মানিত উপস্থিতি আপনারা আমার মেহমান আর আমি এই রাজ দরবারে আজকে কালো বাঁদীর একটি গুণ প্রকাশ করবো আর এরপর আপনারাই বিচার করবেন আমি ভুল করেছি কিনা। রাজা এই বলেই তার উজীর-নাজীরকে আদেশ করলো সবার হাতে একটি করে স্বর্নের পেয়ালা দিতে সাত রাজা ও সাত রানীর হাতে চৌদ্দটি পেয়ালা দেয়া হলো আর কালো বাঁদীর হাতেও একটি স্বর্নের পেয়ালা দেয়া হলো। এবার রাজা মশাই সবাইকে আদেশ দিলেন আপনারা আপনাদের হাতের পেয়ালাটি আমি আদেশ করার সাথে সাথে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলবেন, রাজা আদেশ করলো এখন সবাই ভাঙো। বলার সাথে সাথে কালো বাঁদী তার হাতের পেয়ালাটি আছাড় মেরে ভেঙে ফেললো। আর অন্যান্য রাজা ও রানীরা চিন্তা করলো আরে ওর মাথা গেছে কালো বাঁদীর খপ্পরে পড়ে। নয়তো এত সুন্দর স্বর্নের কারুকাজ করা পেয়ালা কেউ ভাঙতে বলে? এসব চিন্তা থেকে কেউই তা ভাঙলো না। শুধামাত্র কালো বাঁদীই রাজার হুকুম মান্য করলো।
রাজা এবার সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল; বুঝেছেন সম্মানিত মহোদয়? আপনাদের কি বিবেগ কি জাগ্রত হয়েছে কেন আমি কালো বাঁদীর জন্য পাগল? তারা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওই করলো কেউই কিছু বললোনা। রাজা বলতে থাকলেন, দেখুন আমি আপনাদের সবাইকেই আদেশ করেছি পেয়ালাটি ভেঙে ফেলতে কিন্তু আপনারা কেউই আমার আদেশ পালন করেন নি। কিন্তু আমি আদেশ করার সাথে সাথে কালো বাঁদী তা মান্য করলো। আর আপনারা অমান্য করে অপরাধী হলেন। আমি কালো বাঁদীকে নয় তার গুণকে ভালোবাসি। অন্যান্য রাজার চোখ খুলে গেলো আসলেই তো আমরা পেয়ালার মূল্য নিয়ে ভাবছি আর কালো বাঁদী রাজার কথার মূল্যায়ন করছে তাহলে তো সে সত্যিই অনেক জ্ঞানের অধিকারী। তারা নিজেরদের ভুল বুঝতে পেরে রাজার কাছে ভুল স্বীকার করলো। তখন রাজা বললেন শুনুন; সেদিন যেদিন রাজকোষ উম্মুক্ত হলো সেদিন কালোবাঁদী ইচ্ছে করলে অনেক ধন-রত্ন নিয়ে চলে যেতে পারতো কিন্তু সে তা করেনি। সে আমার সেবায় নিয়োজিত ছিল।
যখন আমি তাকে বললাম তুমিও তো এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারো। যাও সূর্য ডুবতে বসেছে তখন সে বলল আমি আপনার নূন খেয়েছি তাই আমি আপনাকে ছেড়ে যেতে পারবোনা। তখন আমি নিজেই তাকে কিছু ধন-রত্ন এনে দেবার জন্য উঠতে গেলে সে বললঃ "রাজা যদি আমার হয় রাজ্য কি আর দুরে রয়"? তখন আমি খেয়াল করলাম আমার উজীর-নাজীর সবাই আমার কথা না ভেবে যে যার ইচ্ছে মতো ধন-রত্ন নিয়ে চলে গেলো। যাওয়ার সময় কেউই আমার কথা ভাবলো না নিজেদের কোষাগার পূর্ণ করতেই তারা ব্যস্ত। শুধুমাত্র কালোবাঁদী আমার কষ্টের কথা ভেবে আমাকে ছেড়ে যায়নি। তাই সেদিন থেকে আমি চিন্তা করেছি আমার উপযুক্ত সাথীই হলো কালোবাঁদী আজ থেকে আমি ঘোসনা দিলাম কালোবাঁদীই এরাজ্যের মহা রানী। তখন উপস্থিত সবাই বলল হাঁ আপনার সিদ্ধান্ত সঠিক রাজামহোদয়।
