"বন্ধুত্ব"
লিখেছেন লিখেছেন মাহবুবা সুলতানা লায়লা ১৮ মে, ২০১৬, ০১:২২:৫২ দুপুর
"বন্ধু দিবসের পথ চলা যেভাবে শুরু" ইতিহাস মতে বন্ধু দিবসের শুরু হয় ১৯৩৫ সাল থেকে। ১৯৩৫ সালে আমেরিকান সরকারের কারণে একজন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেন। আর এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ঠিক তার পরদিন সেই ব্যক্তির বন্ধুটি আত্মহত্যা করেন। ১৯৩৫ সালের সেই দিনটি ছিল আগস্ট মাসের প্রথম রবিবার। প্রিয় বন্ধুর জন্য আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার এই ঘটনাটি সেই সময় পুরোবিশ্বে তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি করে। এরপর আমেরিকান কংগ্রেস বন্ধুত্বের এই নজিরবিহীন আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে আগস্টের প্রথম রবিবারকে ‘বন্ধু দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেন। তাৎক্ষণিক ভাবেই বেশকটি দেশ এই ‘বন্ধু দিবস’কে স্বীকৃতি দিয়ে দেন। এভাবেই শুরু হয় বন্ধু দিবসের প্রচলন।
বন্ধু ছাড়া জীবন: অসম্ভবঃ
মানুষ সামাজিক জীব তাই মানুষ বন্ধু ছাড়া থাকতে পারে না। বন্ধু ও বন্ধুত্ব সমাজ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মানুষ সামাজিক জীব সুতরাং একজন সামাজিক জীবের পক্ষে কখনোই বন্ধুহীন থাকা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে আমাদের প্রত্যেকের সচেতন হওয়া দরকার। মানব জীবনের অন্য বিষয়বস্তুর মতো এ বিষয়টির ব্যাপারেও ইসলাম দিকনিদের্শনা দিয়েছে এবং ভালো, সৎ ও দ্বীনদ্বার বন্ধু নির্বাচন করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। কে হবে আপনার বন্ধু? একজন মু'মিন-মুসলমান হিসেবে বন্ধু নির্বাচন করা এবং বন্ধু হওয়ার জন্য কী কী গুণের প্রয়োজন, এসব ব্যাপারে ইসলাম আমাদের বেশ ভালো পরামর্শ দিয়েছে। বন্ধু গ্রহণ করার কথা উল্লেখ করে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা'য়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘মুমিনরা যেন অন্য মু'মিনকে ছেড়ে কোনো কাফেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করে। যারা এমনটি করবে, আল্লাহ তাদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবেন না।’ [আলে ইমরান-২৮]
আলোচ্য আয়াতটির মধ্যে যেমন বন্ধু নির্বাচনের নীতিমালা বর্ণিত হয়েছে, তেমনি ফুটে উঠেছে কাফেরকে বন্ধু হিসেবে নির্বাচন করার ভয়াবহ পরিণামের চিত্র। ভালো কিংবা মন্দ বন্ধু গ্রহণ করার পরিণাম বর্ণনা করতে গিয়ে রাসুল [সা.] বলেছেন, ‘পৃথিবীতে যার সঙ্গে যার বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা রয়েছে, পরকালে তাদের সঙ্গেই তার হাশর-বিচার হবে।’ বিখ্যাত দার্শনিক ইমাম গাজ্জালি [রহঃ] বলেছেন, ‘সবাইকে বন্ধু নির্বাচন করা যাবে না; বরং তিনটি স্বভাব যার মাঝে বিদ্যমান, এমন লোককে বন্ধু নির্বাচন করতে হবে। তিনটি গুণ হলোঃ এক. বন্ধুকে হতে হবে জ্ঞানী, বিচক্ষণ। দুই. বন্ধুর চরিত্র হতে হবে সুন্দর ও মাধুর্যময়। তিন. বন্ধুকে হতে হবে নেককার, পূণ্যবান বা পূন্যবতী।’
বন্ধুত্বও হতে পারে একটি ইবাদতঃ
