"হঠাৎ বৃষ্টির মতোন"
লিখেছেন লিখেছেন মাহবুবা সুলতানা লায়লা ২০ মার্চ, ২০১৬, ০৮:৫৬:০৭ রাত
প্রবাসের মানেই এক একটা গল্পের বই। প্রবাস মানেই জীবনের তিক্ত ইতিহাস। প্রবাস মানেই একাকি জীবন। প্রবাস মানেই রক্ত, ঘাম, আর দু'চোখের অশ্রু বিসর্জিত দিনাতিপাত। যারাই প্রবাস নামের কারাগারে দন্ডিত হয়েছেন তারাই শুধু বুঝেন এর আসল মর্মার্থ। এর শাস্তি কতটা কষ্টের। আপনজনের বিয়োগে থাকা কতটা কঠিন তা প্রবাসীরাই বুঝেন। প্রবাসী পরিবার ছাড়া কেউই এর আসল অর্থ বুঝবেনা। হাতে গোনা কয়েকটা পরিবার মক্কা, মদিনা, রিয়াদ, জেদ্দাতে থাকেন। আর বাকি সবাইকে একথায় বলতে গেলে বলতে হয় ব্যাচেলর। যারাই পরিবার নিয়ে থাকেন তাদের হয়তো কিছুটা কষ্ট লাঘব হয়। যেমন সারাদিনের পরিশ্রমের পর বাসায় এসে রান্না করে খেতে হয়না। কাপড় ধুতে হয়না। নিজের কাজগুলোর আঞ্জামও জীবন সাথিরাই করেন। আমি ভাবিঃ যাদের বউ, বাচ্চা কাছে থাকেনা তাদের কষ্টের কথা। সারাদিন হাড় ভাঙা খাটুনির পর বাসায় এসে একাকি রান্না করা, কাপড় ধোয়া, ইত্যাদি কাজ গুলো করা কতটা কষ্টের? তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবোনা কারোর।
তবে প্রবাসে একটি জিনিস খুব বেশী তা হলো একে অপরের সহযোগীতার ব্যপারে খুবই খেয়াল করেন। যে ক'টা পরিবারের সাথে আমার পরিচয় আছে তাদের প্রত্যেকেরই আলাদা আলাতা গুণ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় যে গুণটা আছে তা হলঃ মানুষের বিপদে এগিয়ে আসা। মানুষের উপকার করার জন্য মনে হয় যেন এক পা তুলে দাড়িয়ে থাকেন। যে জিনিসটা দেশে বর্তমানে পরিলক্ষিত হয়না। এক সময় আমি সনজরে দেখেছি, মানুষের বিপদে মানুষ কতটা আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসতো। এটাই ছিলো ইসলামের শিক্ষা। আর এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমানে তা যেন সোনার হরিণের মতো হয়ে গেছে। স্বদেশে কেউ বিপদে পড়লে আত্মীয়-স্বজন হলেও পাশ কেটে চলে যাওয়াটা খুবই সহজ ব্যপার হয়ে দাড়িয়েছে। কিন্তু প্রবাসে এমনটা হয়না সাধারনত।
মদিনাতে আমি কয়েক বছর আছি আর আমার স্বামী তো প্রায় তেইশ/চব্বিশ বছর ধরে আছেন। আমার সামান্য অভিজ্ঞতা থেকে বলছি প্রবাসে মানুষ মানুষের বিপদে যতটা এগিয়ে আসে যদি এই মন-মানষিকতা স্বদেশেও বিরাজ করতো তবে আমাদের দেশটা সোনার মদিনার মতোই হতো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসই বলতে হবে। মুসলিমরাই ইসলামের নিয়ম মানেনা। হাজারো আফছূছঃ কেন যে সবাই ইসলামকে আঁকড়ে ধরার পরিবর্তে বে-জাতীয় রসমকে আঁকড়ে ধরে আছে? আমি বুঝিনা। এখানে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশী সেটা হলো মানুষের সাথে মানুষের সু-সম্পর্ক বজায় রাখা। এখানে কেউ কারো পারিবারিক বা বংশ সূত্রে আপনজন নয়। তবুও সাম্পর্কিত সম্পর্ককে যতটা বজায় রাখার চেষ্টা তাতে মনে হয় যেন আমরা সকলেই একটি পরিবারের লোক। কেউ কারো হক্ব নষ্ট করেনা। পারত পক্ষে কারো মনে কষ্ট দিতে চায়না। আমি বলছি না সবাই এখানে দুধে ধোওয়া তুলশি পাতা। এখানেও আছে কতেক দুষ্টো। তাদের কথা বাদই দিলাম। শুধু বলবো সোনার মদিনায় এলে মানুষ খাঁটি সোনাতে রুপান্তরিত হয়।
