গরীবের মেয়ে (বিদেশীর বউ ৩য় পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন মাহবুবা সুলতানা লায়লা ০৪ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৪:০৩:২৫ রাত
আগের পর্বের পর
এটাও কি সম্ভব? মাসটা শেষ হলে ঘরের খরচ পাঠাই ত্রিশ হাজার টাকা আর ছোট ভাই দেয় কখনো বিশ পঁচিশ করে। গড়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ দেয়ার পরও সেখানে আমার বউ কণ্যার খাবারের কষ্ট হয়! না এভাবে আর চলতে দেয়া যায়না! বিয়ের প্রায় দুই বছর হতে চলেছে লাবন্য তো কোনদিন বলেনি এসব কথা! আর কোন কিছুর আবদারও সে করেনি! কিন্তু আজকে সে বলেছে আমার ঘরে তার খাবারের কষ্ট হয়! লাবন্যর স্বামী আবারও কল করে লাবন্যকে চায় শালির কাছে! লাবন্য কথা বলতে চায়না! এভাবে কয়েকদিন পর আবার কল করে লাবন্যকে চায় শেষে স্বামী বারংবার চাওয়াতে কথা বলে লাবন্য! সে জানতে চায় লাবন্য তুমি তো কখনো বলনি তোমার কষ্টের কথা! কেন বলনি?
লাবন্য বলে কিভাবে বলবো আমার কাছে কি মোবাইল আছে?
শাশুড়ী আম্মার মোবাইল দিয়ে কথা বলি তিনি কথা বলার সময় বলে দেন ভালো আছি ছাড়া বাড়তি কোন কথা বলতে না। যদি বলি তাহলে নাকি তুমি স্ট্রোক করবে, তোমার প্রেসার বেড়ে যাবে, তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে, হঠাৎ দুঃখের কথা শুনলে মারা যাবে তাই বলিনা! আমার কষ্ট হয় হোক তবু তুমি ভালো থাকো। সবকিছু শেয়ার করি শুধুমাত্র একজনের কাছে আর তিনি হলেন আমার পালন কর্তা, আমার আল্লাহ। আমি কত কষ্ট করছি বিয়ের পর থেকে খাওয়ার কষ্ট, পোষাকের কষ্ট, সেই যে তুমি দুইটা থ্রী পিজ কিনে দিয়ে গেছ সেই পোষাকই এতদিন পরিধান করেছি। সিজারের পর সেগুলো হয়না দেখে আমার মা ফুটপাত থেকে সস্তা কাপড় কিনে দেয় একজোড়া থ্রী পিজ আর আমি সেই কাপড় নিজ হাতে সেলাই করে পরছি। কারন মুজুরী দিয়ে সেলাই করাবো কিভাবে?
তেলের অভাবে লম্বা চুলগুলো সব জট বেঁধে ছিড়ে ছিড়ে বিশ্রী হয়ে আছে। সাবানের অভাবে কাপড়ের সাদা প্রিন্ট গুলোও লাল লাল হয়ে গেছে কি যে কষ্ট! এমন কি আসা যাওয়ার ভাড়া পর্যন্ত দেয়া হয়না আমাকে আর কসমেটিকস সেটা তো আরো দূর্লভ যেখানে প্রয়োজনীয় সামগ্রীই চেয়ে চেয়ে লিষ্টি লিখে মাসের পর মাস গেলেও পাইনা সেখানে অন্যসব তো বাদই। আমার কোলের মাসুম ইসরা সেও অসুখে-বিসুখে পায়না সু-চিকিৎসা আর কি বলবো? আমি সব সময় তোমার ও তোমার পরিবারের সবার হক্বের ব্যপারে আল্লাহকে ভয় করে চলি। তাই আর কিছুই বলার নেই বলেই মোবাইল রেখে দেয় লাবন্য। লাবন্যর স্বামী মনের মাঝে খুবই কষ্ট পায় লাবন্য না দেখলেও তার কথা শুনে তার স্বামীর দু;গাল বেয়ে ঝরে পড়ে বেদনার অশ্রু! লাবন্যর স্বামী ভাবতে থাকে আমি প্রবাসে পড়ে আছি, এখানে কষ্ট করি, তারপরও চাই স্বদেশে সবাইকে ভালো রাখতে, সুখে শান্তিতে রাখতে অথচ আমার স্ত্রীর এই অবস্থা?