মু'মিনের সব কাজই -ইবাদত। কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করাও একজন মু'মিনের নাজাতের উসিলা হতে পারে। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে কাউকে ভালোবাসল, একমাত্র তার জন্যই কাউকে ঘৃণা করল, তারই সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কাউকে দান করল এবং তা থেকে বিরত থাকল; তবে নিঃসন্দেহে সে নিজ ঈমানকে পূর্ণতা দান করল।’ [আবু দাউদ] বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে জগদ্বিখ্যাত কবি আল্লামা শেখ সাদি (রহঃ) বিখ্যাত উক্তি দিয়েছেন, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’ একজন ভালো বন্ধু যেমন মানুষের জীবনের গতি পাল্টে দিতে পারে, তেমনি একজন অসৎ বন্ধুর কারণে জীবন হয়ে যেতে পারে অন্ধকারাচ্ছন্ন ধূধূ ,মরুভূমি। তাই বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইসলাম প্রদর্শিত নির্দেশ অনুসরণ করতে হবে। এতে একদিকে যেমন নানাবিধ সমস্যা ও ভোগান্তি থেকে বেঁচে থাকা যাবে, অন্যদিকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল [সা.]-এর পথ অনুসরণ করার সাওয়াব পাওয়া যাবে।
সত্যিকারের বন্ধু ও বন্ধুত্বঃ
হযরত আলী (রাঃ) এক কবিতায় বলেন, ‘সেই তোমার সত্যিকার বন্ধু যে তোমার সঙ্গে থাকে, তোমার কল্যাণের জন্য নিজের ক্ষতি করে। দৈব-দুর্বিপাকে পড়ে তোমার অবস্থা শোচনীয় হলে সে নিজের সুখ বির্সজন দিয়ে তোমাকে সুখ দান করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বন্ধু অবশ্যই বানাও। কারণ বন্ধু দুনিয়াতেও উপকারে আসে এবং আখেরাতেও।’ হযরত ইমাম জাফর সাদেক (রঃ) বলেন; পাঁচ ব্যক্তির সঙ্গ (বন্ধুত্ব) অবলম্বন করো না। মিথ্যাবাদী, নির্বোধ, কৃপণ, কাপুরুষ ও ফাসেক ব্যক্তি। বন্ধুত্ব তৈরি মানুষের স্বভাবজাত প্রবণতা। তাই বন্ধুত্বের ব্যাপারে ইসলামে যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। বন্ধু তো বানাতে হবে তাই বলে তো যাকে তাকে বন্ধু বানানো যায় না। কারণ, জীবনে বন্ধুর প্রভাব পড়ে। একজন ভালো বন্ধু একজন খারাপ মানুষকে ভালো বানাতে সহায়ক হতে পারে পক্ষান্তরে খারাপ বন্ধু একজন ভালো মানুষকে নিয়ে যেতে পারে অধঃপতনের অতল গহ্বরে।
কোরআন-হাদীসের দিক-নির্দেশনাঃ
কোরআন ও হাদীসে বন্ধু নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা রয়েছে- সূরা আত-তাওবায় আল্লাহ বলেন; ‘আর মহান হজ্জের দিনে আল্লাহ ও তার রাসূলের পক্ষ থেকে লোকদের প্রতি ঘোষণা দেয়া হচ্ছে যে, আল্লাহ মুশরিকদের থেকে দায়িত্বমুক্ত এবং তার রাসূলও।’ সুতরাং প্রতিটি মু'মিনের ওপর আবশ্যক হলো কাফের-মুশরেকদের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করা। কেননা তিনি আরও বলেন, ‘হে মু'মিনরা! তোমরা ইয়াহুদি ও নাসারাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তারা পরষ্পরে বন্ধু।’ এ প্রসঙ্গে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘সৎসঙ্গ ও অসৎসঙ্গের উপমা হলোঃ মিশকের বাহক ও হাঁপড় ব্যবহারকারী কামার। একজন মিশকের বাহক হয়তো তোমাকে সুগন্ধি প্রদান করবে অথবা তার থেকে কিছু মিশক ক্রয় করবে। তুমি যদি মিশক না ও ক্রয় করো অবশ্যই সুগন্ধি লাভ করবে। একজন কামারের হাঁপড়ে হয়তো তোমার পোশাক ছিঁড়ে যাবে কিন্তু তুমি দুর্গন্ধ পাবে।’
আমিরুল মু'মেনিন হযরত আলী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, ‘যে ব্যক্তি চিন্তা ভাবনা করে যথাযথ বিচার-বিশ্লেষণ করে বন্ধু নির্বাচন করবে, তাদের বন্ধুত্ব বজায় থাকবে এবং তাদের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর হবে।’ হঠাৎ করে কারো সঙ্গে পরিচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে অর্থাৎ কোনোরকম বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়া বন্ধুত্ব গড়ে উঠলে অনেক সময় দুঃখজনক পরিণতি ঘটতে পারে। বন্ধু এমন একটি সম্পর্ক যা নির্বাচন করে হয় না। যাকে মন থেকে পছন্দ হয় তারাই হয় একজন আরেকজনের পরম বন্ধু। যদিও বন্ধু নির্বাচন করে হয় না তারপরও এর প্রভাব কিন্তু নির্বাচিত। একজন বন্ধুর প্রভাবে একজন মানুষ নিজেকে তার প্রতিচ্ছবি হিসাবেও দেখতে পছন্দ করে। হাজারো উপমা রয়েছে এমন, যে বন্ধুর জন্য নিজের জীবনকেও বাজি রাখতে দ্বিধা করে না মানুষ।