শিক্ষনীয়ঃ রাজার আদেশ পাল করে কালোবাঁদী হয়ে গেলো রাজরানী। আমরা মানুষও যদি মহা মহিমাময় আল্লাহর আদেশ মতো কার্য সম্পাদন করতে পারি তবে আমরাও হয়ে যাবো জান্নাতের মালিকিনি। আমাদের সমস্যা হলো আমরা মহান আল্লাহর একটি আদেশ মানি তো আরেকটির খবরও রাখিনা। আবার যারা মানি তাদের অনেকেই অলসতার সাথে মানি। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তার দ্বীনের সবটুকুকেই মেনে চলার তৌফিক দান করুন।
সিয়াম সাধনার ফজিলতসমূহ :
এক. আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিজের সাথে সিয়ামের সম্পর্ক ঘোষণা করেছেন। এমনিভাবে তিনি সকল ইবাদত-বন্দেগি থেকে সিয়ামকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছেন। যেমন তিনি এক হাদিসে কুদসিতে বলেন :—
كل عمل ابن آدم لـه إلا الصيام، فإنه لي وأنا أجزى به. رواه مسلم
মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্য, কিন্তু সিয়াম শুধু আমার জন্য, আমিই তার প্রতিদান দেব। (মুসলিম)
এ হাদিস দ্বারা আমরা অনুধাবন করতে পারি নেক আমলের মাঝে সিয়াম পালনের গুরুত্ব আল্লাহর কাছে কত বেশি। তাই সাহাবি আবু হুরায়রা (রাযিঃ) যখন বলেছিলেন -
يا رسول الله مرني بعمل، قال عليك بالصوم فإنه لا عدل لـه. رواه النسائي
হে রাসূলুল্লাহ (সঃ)! আমাকে অতি উত্তম কোন নেক আমলের নির্দেশ দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তুমি সিয়াম পালন করবে। মনে রেখ এর সমমর্যাদার কোন আমল নেই। (নাসায়ি)
সিয়ামের এত মর্যাদার কারণ কী তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ভাল জানেন। তবে, আমরা যা দেখি তা হল, সিয়াম এমন একটি আমল যাতে লোক দেখানো ভাব থাকে না। বান্দা ও আল্লাহ তা'আলার মধ্যকার একটি অতি গোপন বিষয়। সালাত, হজ্জ, যাকাত সহ অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগি কে করল তা দেখা যায়। পরিত্যাগ করলেও বুঝা যায়। কিন্তু সিয়াম পালনে লোক দেখানো বা শোনানোর ভাবনা থাকে না। ফলে সিয়ামের মধ্যে এখলাস বা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতা নির্ভেজাল ও বেশি থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন :—
يدع شهوته وطعامه من أجلي
সিয়াম পালনকারী আমার জন্যই পানাহার ও যৌনতা পরিহার করে। তাই সিয়াম পালনকারী আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্য কিছুর আশা করে না।
দুই. সিয়াম আদায়কারী বিনা হিসাবে প্রতিদান লাভ করে থাকেন। কিন্তু অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগি ও সৎ কর্মের প্রতিদান বিনা হিসাবে দেয়া হয় না। বরং প্রত্যেকটি নেক আমলের পরিবর্তে আমলকারীকে দশ গুণ থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত প্রতিদান দেয়া হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
كل عمل ابن آدم يضاعف الحسنة بعشر أمثالـها إلى سبع مئة ضعف. قال الله عز وجل: ( إلا الصوم فإنه لي وأنا أجزى به . . .