নাঃ এবার থেকে স্ত্রীকে আলাদা হাত খরচ দিতে হবে! কারন আল্লাহ তো একজন আছেন তিনি তো জানতে চাইবেন স্ত্রীর কি হক্ব আদায় করেছি? একে তো দুরে থাকার কারনে স্ত্রীর হক্ব নষ্ট হচ্ছে। তার উপর নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীও যদি না পায় তাহলে তো আমার জান্নাতে যাওয়া তো দুরে থাক জান্নাতের ঘ্রানও পাবার কথা নয়। কারন একজন পুরুষের উপর পরিবারে দায়িত্ব আর এই দায়িত্ব যে যতটা মূল্যয়নের সাথে পালন করেছে সে ততটাই সওয়াবের ব্যপারে অগ্রগামী। বউয়ের কাছ থেকে বাস্তবতা জানার পর স্বামী বেচারার একটুখানি টনক নড়েছে! কি করবে সে বেচারা? কিছু বললে বাবা-মা কষ্ট পায় আর না বলে চুপ থাকলে স্ত্রী ও সন্তান কষ্ট পাচ্ছে। ভেবে কূল কিনারা পায়না লাবন্যর স্বামী! আমার কোলের সন্তানও পায়না অসুখে-বিসুখে সু-চিকিৎসা!
আমার সন্তানের অসুখে ভালো চিকিৎসা হয়না? আহঃ আমি কত অধম পিতা। আমি আর ভাবতে পারছিনা কি করবো? হে আল্লাহ তুমি তোমার পক্ষ থেকে আমাকে পৃথিবীর সেরা উপহার নেককার স্ত্রী দিয়েছ, যার ভেতরে তোমার কোরআন হাদীসের জ্ঞান রয়েছে আর আমি এমন বেকুব যে, এত দামী রত্নের কোন মূল্যায়নই করতে পারিনি। তার কোন হক্বই আদায় করতে পারিনি। সে যদি সাধারন জেনারেল পড়া শুনায় শিক্ষিত হতো কোরআন ও হাদীসের সহীহ জ্ঞান না থাকতো তবে কবেই আমার সংসার, সন্তানকে ফেলে চলে যেত। আমি কতই না বোকা; বোকা না হলে কেউ এমন ভাবে স্ত্রী সন্তানের ব্যপারে বেখবর হয়? আমি প্রবাসে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেই, মানুষকে মানুষের হক্বের ব্যপারে সতর্ক করি আর নিজেই কিনা নিজ স্ত্রীর খবর রাখিনা আর ছিঃ ছিঃ ছিঃ নিজকে নিজে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে।
এভাবে ভাবনার গভীরতায় নিমজ্জিত হয়ে কত সময় যে চলে যায় বুঝতেই পারেনা লাবন্যর স্বামী। স্বামী কুঝতে পারে তার ভুল গুলো। সে নিজেই তো কত হাদীস পড়েছে আর নিজেই সে হাদীসের উপরে আমল করেনা। এই তো গত প্রোগ্রামেই তো শুনলাম কয়েকটা হাদীস
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাযিঃ) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ গোটা দুনিয়াই সম্পদে পরিপূর্ণ। এর মধ্যে সবচেয়ে উত্তম সম্পদ হলো পূর্ণবতী স্ত্রী। (মুসলিম) মহান আল্লাহ তো আমাকে পূর্ণবতী স্ত্রীই দিয়েছেন কিন্তু আমি তার কোন মর্যাদাই দিতে পারিনি। আমি আল্লাহর কাছে কিভাবে হিসাব দেবো? হে আল্লাহ তুমি আমাকে ক্ষমা করো। সে আরো ভাবতে থাকে হাদীসের পাতায় তো কত মেসেজই আমাদের জন্যে দেয়া আছে আমরা কতজনে কয়টা মানি?