ইসলামের দৃষ্টিতে ভালো বন্ধুর বৈশিষ্ট্যঃ
ইসলামের দৃষ্টিতে ভালো বন্ধুর অন্যতম একটা বৈশিষ্ট্য হলো বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া। এই বিবেকবান বন্ধু সদুপদেষ্টা হয় এবং তার ওপর সব সময় আস্থা রাখা যায় কেননা এ ধরনের বন্ধু ভুলত্রুটি থেকে ফিরিয়ে রাখে। আলী (রাযিঃ) বলেছেন, বিবেকবান বন্ধুর সাহচর্য অন্তরাত্মাকে প্রাণচাঞ্চল্য দান করে। পক্ষান্তরে অজ্ঞ এবং মূর্খ বন্ধু কারো কোনো উপকার তো করেই না বরং তার কথাবার্তা আর আচার-আচরণ অন্যদের বিরক্তি আর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বন্ধুত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিষ্টাচার হচ্ছে অসুখ-বিসুখ, বিপদ-আপদেও বন্ধুত্ব অটুট রাখা। লোকমান হাকিম বলেছেন, ‘প্রয়োজনের মুহূর্ত ছাড়া বন্ধুকে চেনা যায় না।’ একজন ভালো বন্ধু পাওয়ার প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো বন্ধুত্বের সম্পর্কের মাঝে কোনো ধরনের স্বার্থ কিংবা প্রাপ্তির চিন্তা মাথায় না রাখা। আমাদের উচিত হবে জীবনের এই উজ্জ্বল সময়ে যাকে তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করা। ছাত্রছাত্রীদের জন্য ছাত্র জীবনে বন্ধু হওয়া উচিত, সৎ, বুদ্ধিমান, মেধাবী, ধৈর্যশীল, চরিত্রবান, ধার্মিক, সুন্দর মনের অধিকারী, পরোপকারী ও নিরলস। একজন ভালো বন্ধুই পারে পাল্টে দিতে আপনার জীবন, পরিবারের জীবন এমনকি সমগ্র জাতির জীবন। এই হোক বন্ধুর প্রতি বন্ধুর প্রত্যাশা। বন্ধুত্ব মানবজীবনের অপরিহার্য একটি বিষয়। সামাজিক জীব মানুষ বন্ধু ছাড়া থাকতে পারে না।
আপনার বন্ধু যদি হয় একজন মু'মিন বন্ধুঃ
@ আপনার সম্পর্ক আল্লাহ ও তার প্রিয় রাসূল (সঃ) এর সাথে করিয়ে দেবে।
@ আপনাকে কষ্ট দিবেনা। আর কোন কারনে কষ্ট পেলেও সে আপনার থেকে ক্ষমা চেয়ে নেবে।
@আপনার বিপদে হাজির হবে। আপনার অসুখে সেবা করবে।
@ আপনার খোজ-খবর নেবে।
@ আপনার অর্থোসংকটে আপনার প্রতি সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেবে।
@ আপনার আন্তরিক কষ্টের সময় আপনাকে শান্তনার কথা শুনিয়ে শান্তনা দিবে।
@ আপনার কাছ থেকে কখনোই কোন কিছু জোড় করে নেবেনা। কারন সে চিন্তা করবে জিনিসটা আপনার কতটুকুন প্রয়োজন। আর এব্যাপারে আপনাকে প্রাধান্য দিবে।
@ আপনার সবসময় ভালো ও সুন্দর পরামর্শ দিয়ে হেদায়াতের পথে চলতে সহায়তা করবে।
@ আপনার অনুপস্থিতিতে আপনার মালের রক্ষক হবে।
@ আপনার কোন বিপদ শুনলে ঝড় মাথায় করে হলেও আপনার কাছে উপস্থিত হবে। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে ভালো ও নেককার বন্ধু নির্বাচনের তাওফিক দান করুন এবং বন্ধুত্বের মাঝে স্থায়ীত্ব দান করুন। আমিন ছুম্মা আমিন।
ছবির জন্য ধন্যবাদান্তে গুগল।
বিষয়: বিবিধ
১২৫৪ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
"আপনার অর্থোসংকটে আপনার প্রতি সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেবে।" তবে এই কারনে বেশিরভাগ সময় বন্ধুৃ্ত্বের মধ্যে ফাটল ধরে। ধন্যবাদ আপনাকে
বুবু আপনি খুব খারা ....
মন্তব্য করতে লগইন করুন