মানব সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের প্রতিদান দশ থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ তা'আলা বলেন-কিন্তু সিয়ামের বিষয়টা ভিন্ন। কেননা সিয়াম শুধু আমার জন্য আমিই তার প্রতিদান দেব। বর্ণনায় : মুসলিম
সারা জাহানের সর্বশক্তিমান প্রতিপালক আল্লাহ নিজেই যখন এর পুরষ্কার দেবেন তখন কি পরিমাণে দেবেন? ইমাম আওজায়ী (রহঃ) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেছেন, আল্লাহ যে সিয়াম আদায় কারীকে প্রতিদান দেবেন তা মাপা হবে না, ওজন করা হবে না।
তিন. সিয়াম ঢাল ও কুপ্রবৃত্তি থেকে সুরক্ষা: সিয়াম পালনের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কু-প্রবৃত্তি থেকে বেঁচে থাকার দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন :—
يا معشر الشباب! من استطاع منكم الباءة فليتزوج، فإنه أغض للبصر، وأحصن للفرج، ومن لم يستطع فعليه بالصوم، فإنه له وجاء. متفق عليه
হে যুবকেরা ! তোমাদের মধ্যে যে সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে। কেননা বিবাহ দৃষ্টি ও লজ্জাস্থানের সুরক্ষা দেয়। আর যে বিবাহের সামর্থ্য রাখে না সে যেন সিয়াম পালন করে। কারণ এটা তার রক্ষা কবচ। বর্ণনায় : (বুখারি ও মুসলিম
এমনিভাবে সিয়াম সকল অশ্লীলতা ও অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত রাখে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
والصيام جنة، فإذا كان يوم صوم أحدكم فلا يرفث يومئذ ولا يصخب، فإن سابه أحد أو قاتله فليقل إني امرأ صائم. رواه مسلم
সিয়াম হল ঢাল। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে সিয়াম পালন করবে সে যেন অশ্লীল আচরণ ও শোরগোল থেকে বিরত থাকে। যদি তার সাথে কেউ ঝগড়া বিবাদ কিংবা মারামারিতে লিপ্ত হতে চায় তবে তাকে বলে দেবে আমি সিয়াম পালনকারী। বর্ণনায় : মুসলিম
সিয়াম পালনকারী যেমনি নিজের অন্তরকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তেমনি সকল অশ্লীল আচরণ, ঝগড়া-বিবাদ, অনর্থক কথা ও কাজ থেকে নিজের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে হেফাজত করবে।
চার. সিয়াম জাহান্নাম থেকে বাঁচার ঢাল। যেমন হাদিসে এসেছে -
الصيام جنة، وحصن حصين من النار. رواه أحمد
সিয়াম হল ঢাল ও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার মজবুত দুর্গ। বর্ণনায় : আহমদ। বোখারি ও মুসলিমের হাদিসে এসেছে -
من صام يوما في سبيل الله باعد الله وجهه عن النار سبعين خريفا. رواه مسلم
যে ব্যক্তি একদিন আল্লাহর পথে সিয়াম পালন করবে আল্লাহ তার থেকে জাহান্নামকে এক খরিফ (সত্তুর বছরের) দুরত্বে সরিয়ে দেবেন। বর্ণনায়: মুসলিম
উলামায়ে কেরাম বলেছেন, আল্লাহর পথে সিয়াম পালনের অর্থ হল: শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সিয়াম পালন করা। এমনিভাবে আল্লাহ তাআলা বহু সিয়াম পালনকারীকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। যেমন হাদিসে এসেছে -
إن لله تعالى عند كل فطر عتقاء من النار، وذلك كل ليلة. رواه أحمد