হযরত আবু হুরাইয়া (রাযি) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেনঃ যে ব্যক্তির চরিত্র ও আচরণ সবচাইতে উত্তম, ঈমাদের দৃষ্টিতে সে-ই পূর্ণাঙ্গ মুমিন। তোমাদের মধ্যে সেই সব লোক উত্তম, যারা তাদের স্ত্রীদের কাছে উত্তম। তিরমিযী) আমি যে আচরণ করেছি তাতে লাবন্যর কাছে আমি একেবারে অধম হয়ে গেছি। আমি একি করেছি? আমি নিজেই ইসলামের বিধান মতে সমাজ সংসকারের কাজ করি আর আমার পরিবারেই কিনা অপসংস্কৃতির অন্ধকারাচ্ছন্ন? ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। স্ত্রীদের নিকট হতে তোমাদের যেমন ভাল ব্যবহার পাওয়ার অধিকার আছে ,তেমনি স্ত্রীদেরও তোমাদের নিকট থেকে অনুরুপ ব্যবহার পাওয়ার অধিকার আছে। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম ,যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম বলে বিবেচিত হবে। আল-হাদিস
তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করিও। আমিও আমার বিবিগনের সহিত উত্তম ব্যবহার করে থাকি। আল-হাদিস
স্ত্রীদের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে ভয় করবে। নারীদের প্রতি দূর্ব্যবহার ও অত্যাচার করার বেলায় আল্লাহর দন্ডকে ভয় করো। আল-হাদীস
এসব হাদীস মনে পড়ে লাবন্যর স্বামীর চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে করছে এখনই লাবন্যর কাছে ছুটে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেই লাবন্য লাবন্য তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। কিন্তু কিছু কিছু সময় এমন হয় যখন মন চাইলেও বাস্তবতা চায়না। বাস্তবতা বড়ই কঠিন রুপ নিয়ে থাকে তখন। আমি চাইলেই এখন যেতে পারবোনা কারন প্রবাসের শিঁকল দ্বারা আমি বন্দি। কতবার যে এসব হাদীস পড়েছি কিন্তু বাস্তবে এনে কখনো ভাবিনি। কখনো মনেই হয়নি এসব হাদীসের গুরুত্ব।
আজকে মনে হচ্ছে হাদীসের প্রতিটি কথাই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু আমরা মানিনা। মানার চেষ্টাও করিনা অথচ আমরা সমাজের উল্লেখ যোগ্য একটা শ্রেণী হয়েও ভুল করি অহরহ। জুলুম করি আর ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারিনা নিজ জীবনে আমরা একেকজন জালেম। স্ত্রী কণ্যার হক্ব নষ্টাকারি। আর আমাদের দ্বারা শয়তান করিয়ে নিচ্ছে তার শয়তানি কাজ। আমরা শয়তানের গোলাম হয়ে প্রতি নিয়ত জুলুম করছি, অত্যাচার করছি, হক্ব নষ্ট করছি আর সমাজে ইসলামই বিধান প্রতিষ্ঠার কাজও করছি।
আমার নিজ পরিবারেই যখন ইসলামের সঠিক মেসেজ গুলো বাস্তব রুপ দিতে পারছিনা তখন সমাজে কি করে রুপ দেব? আমার মতো আরো অনেক স্বামী যারা এভাবে জুলুম করে যাচ্ছে তাদের ইসলামই মেসেজের মাধ্যমে সমাজ কতটুকুই আর উপকৃত হবে? কতটাই বা বাস্তব রুপ লাভ করবে? হে আল্লাহ যারা তোমার কোরআন ও হাদীসের জ্ঞান রাখে তাদেরকে আগে পরিপূর্ণ রুপে তোমার দ্বীন মানার তৌফিক দাও এরপর তা সমাজের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে দাও এক মশাল থেকে লক্ষ লক্ষ মশালে। কোন এক সময় হয়তো সেই আলোয় পুরো পৃথিবীই আলোকিত হবে। এবার সমাধানে আসতে হবে যেন মা-বাবারও কষ্ট না হয় আর স্ত্রী সন্তানেরও কষ্ট না হয়। উভয় দিক যেন ঠিক থাকে। সে কল করে ছোট ভাইয়ের কাছে, বলে স্কাইপিতে আয় মা-বাবাকে দেখবো কথা বলবো। একটু পরেই স্কাইপিতে সবার সাথে কথা বলে কৌশল বিনিময় করার পরে জানতে চায় সবার খোজ খবর।
চলছে......চলবে।
আমার ওয়েব সাইট থেকে পড়ুন
দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন
প্রথম পর্ব পড়ুন
বিষয়: বিবিধ
১৯৬০ বার পঠিত, ২৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পুরনো দিনের ঘটনার সাথে বর্তমান যুগের ফ্যাসিলিটিজ এর মিশেলে একটা ফ্যান্টাসী হয়েছে
সমাজের বাস্তবতা এমনই। সুন্দর পোষ্ট, অনেক অনেক ধন্যবাদ
প্লিজ, কারো দিকে আর তাকিয়ে থাকা নয়, কেউ আসুক অথবা নাই আসুক, আপনি আসছেন, লিখছেন, ভালো কিছু উপহার দেয়ার চেষ্টা করছেন, এটাই নিশ্চিত করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন