গরীবের মেয়ে (বিদেশীর বউ ২য় পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন মাহবুবা সুলতানা লায়লা ০২ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৪:৩৫:১৫ বিকাল
প্রথম পর্বের পর
শশুর আর শাশুড়ী তো খবর না নিয়েও পারেন! কিন্তু লাবন্যোর বাবা মা তো আর মেয়েকে ফেলে দিতে পারেন না! উনারা ঋন করে হাসপাতালের বিল পরিশোধ করে মেয়েকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আনেন ডাক্তার বলে দেন রোগী খুবই দূর্বল! উনার খুবই যত্নের প্রয়োজন! আপনারা খুবই যত্ন নেবেন উনার প্রতি নয়তো দূর্বলতার কারনে যদি রোগী দাড়ানো থেকে পড়ে যায় তবে সেলাইতে সমস্যা দেখা দিতে পারে! অন্তত ছ'মাস ভারী কোন কাজ করতে দিবেন না কারন এতে সেলাইয়ে সমস্যা হতে পারে। লাবন্যও বুঝতে পারে কণ্যা সন্তান জন্ম দেয়ায় তার কণ্যার এখন থেকেই অবহেলা শুরু হয়েছে! বাকি জীবন কি হবে কে জানে? এখন থেকেই সমস্যার শেষ নেই! কণ্যা সন্তান হওয়াতে স্বামী ছাড়া শশুরালয়ের প্রায় সবাই মন ক্ষুন্ন!
ছেলে সন্তান হলে উনারা বেশী খুশি হতেন! কিন্তু স্রষ্টা মালিক তো জেনে শুনেই নির্ধারন করেছেন কার কি সন্তান হবে এটা তো কেউই বলতে পারেনা! লাবন্য ভাবে আল্লাহ দিলাই যখন তখন একটি ছেলে সন্তানই দিতে অন্তত সবার ভালোবাসা নিয়ে বড় হতে পারতো! (ইসরার জন্মের পর পরই স্বামী তার মাকে ম্যানেজ করে মোবাইল দিতে বলে তারা রাজি হন না। স্বামীকে বলে দেন তোর স্ত্রীকে মোবাইল দিবি পরে আমাদেরকে কোন ব্যপারে প্রশ্ন করতে পারবিনা। স্বামী এক রকম জোড় করেই স্ত্রীকে মোবাইলের ব্যবস্থা করে দেন মায়ের হাতের পুরোনো নকিয়া মোবাইল সেট। শাশুড়ী হাতে দেয় মোবাইল স্বামী কল করে বলে আমার সম্মান রেখ আমি সবার সাথে চ্যালেঞ্জ করে তোমাকে মোবাইল দিচ্ছি। লাবন্য বলে ইনশা-আল্লাহ তুমি দোয়া করো আমি যেন তোমার মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে পারি)। স্বামী তখন লাবন্যকে শান্তনা দেয় তুমি মন খারাপ করনা আমি তো মেয়ে পেয়ে খুশিই আছি। আর আমাদের কণ্যার জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট। স্বামীর কথায় লাবন্য ভরসা পায় কষ্টের মাঝেও।
লাবন্যোর কণ্যা হয়েছে মাত্র সাতাইশ দিন! এরই মাঝে শশুর শাশুড়ী নানা রকম অযুহাতে বউকে নিতে আসে! লাবন্য তার স্বামীকে বলে আমি কিছুদিন বাবার এখানে থাকি মেয়েটা একটু শক্ত হোক আর আমিও সুস্থ কিছুটা হই তারপর যাই! কিন্তু স্বামী বেচারা লাবন্যোর একটি কথাও রাখলোনা। মাকে খুশি করতে বউকে কঠোর ভাবে বললেন মা আসলে চলে যাবে আমাদের বাসায় নয়তো আর কোনদিন যেতে হবেনা তোমার বাবার বাড়িতেই থাকো! (মনে রেখ আমার মায়ের পায়ের নিচে আমার জান্নাত আর আমি তোমার জন্য আমার জান্নাত নষ্ট করবোনা)। লাবন্য অসহায় হয়ে পড়ে! কি করবে? যার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশী সহযোগীতা পাওয়ার কথা, অসুখে-বিসুখে যে সবচেয়ে বেশী শান্তনা দেয়ার কথা, যে তাকে সুস্থ হওয়ার জন্য বেশী অগ্রগামী হবে সেই লাবন্যের দূর্বল সময়ের কথা ভাবছে না! আর কে ভাববে লাবন্যকে নিয়ে?