ইফতারের সময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বহু লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। আর এটা রমাদ্বানের প্রতি রাতে। বর্ণনায় : আহমদ
পাঁচ. সিয়াম হল জান্নাত লাভের পথ। হাদীসে এসেছে -
عن أبي هريرة رضي الله عنه أنه قال: يا رسول الله مرني بأمر ينفعني الله به، قال: عليك بالصوم فإنه لا مثل له. رواه النسائي
আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ), আমাকে এমন একটি কাজের নির্দেশ দিন যার দ্বারা আমি লাভবান হতে পারি। তিনি বললেন : তুমি সিয়াম পালন করবে। কেননা, এর সমকক্ষ কোন কাজ নেই। বর্ণনায় : নাসায়ি
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের জন্য সিয়ামের সাথে কোন আমলের তুলনা হয় না। সিয়াম পালনকারীদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহের আরেকটি দৃষ্টান্ত হল তিনি সিয়াম পালনকারীদের জন্য জান্নাতে একটি দরজা নির্দিষ্ট করে দেন। যে দরজা দিয়ে সিয়াম পালনকারীরা ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশ করবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
إن في الجنة بابا يقال له الريان، يدخل منه الصائمون يوم القيامة لا يدخل منه أحد غيرهم، يقال: أين الصائمون ؟ فيقومون لا يدخل منه أحد غيرهم، فإذا دخلوا أغلق، فلم يدخل منه أحد. متفق عليه
জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে; যার নাম রাইয়ান। কেয়ামতের দিন সিয়াম পালনকারীরাই শুধু সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। তাদের ছাড়া অন্য কেউ সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। সেদিন ঘোষণা করা হবে, সিয়াম পালনকারীরা কোথায় ? তখন তারা দাঁড়িয়ে যাবে সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করার জন্য। যখন তারা প্রবেশ করবে দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে ফলে তারা ব্যতীত অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। বর্ণনায় : বোখারি ও মুসলিম
ছয়. সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের চেয়েও উত্তম। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :—
والذي نفس محمد بيده لخلوف فم الصائم أطيب عند الله من ريح المسك. رواه الشيخان
যার হাতে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবন সে সত্তার শপথ, সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহ তাআলার কাছে মেশকের ঘ্রাণ হতেও প্রিয়। বর্ণনায় : বোখারি ও মুসলিম। মুখের গন্ধ বলতে পেট খালি থাকার কারণে যে গন্ধ আসে সেটাকে বুঝায়। দাঁত অপরিষ্কার থাকার কারণে যে গন্ধ সেটা নয়।
সাত. সিয়াম ইহকাল ও পরকালের সাফল্যের মাধ্যম। যেমন হাদিসে এসেছে -
للصائم فرحتان: فرحة عند فطره، وفرحة عند لقاء ربه. متفق عليه
সিয়াম পালনকারীর জন্য দুটি আনন্দ : একটি হল ইফতারের সময় অন্যটি তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের সময়। বর্ণনায় : বোখারি ও মুসলিম
