"মাকে মনে পড়ে"
লিখেছেন লিখেছেন মাহবুবা সুলতানা লায়লা ০৩ এপ্রিল, ২০১৬, ০৯:২৪:৩৫ রাত
প্রবাস জীবনের স্মৃতি স্বরণে মায়ের মুখের প্রতিচ্ছবি ভেসে আসছে বারংবার। আজকে মদিনারাকাশে মেঘ। তবে বৃষ্টির চাইতে ধূলির ঝড়ে চারিদিকে ধূলায়িত। কোন কিছুই দেখা যাচ্ছে না আশ-পাশের। উথাল-পাথাল এলো হাওয়ায় ধোঁয়া ধোঁয়ায় ধূলি মলিন চারিদিকে দিন-দুপুরও যেন রাতের মতো রুপ নিয়েছে। একটু একটু ঝরে পড়েছে বৃষ্টির রুপে। বৃষ্টি তেমন হয়নি তবে হালকা বৃষ্টি হওয়াতে ধূলো কিছুটা কমলেও মদিনা পুরো শহরটা আজকে যেন স্তব্ধ হয়ে আছে। চারিদিকে দমকা বাতাস বইছে। মাঝে মাঝে আকাশের গর্জনী ধ্বনী কানে ভেসে আসছে। এমন ও ক্ষনে পড়ছে মনে মাকে। হৃদয়ের তন্ত্রীতে মায়ের ছবি ভেসে ওঠে। কতদিন দেখিনা মায়ের মুখ। প্রবাস মানেই কষ্ট বয়ে বেড়ানো। প্রবাস মানেই মায়ের মমতার আঁচল ছেড়ে দুরে বসবাস করা। আজকে মাকে খুবই মনে পড়ছে। মনে পড়ছে মায়ের আদর গুলো।
বড়পরিবার হলে মায়েরা যেভাবে আদর যত্ন করেন ঠিক আমার মা আমাদেরকে সেভাবে যত্ন করতেন। বড়পরিবার হওয়ার কারনে সবাইকে একসাথে যত্ন করা কঠিন হয়ে পড়তো। খাবার-দাবার ঠিক মতই চলতো। বাকি থাকতো চুলে তৈল দিয়ে চিরুনি করা, শীতকালে ভ্যাজলিন লাগানো, সবাই কাঁথা কম্বল ঠিক ভাবে গায়ে দিয়েছে কিনা। এমন কি মা নিজেও রাতের বেলায় চুলে তৈল ব্যবহার করতেন। আমরা বোনেরা ছয়জন। ভাইয়েরা চারজন (এরমাঝে এক ভাই একবোন আল্লাহর কাছে চলে গেছে) সবাইকে একসাথে যত্ন নেয়া যৌথ পরিবারের রান্না, ছোট ভাই বোনদের আলাদা যত্ন, সব মিলিয়ে মা সময়ই পেতেন না। এরপর মা সময় পেলেই ঘরের বেড়া বুনতেন, পাটি বানাতেন, কূলা বানাতেন, ডুলা বানাতেন, কাঁথা সেলাই করতেন, মাঝে মাঝে বালিশের কভার গুলোতে কারুকাজ করতেন। এতকিছুর পর দাদা ভাইয়ার পছন্দ ছিলো পিঠা। মাকে মাঝে মাঝেই দাদা ভাইয়ার পছন্দের পিঠা বানাতে হতো। আমার দাদা ভাইয়া মাকে আদর করে পাগলীনি বলে ডাকতেন। আর পাশে বসিয়ে খাবার খাওয়াতেন। আমার মায়ের মা ছোট্ট বেলাতে মারা গিয়েছিলেন তাই মা কখনো আমাদের কোন আবদার ফেলতেন না। নানী মারা যাওয়া সে আরেক ঘটনা।
শুনেছি যুদ্ধের সময় গুলি লেগে মাটির দেয়াল ভেঙে আমার নানীর গায়ে পড়ে মারা গেছেন। তখন নাকি আমার ছোট্ট একটি মামা ছিলো সেই মামা নানীর সাথে সাথে থাকতো। নানা হলুদ-মরিচ বাটা দিয়ে তরকারি খেতে পছন্দ করতেন তাই নানী হলুদ-মরিচ পিষার কাজে ব্যস্ত ছিলেন আর তখনই মাটির দেয়াল পড়ে নানী মারা যান। সাথে আমার ছোট্ট মামার গলায়ও শুকনা মাটির টুকরা পড়ে কেটে যায়, একটু জোরা লেগে থাকে। মামাকে শুরুতে পাওয়া যাওয়াতে মামা বেঁচে থাকেন আরো ছয়মাস। কিন্তু নানী তখনই আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। সবার মুখে শুনেছি নানী নাকি খুব ফরহেজগার ছিলো। নানীকে দেখিনি, নানীর আদর পাইনি তাই জান্নাতে গিয়ে নানীকে দেখার প্রয়াস আল্লাহর কাছে। হে আল্লাহ; আপনি নানীকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন।