লাবন্যও এবার জিদ ধরে আমি ফার্রিচার ছাড়া যাবোনা তোমার বাসায় কারন উঠতে বসতে আমার বাবার নামে গাল-মন্দ শুনতে হয়। সবসময় বলে ফকিরের ঘর থেকে ফকিন্নি ধরে আনছি। তার স্বামী বলে আমি যৌতুক নেইনি বিয়ের সময় আর এখন নিলেও সেটা যৌতুকই হবে তুমি আসবাব-পত্র ছাড়াই যাবে। লাবন্য বলে তবে আমি যাবোনা। কারন আবারো আমাকে সেই গাল-মন্দ শুনতে হবে। স্বামী বেচারা অসহায় হয়ে পড়ে কি করবে? বিয়ের সময় বড়মুখ করে বলেছিলাম কিছুই নেবোনা কিন্তু আমার মায়ের এসব কর্মকান্ডে আর তোমার জিদের কারনে আমার সেই বড়মুখ ছোট হয়ে যাবে। লাবন্য বলে এ আমারজিদ নয় এ আমার পাওনা। আমি বউ হয়ে তোমার কাছে ঘরের প্রয়োজনীয় আসবাব চাইতেই পারি।
লাবন্য তুমি বুঝতে চেষ্টা করো তুমি কি আমার সম্মান ধূলোর সাথে মিশিয়ে দিতে চাও? লাবন্য বলে আমি তোমার সম্মান বাড়ে এমনটাই চাই আবার এও চাই যে, আমার বাবাকে কেউ নাম ধরে গালা-গাল না করে। আমার বাবা গরীব তারপর ও তার কিছুটা সম্মান তো আছে। সেই সম্মানিত মানুষটাকে সম্মান করার পরিবর্তে ক্ষনে ক্ষনে গাল-মন্দ করা হয় তোমাদের বাড়িতে। আমার এখনও এত সামর্থ নেই যে, নতুন আসবাব-পত্র কিনে দেবো। সে ভাবতে থাকে বিয়ে করে এসে দেখে ইকামা রিনিউ করাতে হবে, সেই ইকামা করতে দিয়ে প্রায় দশহাজার রিয়ালের ধাক্কা। এরপর বাসা পরিবর্তন করতে গিয়ে পিসি গাড়ি থেকে পড়ে সেখানেও কিছু জরিমানা তারপর তো বউয়ের ডেলিভারীর জন্য পঁচিশ হাজার পাঠালাম আগে পরের সব মিলিয়ে ঋনের বোঝা প্রায় টাকার অংকে দশলাখ।
এখন কোন ভাবেই সম্ভব না আসবাব-পত্র কিনে দেয়া। ওদিকে লাবন্যও জিদ ধরেছে সে আসবাব-পত্র ছাড়া যাবেনা। কি করবে আর ভাবতে পারেনা। পরিশেষে লাবন্যো তার বাবা-মাকে বলে গ্রামের বাড়ির জমি বিক্রি করিয়ে প্রায় দেড়লাখ টাকার ফ্রিজ, ইষ্টার্ন ফ্যান, ষ্টীলের আলমারি, ওয়াটার ফিল্টার, তোশক-বালিশ বেডসীট প্লেট বাটি সহ রান্নার সামগ্রী নিয়ে তিনটনি ট্রাক ভাড়া করে শশুর-শাশুড়ীর সাথে চলে যায় আপন গৃহে। আর মনে মনে ভাবতে থাকে কেমন স্বামী আমার? আমার ক্ষতির কথা একটি বারও বুঝতে চেষ্টা করলো না। লাবন্য ও হারে হারে বুঝতে পারে প্রবাসী বিয়ে করা ঠিক হয়নি! এখন মনে হচ্ছে দেশে যদি দিন এনে দিনে খেত এমন ছেলের সাথে তার বিয়ে হতো তবে হয়তো চোখে দেখে হলেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতো! অন্তত খেয়াল তো করতে পারতো এই কঠিন সময়ে! পরিশেষে ভাবতে থাকে এতেই আল্লাহ কল্যাণ রেখেছেন আর ছবর করতে থাকে জীবনের কোন একসময় হয়তো গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত শীত পেরিয়ে বসন্তকাল আসবেই ইনশা-আল্লাহ।