ইফতারের সময় আনন্দ হল এ কারণে যে সিয়াম পূর্ণ করতে পারল ও খাবার-দাবারের অনুমতি পাওয়া গেল। এটা বাস্তব সম্মত আনন্দের বিষয় যা আমাদের সকলের বুঝে আসে ও অনুভব করি। অপরদিকে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের যে আনন্দ তা অনুভব করতে আমরা এখন না পারলেও কেয়ামতের দিন পারা যাবে ইনশা-আল্লাহ। যখন সকল মানুষ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহমুখী থাকবে।
আট. সিয়াম কেয়ামতের দিন সুপারিশ করবে। হাদীসে এসেছে -
عن عبد الله بن عمرو أن النبي صلى الله عليه وسلم قال: (الصيام والقرآن يشفعان للعبد يوم القيامة، يقول الصيام أي رب: منعته الطعام والشهوات بالنهار، فشفعني فيه. ويقول القرآن : منعته النوم بالليل، فشفعني فيه. قال: فيشفعان. رواه أحمد
আব্দুল্লাহ বিন আমর থেকে বর্ণিত যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: সিয়াম ও কোরআন কেয়ামতের দিন মানুষের জন্য এভাবে সুপারিশ করবে যে, সিয়াম বলবে হে প্রতিপালক! আমি দিনের বেলা তাকে পানাহার ও যৌনতা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। কোরআন বলবে হে প্রতিপালক ! আমি তাকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। তিনি বলেন, অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে। বর্ণনায় : আহমদ
নয়. সিয়াম হল গুনাহ মাফ ও গুনাহের কাফফারা। সিয়াম হল অনেকগুলো নেক আমলের সমষ্টি। আর নেক আমল পাপকে মুছে দেয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন :-
إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ (سورة هود:114)
সৎকর্ম অবশ্যই পাপসমূহ মিটিয়ে দেয়। সূরা হুদ : ১১৪
বহু হাদীস রয়েছে যা প্রমাণ করে যে, নেক আমলকে বিভিন্ন ছোট খাট পাপ সমূহের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। অর্থাৎ নেক আমলের কারণে গুনাহ সমূহ আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। যেমন হাদিসে এসেছে -
فتنة الرجل في أهله وماله وجاره تكفرها الصلاة والصيام والصدقة. رواه البخاري ومسلم
মানুষ যখন পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশী ও ধন-সম্পদের কারণে গুনাহ করে ফেলে তখন সালাত, সিয়াম, সদকা সে গুনাহগুলোকে মিটিয়ে দেয়। বর্ণনায় : বোখারি ও মুসলিম
আর রমাদ্বান তো গুনাহ মাফ ও মিটিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে আরো বেশি সুযোগ দিয়েছে। হাদিসে এসেছে -
من صام رمضان إيمانا واحتسابا غفر لـه ما تقدم من ذنبه. رواه الشيخان
যে রমাদ্বান মাসে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে সিয়াম পালন করবে তার অতীতের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। বর্ণনায় : বোখারি ও মুসলিম
ইহতিসাবের অর্থ হল আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার পাওয়া যাবে এ দৃঢ় বিশ্বাস রেখে নিষ্ঠার সাথে সন্তুষ্টচিত্তে আদায় করা। হাদিসে আরো এসেছে -
الصلوات الخمس والجمعة إلى الجمعة ورمضان إلى رمضان مكفرات لما بينهن إذا اجتنبت الكبائر. رواه مسلم
পাঁচ ওয়াক্ত সালাত এর মধ্যবর্তী সময় ও এক জুমআ থেকে অপর জুমআও এক রমজান থেকে অপর রমজানের মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে সে সকল পাপ হয়ে যায় তার কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত) হিসেবে সালাতকে গ্রহণ করা হয়, যদি কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা যায়। সিয়াম ছোট পাপগুলোকে মিটিয়ে দেয় আর তাওবা করলে কবিরা গুনাহ মাফ করা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন :—
إِنْ تَجْتَنِبُوا كَبَائِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَنُدْخِلْكُمْ مُدْخَلًا كَرِيمًا( النساء :31)
তোমাদেরকে যা নিষেধ করা হয়েছে তার মধ্যে যা গুরুতর তা হতে বিরত থাকলে তোমাদের লঘুতর পাপগুলো ক্ষমা করে দেব। এবং তোমাদের সম্মানজনক স্থানে প্রবেশ করাব। সূরা নিসা : ৩১
এ আয়াত ও হাদিস দুটো দ্বারা প্রমাণিত হল আল্লাহর পক্ষ থেকে যে ক্ষমার ওয়াদা করা হয়েছে তা তিনটি শর্ত সাপেক্ষে।
প্রথম : রমাদ্বানের সিয়াম পালন করতে হবে ঈমানের সাথে। অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান এবং সিয়াম যে একটি ফরজ ইবাদত এর প্রতি বিশ্বাস। সিয়াম পালনকারীকে আল্লাহ যে সকল পুরস্কার দেবেন তার প্রতি বিশ্বাস রাখা।
দ্বিতীয় : সিয়াম পালন করতে হবে ইহতিসাবের সাথে। ইহতিসাব অর্থ হল আল্লাহর পক্ষ থেকে সওয়াব ও পুরষ্কারের আশা করা, তাকে সন্তুষ্ট করতেই সিয়াম পালন করা আর সিয়ামকে বোঝা মনে না করা।
তৃতীয় : কবিরা গুনাহ থেকে দূরে থাকতে হবে। কবিরা গুনাহ ঐ সকল পাপকে বলা হয় যেগুলোর ব্যাপারে ইহকালীন শাস্তির বিধান দেয়া হয়েছে, পরকালে শাস্তির ঘোষণা রয়েছে, অথবা আল্লাহর ও তার রাসূলের পক্ষ থেকে লানত (অভিসম্পাত) বা ক্রোধের ঘোষণা রয়েছে। যেমন, শিরক করা, সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পদ আত্মসাত করা, ব্যভিচার করা, জাদু-টোনা, অন্যায় হত্যা, মাতা-পিতার সাথে দুর্ব্যবহার, আত্মীয়তার সম্পর্কচ্ছেদ, মিথ্যা সাক্ষ্য, মিথ্যা মামলা, মাদক সেবন, ধোঁকাবাজি, মিথ্যা শপথ, অপবাদ দেয়া, গিবত বা পরদোষচর্চা, চোগলখোরি, সত্য গোপন করা -ইত্যাদি।
কোন ধরনের সিয়াম এ সকল ফজিলত অর্জন করতে পারে :—
যে সকল ফজিলত ও সওয়াবের কথা এতক্ষণ আলোচনা করা হল তা শুধু ঐ ব্যক্তি লাভ করবে যে নিম্নোক্ত শর্তাবলি পালন করে সিয়াম আদায় করবে।
(১) সিয়াম একমাত্র আল্লাহর জন্য আদায় করতে হবে। মানুষকে দেখানো বা শোনানো অথবা মানুষের প্রশংসা অর্জন কিংবা স্বাস্থ্যের উন্নতির নিয়তে সিয়াম আদায় করবে না।
(২) সিয়াম আদায়ের ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূলের সুন্নত অনুসরণ করতে হবে। সেহরি, ইফতার, তারাবীহসহ সকল বিষয় রাসূলের সুন্নত অনুযায়ী আদায় করতে হবে।
(৩) শুধু খাওয়া-দাওয়া ও যৌনাচার থেকে বিরত থাকলে যথেষ্ট হবে না। মিথ্যা, পরনিন্দা, অশ্লীলতা, ধোঁকাবাজি, ঝগড়া-বিবাদ সহ সকল প্রকার অবৈধ কাজ হতে বিরত থাকতে হবে। মুখ যেমন খাবার থেকে বিরত থাকে, তেমনিভাবে চোখ বিরত থাকবে অন্যায় দৃষ্টি থেকে, কান বিরত থাকবে অনর্থক কথা ও গান-বাজনা শোনা থেকে, বা বিরত থাকব অন্যায়-অসৎ পথে চলা থেকে।