আমি এখানে সাম্পর্কিক সম্পর্কে কয়েকজন এত ভালো মনের মানুষ পেয়েছি যা লিখে ব্যক্ত করা যাবেনা। যে কোন বিপদে, আপদে, সুখে, দুঃখে, ঈদের আনন্দে একজন একজনের জন্য সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে রাখে। প্রয়োজনে মধ্যরাতেও কল করলে আপনি তাদেরকে পাবেন। এই সাম্পর্কিক সম্পর্কটাকে বজায় রাখার জন্য মানুষ যতটা উৎসুক স্বদেশে যেন তা বিরল। এখানে ঈদ আসলে সবাই সবাইকে ঈদের পোষাক কিনে (হাদিয়া) বা উপহার দেয়। বড়দেরকেও কেউ কেউ দেয় তবে ছোটদের তালিকা সবসময়ই থাকে। যে যা কিছুই কিনুক ছোটদের বাদ দিয়ে কিনবেনা। ঈদে সবাই সবাইকে দাওয়াত করে। আর কোন অনুষ্ঠার ছাড়াই মনে চাইলো সবাইকে দাওয়াত করলো। উদ্দেশ্য কি জানতে চাইলে বলবে, সবাইকে নিয়ে একবেলা খাবো ব্যস; কারো আত্মীয়-স্বজন হজ্জে বা উমরাহ তে আসলে পরিচিত সবাই (হাদিয়া) বা উপহার দিতে থাকবে, তাদেরকে দাওয়াত করে বাসায় আনবে, এই যে উদরতা, এই মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা এই ভালোবাসায়ই হয়তো প্রবাসে থাকছি থাকতে পারছি। নয়তো একঘন্টাও থাকতে পারতাম না। আলহামদুলিল্লাহ; আর বাঙালি পরিবারের মিলন মেলা হলো সপ্তাহের বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার। এই দুইদিন সকল বাঙালি পরিবারে যেন ঈদের দিনের মতো কাটে মসজিদে নব্বীতে সকলের সাথে সকলের দেখা সাক্ষাত হয়। কৌশলাদি বিনিময় হয়। হারামের মাঠে খাবার-দাবারেরও আয়োজন হয়।
এসব দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় যারা নবী করিম (সঃ) এর সাথে মুহাজির হয়ে মদিনায় এসেছিলেন, তারা কতটা অসহায় ছিলো, আর মদিনার আনসার তারা কতটা উদার হয়ে মুহাজিরদেরকে আপন করে নিয়ে ছিলো সত্যিই ইসলাম আমাদের জন্য সবকিছুকে প্রসস্থ করে দিয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। আর আমরা সেই প্রসস্থতাকে সংকির্ণ করে ফেলছি দিন দিন। যদি সেই মুহাজির আনসারদের পদ্ধতিটা আমরা ধরে রাখতে পারতাম তবে কেউই প্রবাসে একাকি হতোনা।, হতাশায় ভুগতো না। সবারই মনে হতো আপনজনের কাছেই আছি।
সেই আনসার আর মুহাজিরের মতো আর কাউকে কি পাবো হায়াতের জীবনে? ভাবলে কষ্ট লাগে স্বদেশে বর্তমানে নিজের আপন ভাই, বোনকেও অনেকে বছরের পর চলে যায় দাওয়াত করেনা কারন একটাই খরচ বেশী হবে। অথবা এতটা উদার তারা নন। হজ্জ বা উমরাহ এর সময় যত বাঙালি আসে তাদেরকে নিয়ে এক রকম প্রতিযোগীতা শুরু হয় কে কাকে খাওয়াবে? কে কি খাওয়াবে? মহিলা দাওয়াত মানেই হলো আইটেমের কোনটাই বাদ রাখবে না তারা। কারন মেহমান কোনটা খেতে পারে না পারে জানা নেই। তাই যত বেশী করা যায় ততই আইটেম করেন। (আবার অপচয়ও করেন না খাবার বেশী হলে সাথে প্যাকেট ঝুলিয়ে দেবে হাতে হাতে) এই যে তাদের অনাত্মীয় হওয়ার পরও আত্মীয়র মতো আচরণ সত্যিই বিমুগ্ধ হওয়ার মতো। এখানের বাঙালি যে ক'জন ভাবি বা বোনদেরকে পেয়েছি তারা এক একজন এতটাই উদার যে তা বর্ণনার ভাষা আমার জানা নেই। শুধু তাদের জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করি তারা যেন দো-জাহানেই মুক্তি লাভ করে।
স্বদেশকে ভুলি নাই, স্বদেশকে জীবনে কখনোই ভোলা যাবেনা। মাকে যেমন ভুলতে পারিনা ঘুনাক্ষরেও। তেমনী মাতৃভূমিকেও ভুলতে পারিনা। মনের মধ্যে স্বদেশ যেন সকল দেশের রানী সেজে বসে আছে। সুবহানাল্লাহ এত সুন্দর আমার দেশ কোনদিক দিয়েই খুঁত ধরা যাবেনা। মহান আল্লাহ সবকিছু দিয়েই পরিপূর্নতা দিয়েছেন আমার মাতৃভূমিকে। মাঝে মাঝে মাতৃভূমির জন্য কষ্ট হয়। দু'চোখের কোণে অশ্রু জমে ঝরে পড়ে। তখন ইচ্ছে করে এখনই ছুটে যাই আর কাদা-মাটিতে লুটো-পুটি খেয়ে শরীরে মাটি মেখে মনের মাঝে প্রশান্তি অনুভব করি। এই আমার দেশ আমার জন্মভূমি আমার মাতৃভূমি তোমার কোলে জনম নিয়ে ধন্য আমি।