লাবন্যের বাবা মা মেয়ে জামাইর কথা শুনে একেবারে অসহায় হয়ে বলেন, যা মা তোকে আল্লাহর হাতে সপে দিলাম তিনি দেখবেন তোর সবকিছু। লাবন্য খুবই কাঁদে কিন্তু কেউই বুঝেনা তার কান্নার মানে। একরকম জোর করেই একমাসের সময় লাবন্যকে নিয়ে যায় শশুরালয়ে! লাবন্য নিজেই দূর্বল সেখানে সারাদিনের কাজ কর্ম, রান্না করা, বাচ্চার যত্ন করা, রাত জেগে সেবা করা আর নিজেও সময়মত ঘুমাতে না পারা সব মিলিয়ে সে হাপিয়ে ওঠে! জীবনটাকে বিষের মত মনে হতে থাকে! মনে হতে থাকে এই দূর্বিষহ জীবন থেকে যদি মুক্তি পেতাম, কোন ভাবে যদি পালানো যেত এই কঠিন অবস্থা থেকে! মাঝে মাঝে মনের মধ্যে আসে এরই নাম বুঝি বিয়ে? এরই নাম সংসার! কেন মানুষে সংসার করে? কি পায় তাতে যন্ত্রনা ছাড়া? লোক মুখে শুনি ছেলে মেয়ে পালিয়ে বিয়ে করে। কি যে বিরক্তকর এই জীবনধারা আর বইতে পারেনা লাবন্য সংসারের ঘানী।
আরো বড় কথা হলো শাশুড়ী আম্মা সেকেলে মনোভাব নিয়ে থাকা। বউকে এটা খেতে মানা ওটা খেতে মানা নাতীনের পেট খারাপ হবে! এটা খেলে পেটে ব্যথা করবে এসব বলে বলে লাবন্য আরো দূর্বল হয়ে পড়ে! ক্ষুধার তাড়নায় লাবন্যর সংসার ছেড়ে পালাতে ইচ্ছে হয়! কেন একজন বিদেশীর বউ হয়েও খাবারের এত কষ্ট? পোষাকে এত কষ্ট? সবকিছুতে এত কষ্ট? এতকিছুর পরও মেয়ের মুখপানে চেয়ে ছবর করে লাবন্য! এই সব নানা কারনে লাবন্য বাবার বাড়িতে আসলে আর যেতে চায়না শশুরালয়ে! স্বামী এ নিয়ে নানা কটূ কথা বলে লাবন্যকে! তোমার বউ হওয়ার যোগ্যতা নেই, তুমি উত্তম ঘরনী হতে পারোনি! নয়তো বিয়ের পরে মেয়েদের আসল বাড়ি তার স্বামীর বাড়ি সেখানেই তারা থাকে আর তুমি সেখানে থাকতে চাওনা! তোমার সেখানে থাকার যোগ্যতা নেই বলে! লাবন্য স্বামীকে বুঝাতে পারেনা আসলে কি সমস্যা!
এভাবে চলতে চলতে মেয়ে ইসরার যখন ছয়মাস হলো তখন একদিন শশুরালয়ে যাওয়া নিয়ে লাবন্য ও তার স্বামীর সাথে কথা কাটাকাটি হয়! লাবন্য যেতে চায়না! অনেক বলে যখন রাজি হয় তখন সে দিন ধার্য করে নেয় ওমুক দিন চলে আসবো! শেষে স্বামী অনেক রাগ করে! এক পর্যায়ে লাবন্য বলে তোমার বাড়িতে কেন যেতে চাইনা জানো? যেতে চাইনা হলো তোমার ঘরে আমার খাবারের কষ্ট হয়! আমার যতটুকুন চাহিদা ততটুকুন খাবার পাইনা তোমার ঘরে! লাবন্য এটা বলেই মোবাইল রেখে দেয়! (মোবাইল হলো আরেক বোনের তার মোবাইল বেশী সময় ব্যস্ত থাকলে তার স্বামী রাগ করে) বলে যে দুলাভাই বিদেশে থাকে বউকে একটা মোবাইল ও কিনে দিতে পারেনা?
এভাবেই কাটতে থাকে লাবন্যের বিবাহিত জীবন। অনেক কষ্ট আর গ্লানি নিয়ে। বাবা গরীব তাই মেয়ের শশুর-শাশুড়ীর সাথে বড়গলায় কথা বলতে পারেনা। হঠাৎ করে লাবন্যের শশুরালয়ে যাওয়ার দিনই লাবন্য মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে অনেক ব্লিডিং হয়, সে আর সোজা হয়ে দাড়াতে পারেনা। আর শাশুড়ী লাবন্যের বাবার মোবাইলে কল করতে থাকে লাবন্য কখন আসবে জানতে। লাবন্যের মা বলে লাবন্য খুবই অসুস্থ সে সুস্থ হলে আসবে। লাবন্যের মায়ের এই কথা তার শাশুড়ী পৌছে দেয় লাবন্যের স্বামীর কাছে আর লাবন্যের স্বামী তো রেগে অস্থীর হয়ে লাবন্যের বাবার কাছে কল করে বলে আজকে না তোমার আমাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল কেন যাওনি? কোন রঙ লেগেছে মনে? ওদিকে লাবন্য কথার বলারও শক্তি পায়না। সে শুধু কাঁদে আর বলে আমি অসুস্থ; সুস্থ হলে যাবো। কিন্তু সে বলে তুমি না গেলে আমার মায়ের রান্না করে খেতে কষ্ট হবে আমি আমার মায়ের কষ্ট সহ্য করবো না। তোমাকে আজই যেতে হবে আমাদের বাড়িতে। তুমি মরলেও তোমাকে আমাদের বাড়িতে গিয়ে মরতে হবে।
লাবন্যের মা তখন মেয়ের কষ্ট দেখে মোবাইল নিয়ে বলে আপনার কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়েছি বিক্রি করে দেইনি। আমার মেয়ে সুস্থ হোক তারপর যাবে, আপনার ভালো লাগলে মেয়েকে রাখবেন আর না লাগলে ও জানিয়ে দেবেন। মনে রাখবেন আপনার মা আপনাকে দুধ খাইয়ে বড় করেছে আর আমি কি আমার মেয়েকে ছাই খাইয়ে বড় করেছি? আপনাদের মতো সমাজের মানুষ রুপী কিছু অমানুষের কারনে আমাদের গরীবের কণ্যারা বলির পাঠা হয়ে গেছে। আপনি শুধু আপনার মায়ের কষ্টই দেখেন কিন্তু আমার মেয়ের কষ্ট একবারও বুঝতে চেষ্টা করেন না কেমন স্বামী আপনি? চলে আসেন দেশে আর গায়ের ঘাম, রক্ত বিক্রি করে হলেও স্ত্রীর পাশে থাকেন। বুঝতে চেষ্টা করেন সব মায়েরাই সব সন্তানকে কষ্ট করে লালন পালন করেছে। স্বামী শাশুড়ী ও লাবন্যর কথা শুনে চুপসে যায়! ফোন রেখে ভাবতে থাকে একি শুনলাম আমি?
চলছে .................চলবে।
আমার ওয়েব সাইট থেকে পড়ুন
বিষয়: বিবিধ
২৭০৭ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমার শশুর বাড়ী থেকে আমার শাশুরী আমার স্ত্রীকে হাসপাতালে নিলেন ।নেওয়ার আধা ঘন্টা পরে আমার একটি ছেলে হলো।
ছেলেটি আধা ঘন্টা পরে মারা যায়। তিন চার দিন পরে আমাদের দিকের একজন বললেন হাসপাতালে না নিলেই হতো।
এই হচ্ছে আমাদের দেশের মুরুব্বীদের কান্ড়।খুব দুঃখ পেলাম ঐ কথায়।কাউকে কিছু বলি নাই এমন কি আমার স্ত্রীকেও।আজ প্রকাশ করলাম।
০
আজকালের মোবাইলের যুগে কন্যা সন্তান নিয়ে পুরনো দিনের মত কাহিনী বা যৌতুক নিয়ে কাব যাব ........ জোশে একটু বেশী বেশীই বলে ফেলেছেন ।
লাবন্যের গায়ের রং ফর্সা হলে তাকে আরেক জায়গায় বিয়ে দেওয়া যায় এখনকার জামানার যেহেতু সে ।
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ
মনে কোন মেকি ছাড়া সমাজের বাস্তবতাগুলো অনর্গল বর্ণনা করে যাচ্ছেন, যে কথাগুলো অধিকাংশ নববধুর বুকে চেপে থাকে।
সুন্দর পোষ্ট, অনেক অনেক ধন্যবাদ
এ যেন চিরন্তন দ্বন্দ্ব, হাতের কামাই?
শিশু মেয়ে হলে খুশী না হওয়া জাহেলিয়াত
নিত্য চলতে থাকে সমাজে শাশুড়ীর উৎপাত!
-আমাদের যাপীত জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি-বিচু্্যতি তুলে ধরার জন্য লেখিকাকে ধন্যবাদ....
মন্তব্য করতে লগইন করুন