সিয়াম পালনে মহান উদ্দেশ্য এটাই যে, সিয়াম পালনকারী শরিয়তের দৃষ্টিতে সকল প্রকার অন্যায় ও গর্হিত আচার-আচরণ থেকে নিজেকে হেফাজত করবে। অতএব সিয়াম হল সকল ভাল বিষয় অর্জন ও অন্যায়-গর্হিত কাজ ও কথা বর্জন অনুশীলনের একটি শিক্ষালয়।তাইতো দেখা যায় রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
من لم يدع قول الزور والعمل به والجهل فليس لله حاجة أن يدع طعامه وشرابه. رواه البخاري
যে মিথ্যা কথা ও কাজ এবং মূর্খতা পরিত্যাগ করতে পারল না তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। বর্ণনায় : বোখারি
তিনি আরো বলেছেন :—
رب صائم حظه من صيامه الجوع والعطش، ورب قائم حظه من قيامه السهر. رواه أحمد
অনেক সিয়াম পালনকারী আছে যারা তাদের সিয়াম থেকে শুধু ক্ষুধা ও পিপাসা অর্জন করে। আবার অনেক সালাত আদায়কারী আছে যারা তাদের সালাত থেকে শুধু রাত-জাগা লাভ করে থাকে। (এ ছাড়া আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন প্রতিদান লাভ করে না) বর্ণনায় : আহমদ
পরিশেষেঃ মহান আল্লাহ রাহমানুর রাহীম আমাদের সকলকে মাহে রমাদ্বানের সম্মান ও গুরুত্বের প্রতি খেয়াল রেখে বেশী বেশী আমলে ছলীহা করার তৌফিক দিন। আর তার প্রিয় বান্দা-বান্দিদের সাথে শামিল করুন। আর আমাদের সকলের অন্তরকে কলুষতা মুক্ত করে বেশী বেশী দান ছদকাহ করার তৌফিক দিন। আমরাও যেন নবী (সঃ) এর পরিবারের কণ্যাদের সাথে আপনার সামনে দাড়াতে পারি সম্মানের সাথে। আমিন ইয়া রব্ব।
বিষয়: বিবিধ
১৫৫৭ বার পঠিত, ৩১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
গাজী সালাউদ্দিন ভাই আমাকে বলেছিলেন বাংলাদেশ টাইম ৭টায় আমার লিখা পোষ্ট করতে। আমি ভাবলাম হয়তো উনি কোন লিখা পোস্ট করবেন, তখন আমি ঐ লিখার মন্তব্যে আমার লিখাটা পোস্ট করবো, কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কারো উপস্থিতি না পেয়ে আমি আমার ব্লগেই লিখাটা পোস্ট করেছি। আসলে আমি আগে কখনো এই ধরণের আড্ডায় অংশগ্রহণ করিনি।
লোকজনে পরামর্শ দেয়, আমি সে মোতাবেক কাজ করি। এইবার যেভাবে হয়েছে, সেটা আপনার. আফরা আপুর পরামর্শেই হয়েছে। পরিচালকের পোস্ট হবে আজকে।
অনেক সুন্দর হয়েছে আপু ।জাজাকিল্লাহ খায়ের ।
মা শা আল্লাহ....
জাযাকিল্লাহ
এটা অনেকেই জানেন না, এবং সে কারণেই মানেন না, এমন কি তর্ক করতেও ছাড়েন না!!
কালো বাদীর গল্পটি থেকে আমাদের অনেক কিছুই শিখার এবং পালন করার শিক্ষা পাওয়া যায় মাশাআল্লাহ।
পাশাপাশি সুন্দর সুন্দর উদ্ধৃতিগুলো প্রাণ ছুঁয়ে দিলো আপু।
সব মিলিয়ে ভীষণ ভালো লাগলো লিখাটি। জাজাকাল্লাহু খাইর।
শিক্ষনীয় পোস্ট আলহামদুলিল্লাহ।
জাযাকিল্লাহ খাইর।
বুবু, আমি বিয়েই করব। রোজা রাখতে কষ্ট লাগে।
ঠিক বলেছেন, রোজা রাখার উদ্দেশ্য স্বাস্থ্য ঠিক রাখা, লোকের কাছে পাক্কা রোজাদার হওয়া নয়, বরং খোদাভীতি অর্জন করা।
শিক্ষণীয় একটা গল্প,
আসলে আমাদের কাছে, মহান আল্লাহর আদেশ পালন করার চেয়ে, দুনিয়ার মূল্য অনেক বেশি
মন্তব্য করতে লগইন করুন