তাই যখনই সুযোগ হয় রিয়াদুল-জান্নাতে গেলে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য দোয়া করি। দোয়া করি দেশের কল্যাণের জন্য, দেশের নিরাপত্তার জন্য, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাই হে আল্লাহ; হে আমার প্রতিপালক; দুনিয়ার ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে জান্নাতেও আমার দেশের স্ব-রুপ একটি জান্নাত দিও যেন পৃথিবীর জনমভূমিটাকে দুরে রেখে যে কষ্ট প্রবাসী হয়ে পাচ্ছি তা যেন ভুলতে পারি। আল্লাহ কবুল করুন। কখনো সময় সুযোগ হলে উত্তম প্রতিবেশীদের উত্তম আচরণ নিয়ে লিখবো ইনশা-আল্লাহ।
ভাই শাহাদাত হুসাইন আপনার আগমনটা যেন হঠাৎ বৃষ্টির মতোন হয়েছিলো। আপনার লেখাটা পড়েই লিখতে বসেছিলাম। আসলে সে বিষয়ে লিখতে গিয়ে লেখার মোড় অন্যদিকে চলে গেছে বলে দুঃখীত। তবে আপনাকে যথেষ্ট আপ্যায়ন করতে না পেরে মনে কষ্ট রয়ে গেছে। জু'মার সামান্য আগে আপনার ভাই বলল যে, মেহমানকে জু'মার পরে বাসায় নিয়ে আসবো। আমি তো হতবাক; এত অল্প সময়ে এখন কি রেখে কি করবো? এরপরই উনার রান্নার বিষয়ে দারস দেয়া শুরু হলো এটা করো ওটা করো। আমি তো হেসে হেসে বলি, মনে হচ্ছে আমার ভাই আসছে। আর সে ও বলে মনে হচ্ছে তো তাই বলেই জু'মা পড়তে চলে যায়।
জু'মা পড়ে এসে হেসে বলে হাঁ তোমার আয়োজন দেখে তো মনে হচ্ছে আমার শ্যালকই আসছে। হাঁ আমারো মনে হচ্ছে যে, আমার আপন ভাই-ই আসছে বলেই দুজনে হেসে ফেলি। সত্যি বলতে কি আপ্যায়নে কোন কমতি থাকলে আমি মনের মাঝে প্রশান্তি পাইনা। সেদিন অনেক কমতি ছিলো যে কারনে আমি মনের মাঝে প্রশান্তি পাইনি। আপ্যায়নে কমতির জন্য দুঃখীত। আর আপনার সম্পাদিত বইটির জন্য আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। বইটির জন্য অনেক অনেক কষ্ট ও অর্থ ব্যয় করেছেন। মহান আল্লাহ আপনার পরিশ্রমকে কবুল করুন। বইটি হাতে পেয়ে খুবই আনন্দ বোধ করেছি মনে। মহান আল্লাহ আপনার এই উদ্যোগকে আগামিতে আরো বাস্তবায়নের তৌফিক দিন। সময় করে আবারো মেহমান হবেন বোনের বাসায়। এবার ইতি টানি নইলে পাঠক আমাকে দৌড়াবে....................।
আমার ওয়েব সাইট থেকে পড়ুন
বিষয়: বিবিধ
১৫২৬ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
খুব ভাল লাগল অনেক ধন্যবাদ আপু ।
আমারে আপনার একখান সৌজন্য কপি দিয়েন কিন্তু!
আমিও কিন্তু অনেক সময় নিজে রান্না করে খেয়েছি, ক্ষুধার তীব্রতা কত প্রকার ও কি কি টের পেয়েছি। তই যাইয়া, আমি আলু সেদ্ধ, শুকনা মরিচ ভাজি, ডিম ভাজি, আলুর ভর্তা, পেঁয়াজ মরিচের ভর্তা, ডিমের ভর্তা ইত্যাদি বানাইতে পারি। তাইলে আন্ডা বাইত আন্নেরা হগগলের দাওয়াত ক্যান!
অাপনার অনুভুতি অনেক ভালো লাগলো।
প্রথম যেদিন আব্দুর রহিম ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করলাম, যেন আমার আপন কেউ, অনেক আনন্দ লেগেছিল। অনেক অনেক ধন্যবাদ জাযাকাল্লাহ খাইর
প্রথমেই শুভেচ্ছা নিবেন চমৎকার লিখনীর জন্য! আপনাদের প্রবাসের সফর, সাক্ষাত এবং লেখকের কথা জেনে খুবই ভালো লাগলো!
শুকরিয়া।
লেখাটা আজকে দুপুরের আগেই পাঠিয়ে দিন প্লিজ !!!!
মন্তব্য করতে লগইন করুন