আমার মা সবাইকে শীতের সকাল বেলায় রোদের উষ্ণতায় বসিয়ে রাখতেন যেন আমাদের কারোর ঠান্ডা না লাগে। সকাল ন'টা কি দশটার সময় মা রান্নার কাজে হাত দিতেন। বড়পরিবার হওয়ায় রান্না ছিলো বেশী প্রতিদিন সাত/আট কেজি চালের ভাত রান্না করতে হতো। প্রতি বেলায় পঁয়ত্রিশ জনের খাবার রান্নার মশলা পাটায় পিষে নিতে হতো। এসবের পরেও মা কখনো আমাদের আট ভাই বোনদেরকে খাবার না খাইয়ে রাখতেন না। আব্বুও সব সময় শুকনা খাবার ঘরে এনে দিতেন। যাতে আমরা না খেয়ে কষ্ট না পাই। এরপরও মা যে সব যত্ন দিনের বেলায় আমাদেরকে করতে পারতেন না সেসব গুলো রাতে বেলায় করতেন। রাতে ভাই বোন বেশী হওয়ার কারনে বারংবার মশারি থেকে বের হয়ে টয়লেটে যেত যে কারনে মশারিতে মশা প্রবেশ করে কামড়াতে থাকতো। কিন্তু আমার এমনও দরদী মা রাতে বসে বসে আমাদের মশারির মশাগুলো মারতেন, গভীর রাতে আব্বু বাসায় আসলে খাবার খাওয়ার পর আমাদের বিছানায় এসে দেখতেন আমরা ঠিক ভাবে ঘুমাচ্ছি কিনা। কারো গরম লাগে কিনা। মাথার উপরে ইলেক্ট্রনিক্স ফ্যান ঘুরলেও মশারির ভেতরে তেমন বাতাস লাগতো না। তাই আব্বুও অনেক সময় ধরে পাখা করতেন।
ভাই বোনদের মাঝে আমার গরমটা বেশী ছিলো তাই আব্বু আমাকে বেশী বাতাস করতেন। ছোট বোনেরা বলতো আব্বু বড়আপিকে বেশী আদর করে। তখন আব্বু বলতো আরে নারে আমি সবাইকেই বেশী আদর করি। কিন্তু ওর গরম বেশী তো তাই ওকে বাতাস করছি। মাঝে মাঝে তো সবার উপর দিয়ে পাখা ঘুরিয়ে নিচ্ছি। আব্বুর আদর ছিলো ভিন্ন রকম, আব্বু কোলে নিয়ে আদর করতেন না। খাবার হতে শুরু করে সবকিছু করতেন মাই। আর আব্বুঃ আব্বু শুধু স্কুল ব্যাগে টিফিন দিয়ে রাখতেন, কখনো পাকা আম, কখনো পেয়ারা, কখনো আপেল, কখনো টাকা। আব্বুর আদর ছিলো দুরত্বের আদর কখনো আব্বুর সাথে খেতে বসলে ভালো গোশতটা আমাকে দিতেন। অথবা মুরগীর রানের টুকরোটা আমাদের ভাই বোনদের কারো প্লেটে তুলে দিতেন। বেশীর ভাগ সময় আমাকেই দিতেন কারন আমি ছিলাম সব ভাই বোনদের মধ্যে বড়। আর আমার মায়ের আদর ছিলো বুকে জড়িয়ে আদর। অসুস্থ হলে রাত জেগে সেবা করা। অসুস্থ না থাকলেও আট ভাই বোনের মধ্যে কেউ টয়লেটে যাবে, কেউ ঘুমের মধ্যে কান্না করতো, কেউ ঘুমের মধ্যেও মারামারি। কখনো রাতের বেলায় কারো কানে পিঁপড়া ঢুকেছে কি যে কঠিন অবস্থা? মা মনে হতো সারারাতই জেগে আছেন। যখনই ডাকতাম মা বলতেন কি হয়েছে? আমরা সমস্যার কথা বললে মা উঠে আসতেন। আমাদের সমস্যার সমাধান করে যেতেন।
কখনো মা পুরো রাত্রি ঘুমাতেন না। আবার সকালে ঘুম আসলেও ভাই বোনদের চেঁচামেচিতে উঠে যেতেন। আসলে মায়ের তূলনা শুধুই মা। পৃথিবীর কোন মানুষের সাথে মায়ের তূলনা হয়নি আর হবেও না। আমাদের ভাই বোনদের কারনে মা সময়মত নামাজ পড়তে পারতেন না। তাই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা হে আল্লাহ আমার মায়ের সকল গুনাহ ক্ষমা করে তোমার প্রিয়ব্যক্তিত্বদের সাথে রেখো। আজিকে কয়েক বছর মাকে দেখিনা। আজ বড্ডবেশী মাকে মনে পড়ছে। ইচ্ছে করছে মায়ের কোলে মাথা রেখে শান্তনার পরশ খুজে নিতে। আমার মেয়ে যখন অসুস্থ হয় তখন মাকে খুবই মনে পড়ে। মা তো আমাদেরকেও এভাবেই সেবা-শশ্রুশা করেছেন। আমাদের জন্য অগণিত রাত্রি নির্ঘুম কাটিয়েছেন। আজ মা অসুস্থ কেউ আট ভাই বোনের প্রায় সবাইয়ে দুরে অবস্থান করছি। এক বোন শুধু মায়ের কাছে আছে যার এখনো বিয়ে হয়নি বিধায় মায়ের পাশে আছে। কিন্তু আমরা যারা বড় তাদের সবাই শশুরালয়ে অবস্থান করছি। তারা দুরে থাকলেও বছরে দুইএকবার আসতে পারে। কিন্তু আমি প্রবাসী স্বামীর সঙ্গী হওয়ার কারনে কয়েক বছরেও যেতে পারিনা। দেখতে পারিনা মাকে। কতদিন দেখিনা মায়ের মুখ।
বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরেও শশুরবাড়ি কাছাকাছি হওয়ায় মা প্রত্যেক সপ্তাহে বা পনেরোদিন পর পর এসে আমার চুল ধুঁইয়ে দিয়ে যেতেন। তৈল দিয়ে চিরুনি করে যেতেন। আর আমার সাথি বলতোঃ আম্মা আপনি ওকে বেশি বেশি আশকারা দিচ্ছেন। ওকে ওর কাজ গুলো করতে দিন। মা বলতো সবে তো নতুন সংসার আস্তে আস্তে সবগুছিয়ে করতে পারবে। আমি তো আর সব সময় আসবোনা। আজো চুলে তৈল দেয়ার সময় মাকে মনে পড়ে। মা খুব নরম হাতে আমার চুলে বিলিকেটে কেটে তৈল দিতেন যেন আমি ব্যথা না পাই। অথচ মায়ের অসুস্থতার সময় মাকে কোন সেবাই করতে পারছিনা। মাঝে মাঝে খুবই অপরাধি লাগে নিজেকে কেন যে মেয়ে হলাম? মেয়ে হয়েছি বলেই তো পরের অধীনে জীবন চলছে। মনে খুবই কষ্ট লাগছে মায়ের জন্য পরশু যখন কথা বলার সময় বললোঃ তুই এসে হয়তো আমাকে আর পাবিনা তার আগেই আমি আল্লাহর কাছে চলে যাবো। তখন দু'চোখে পানি এসে কয়েক ফোটা ঝরে পড়লো গোপনে। মাকে বুঝতে না দিয়েই জোরে বললাম; মা মাগো তুমি দেখো আমি তোমার কোলে মারা গেছি আর তুমি বেঁচে আছো। আমি সে দোয়াই করি সব সময়।
মা বললেনঃ এসব বলেনা। আমার বয়ষ হয়ে গেছে আমি মরে যাওয়াটা সহজ। কিন্তু তোদের কিছু হলে তোদের সন্তানদের কে লালন-পালন করবে? আমি বলেছি মা আল্লাহ দেখবেন। মা বলল; আল্লাহ তো দেখবেনই কিন্তু যাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তারা ছাড়া সেই দায়িত্ব অন্য কেউই পরিপূর্ণ রুপে আদায় করবেনা। আসলেই তাই মহান আল্লাহ তা'য়ালা যাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন সে সেটা যেভাবে করবে অন্যকেউই সেটা সঠিক রুপে করবেনা। যার যার সন্তান সেই সুন্দর ভাবে প্রতি-পালন করবে অন্য কেউ না। সু-দূর প্রবাস থেকে মাকে মনে করে লিখছি এই লেখা। জানিনা কি লিখেছি? তবে মনে কষ্টগুলো ব্লগপরিবারের ভাই বোনদেরকে অবগত করে শান্তনার বাণী কুঁড়াতে চাই। পরিশেষেঃ মহান আল্লাহ আমার মা ও আব্বুকে এবং সকলের মা ও আব্বুকে হায়াতে ত্বয়্যীবাহ দান করত, ঈমানের সাথে রাখুন ও ঈমানের সাথে তার সান্নিধ্যে নিয়ে যান। সবাই আমার মা আব্বু ও শশুর শাশুড়ীর জন্য নেক হায়াতের দোয়া করবেন। আমিন ছুম্মা আমিন।
ছবির জন্যে শুভাচ্ছান্তে গুগল....।
বিষয়: বিবিধ
১৯৫০ বার পঠিত, ২৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার তো তাও, মাকে দেখার আশা আছে,
অনেকের মত, আমার তাও নেই।
চলে গেছে বাবা মা সেই না ফেরার দেশে
আগেকার মহিলারা অনেকেই এমন ছিলেন। বর্তমানের মহিলাদের কথা আর কি বলবো! দুটো ভাত পাকাতেই জীবন শেষ।
আমার আম্মা এখনো কাজের রানী, সব কাজই এখনো নিজের ইচ্ছায় করেন, বারণ করলেও করবেন। পাটি, লাই, কাঁথা, গোবরের কাঠি, গরুর দুধ দোহন, রাত জেগে ধানের দিনে কাজ করা, শরিষা ছড়ানোসহ কোন কাজ বাকি রাখেন না।
আম্মার পাক ভালো হয়, আমাদের বাড়ির আশপাশের কোন ছোটখাটো অনুষ্ঠানে আমার আম্মাই হন প্রধান পাচক। (বিনে পয়সায় কিন্তু)।
এক কথায় আশপাশের দশ মহিলার কাজ আলহামদু লিল্লাহ আমার আম্মা এখনো করে বেড়ায়।
আপনার আমার প্রতি রইল অনেক অনেক সালাম।
আপনার অনেক বর্ণনাই আমার কাছাকাছি!
আমরা ভাই-বোনেরা ১১জন, (এরমাঝে দু'ভাই একবোন শৈশবেই আল্লাহর কাছে চলে গেছে)! বাকি আছি ৪+৪, সবাই সংসারী, আমি এখন সবার বড়। আমার আম্মা বিদায় নিয়েছেন ২০১০-এ, নানী (৯৬+বছর) এখনো সুস্থ সচল আছেন!
আপনার অন্যান্য বর্ণনায় (গরমে পাখার বাতাস, টিফিন, মশারী..) অনেক মিল।
আল্লাহতায়ালা আপনার আম্মাকে সুস্থ-সচল শতায়ূ+ করুন, আমীন!
নানীকে দেখা আর না দেখা, দুটোই আমার জন্য। আমার মাত্র দুবছর বয়সে নানী মারা আর চার বছর বয়সে নানা। দাদা দাদীকে দেখিনিই! তবুও আমার বোনেরা সব অপূর্ণতাকে পূর্ণ করেছেন।
আর একটা কথা, এতোজন সন্তান নিয়েও কি খুব খারাপ ছিলেন? তাহলে তাদেরই সন্তান হয়ে আমরা কেন ' দুটির বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়' নির্লজ্জের মত ফলো করে যাই!
'মেয়েরা পরের অধীন' কথাটায় একটু খেদ মেশানো ছিলনাতো!
শুনেছি, মুটকীদের বেশি বেশি গরম লাগে, আমি অবশ্য মোটকা নই, তাই আপনারও কি সে একই কারণে.... দেশে দুর্ভিক্ষ লাগার এটাও তাহলে একটা কারণ!
ধীরে ধীরে সবাইকে কাছে নিয়ে যান, কষ্ট আর থাকবেনা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন