ঈদে সন্তানের চাওয়া!
লিখেছেন লিখেছেন মাহবুবা সুলতানা লায়লা ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৪:১৫:৪৫ রাত
পৃথিবীর প্রতিটি সন্তানের সবচেয়ে বেশী চাওয়া থাকে মা বাবার কাছে! হতে পারে তা সামান্য পেন্সিল থেকে নিয়ে অনেক দামী কিছু! কিন্তু কতজন মা বাবা চাওয়ার সাথে সাথে সন্তানের হাতে তা তুলে দিতে পারে? আর যারা চাওয়ার সাথে সাথে দিতে পারেন বুঝতে হবে তারা সামর্থবান তাই চাইতেই তাদের বুকের মানিকেরা পেয়ে যায় তাদের চাওয়ার বস্তুগুলো! তারা মনে মনে ভাবতে থাকে আমাদের বাবা মা কত ভালো! বাস্তবে কি তাই? সব বাবা মাই খুব ভালো কিন্তু কেউ সময়মত দিতে পারে! আর কেউ পারেনা সামর্থ না থাকার কারনে! আর এজন্য অনেক বাবা মা মনে মনে খুব কষ্টে ভোগেন! সন্তানের চাওয়ার মূল্য দিতে না পেরে উনারাও বেদনাক্লিশ্ট হোন!
এক সাত আট বছরের মেয়ে তার বাবাকে বলে বাবা এবার বৈশাখী মেলায় নিয়ে আমাকে একটি বড় পুতুল কিনে দেবে! বাবা বুঝাতে চায় আম্মু মেলা তো আমাদের জন্য নয় মেলা হলো হিন্দু ধর্মোবলম্বিদের জন্য আর মুসলমানের জন্য তো রয়েছে দুইটি ঈদ ঈদুল ফিতর আর ঈদুল আযহা! মেয়ে বলে তাহলে ঈদের সময়েই আমাকে একটি পুতুল কিনে দিও! বাবা চুপসে যায়! অভাবের সংসার! তিন চার জন ছেলে মেয়ে! আবার নিজেরা দুজন! সব মিলে ছয়জন প্রতি বেলায়! তিনবেলা আঠার জনের ধাক্কা! স্বামী-স্ত্রী দুজনের কামাই রোজগারে চলা এই সংসার! স্ত্রী সারাদিন মানুষের বাসায় ঝিঁ এর কাজ করেন। না করে উপায় কি? এই দুজনের উপরই চলে সংসারের সবকিছু। বছর বছর ঘরভাড়া বাড়তে থাকে, রান্না না করলেও গ্যাস বিল বাড়তে থাকে, ইনকাম না বাড়লেও খরচ বেড়ে চলেছে হরদম। সাথে আছে ছেলে মেয়েদের আবদার। তাদের আবদার থাকবেই কিন্তু পূরন করতে না পারলে ও তো মনে কষ্ট লাগে বাবা মায়ের! আর অভাবের তাড়নায় সবার মুখে হাসি ফোটানো সম্ভব হয়না! শিশুদের প্রশ্নে অনেক সময় জবাব ভুলে যেতে হয় কারন ওরা আবেগে প্রশ্নবিদ্ধ করে আর বড়রা বিবেগের জালে আটকা পড়ে চুপসে যায়।
বাবা চুপসে যায় মেয়ের কথায়! চোখে তার লোনা জল টলমল করে! নিরবে ঝরেও যায় কয়েক ফোঁটা অশ্রু। মেয়ে নাবিলা দেখে বাবা কাঁদছে সে বাবাকে বলে বাবা আমাকে আর পুতুল কিনে দিতে হবেনা। তারপরও তুমি কেঁদোনা বাবা এই বলেই বাবার চোখ মুছে দেন নাবিলা। পৃথিবীটা বড়ই বৈচিত্রপূর্ণ কেউ চাইতেই পেয়ে যায় আর কারো কারো প্রয়োজনেও পায়না প্রয়োজনীয় সামগ্রী। নাবিলার ছোট্ট ভাইটি এসে বাবাকে বলে বাবা আমাকে কিছুই কিনে দিতে হবেনা তবে বড় (কোরবানির ঈদে) ঈদে পেট ভরে গোশত দিয়ে পোলাও খাওয়ালে আমি অনেক খুশি হবো। আমার কোন জামা-কাপড় লাগবেনা। বাবা এবারো চোখ মুছতে থাকে তবে ছেলেকে শান্তনা দেয় ঠিক আছে বাবা আল্লাহ চাইলে ইনশা-আল্লাহ তোমাদের সবাইকে গোশত-পোলাও খাওয়াবো।
রমজানের ঈদেও তারা পায়নি নতুন কাপড়, পায়নি ভালো-মন্দ কিছু খেতে তাই দীর্ঘ অপেক্ষার পর যখন কোরবানির ঈদের দিন নিকটে তখন ছেলে মেয়েদের খুশি যেন ধরেনা। তারা গান গাইতে থাকে এবার আমরা বেশী করে গোশত পোলাও খাবোরে কি যে মজা হবে রে? আহাঃ কি যে মজা হবে রে? মা এসব দেখে ভাবতে থাকে বিবি সাহেবাকে বলবো এবার একটু গোশত যেন বাসার জন্য দেয় তাহলে হয়তো ছেলে-মেয়েদের মুখের হাসিটা থাকবে নয়তো সব হাসি-আনন্দ মুছে যাবে। আল্লাহ সাহায্য করুন। অপেক্ষা আর আকাংখার পর সেই কাংখিত কোরবানির ঈদ উপস্থিত! ছেলে-মেয়েদের তেমন বড় আবদার নয় কোরবানির ঈদে পেট ভরে গোশত-ভাত খাবে কিন্তু যাদের নূন আনতে পান্তা ফুরায় তাদের জন্য তো এই আবদার রক্ষা করাই কঠিন।
লোকটা ভাবতে থাকে দেখি আশে-পাশের বাড়ি ওয়ালারা দো কোরবানি করবে তখন হয়তো আমরাও কিছু পাবো। তখন হয়তো ছেলে-মেয়ের মন রক্ষা করা যাবে। বাবা চলে যায় কারো কোরবানির গরু বানাতে আর মা চলে যায় বিবি সাহেবাদের বাসায় কামে। তারা চার ভাই বোন চুপ করে বসে থাকে ঘরে। আর অপেক্ষা করতে থাকে মা এলেই খেতে পারবো। নয়তো বাবা এলেই খেতে পারবো গোশত-পোলাও। মিষ্টি মিষ্টি খাবাবের সু-ঘ্রানে চারিদিক মৌ মৌ। জিভে পানি আসার মতো খুশবু ছড়িয়ে আছে। তারপরও নাবিলাদের কোন হৈ চৈ নেই। তারা অপেক্ষা করছে তাদের বাবা মায়ের আসার। কিন্তু সকাল পেরিয়ে দুপুর এরপর বিকেল কৈ মা বাবা তো আজকে আসছে না। নাবিলার এগারো বছরের বড় ভাই ছোট ভাই বোনদের শান্তনা দিচ্ছে চিন্তা করিস না মা এই তো আইলো বলে। আর বাবা ও আসবো তোরা আরেকটু সবর কর। ভাইয়ার কথা শুনে ভাই বোনেরা শান্তনা পায় চুপ করে থাকে আবারো।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে। চারিদিকের আলো আবছা আবছা হয়ে যাচ্ছে। দূরের মানুষ গুলোকে ছায়া মূর্তির মতো মনে হয়। নাবিলা তাকিয়ে বলে ভাইয়া ঐযে মা আসছে এবার বুঝি খেতে পারবো। সারাদিনের ক্ষুধা আর ক্লান্তির কথা ভুলে তারা সকলে মিলে আবারো হৈ চৈ শুরু করে দেয়। মায়ের ছায়া মূর্তিটা আস্তে আস্তে তাদের কাছে চলে আসে নাবিলারা জানতে চায় মা মা গো আমরা কি এখন পেট ভরে গোশত-পোলাও খাইতে পারবো? আমাগো লাইগ্গা কি তোমার বিবি সাহেবায় খাওন দিয়া দিছে? মা কয় তোগো আছে সারাদিন খাওয়ানের কথা। তোরা সবাই দরজা থেকে সইরা যা। তোগো বাপে মানুষের গরু বানাইতে যাইয়া হাত কাইটা ফালাইছে। মাইনষে কইছে বহুত রক্ত বইয়া গেছে এখন তারে অনেক যত্ন করা লাগবো। এই নে বিবি সাহেবা দিছে মচমচা পোলাও আর সামান্য গোশত আর গোশতের ঝোল। তোরা খাইয়া ল্। আর তোর বাপে গরু বানাইয়া যেই গোশত পাইছে তা বেইচ্চা তার হাত কাটার জন্য ঔষধ লইয়া আছি।
বস্তির কয়েক জনে ধরে নাবিলার বাবাকে ঘরে শুইয়ে দিয়ে যায়। ছেলে-মেয়েরা দৌড়ে যায় বাবার বিছানার পাশে বাবা গো ও বাবা আমরা আর কোনদিন তোমার কাছে গোশত-পোলাও খাইতে চাইমুনা। তুমি আর কারো গরু বানাইতে যাইওনা বাবা। তোমার কি অনেক ব্যথা করতাছে বাবা? অনেক কষ্ট হইতাছে তোমার বাবা? বাবা কয় আমার কলিজার ধনেরা রে আমার হাতের ব্যথায় আমি যতটা না কাতর, তো গো রে গোশত-পোলাও না খাওয়াইতে পাইরা তার চেয়ে বেশী কাতর। তোরা আমারে মাফ কইরা দে। না বাবা; তুমি এমন কইরা কইওনা। চার সন্তান বাবা বুকে মাথা রাইখা কাঁনদে আর মা মুখ লুকায় আঁচলে। আর বাবা মাথা কাত করে চুপ করে চোখের পানি ঝরাতে থাকে। এভাবেই কেটে যায় আমাদের গবীর পরিবার গুলোর (ঈদুল ফিতর- ঈদুল আযহা) ছোটঈদ বড়ঈদ।
এভাবেই বছর ঘুরে ঘুরে আসে নাবিলারা সব সময়ই এক রকম থাকে। বছর ঘুরে ঘুরে নতুন বছর আসলেও নাবিলাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়না। তারা রয়ে যায় আগের মতই। শুধু বছর বছর বাড়ে কারেন্ট বিল, গ্যাস বিল, বাজারের দাম কিন্তু বাড়েনা ইনকাম। ভাগ্য তাদের সু-প্রসন্ন হয়না। তারা চোখের অশ্রুতেই কাটিয়ে দেয় জীবনের ছোটঈদ বড়ঈদ গুলো। মাঝে মাঝে হয়তো কেউ কেউ সহযোগীতার হাত বাড়ায় তবে সেই হাতের সংখ্যা খুবই নগন্য। গরীব মা-বাবার কাছে সন্তানদের আবদার গুলো দু'চোখের কান্না হয়েই রয়ে যায়।
"ঈদের আসল মানে"
ঈদ মানে নয় খুশির জোয়ার
একা র আনন্দ !
ঈদ মানে নয় নতুন জামা
হৃদয়ে একাকি সুখ ছন্দ!
নিয়েছ কি তোমরা সবে
প্রতিবেশীর খোজ?
যে পরিবার অনাহারে
কাঁদছে রোজ রোজ?
একবারও কি নিয়েছো খবর
ঈদের আনন্দেতে?
এতিম বলে অনাদরে
সময় যাদের কাটে?
একবারও কি ভেবেছো সবে
প্রতি ঈদের শেষে?
এই দিনটা বছর ঘুরে
বারংবার কেন আসে?
ঈদ মানে নয় তো
পশু কুরবানি দেয়া!
ঈদ হলো সকলের
ঘরে ঘরে আনন্দের ছোঁয়া!
এই ঈদে কি পারিনা
আমরা মিলে সবাই?
কুরবানির নামে মনের
পশুত্বকে করে দিতে জবাই?
হিংসা আর লোক দেখানো
কোরবানি বাদ দিয়ে!
আল্লাহর জন্য কোরবানি করবো
সকল জনকে নিয়ে?
হৃদয়কে আলোকিত করি
কোরআন হাদীসের জ্ঞানে।
সকলেই বুঝতে চেষ্টা করি
ঈদের আসল মানে!
বিষয়: বিবিধ
১৩০৬ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমরা বাস্তবতাকে ভুলে যাই। মহান আল্লাহ আমাদের বুঝার তাওফিক দান করুন।
ভালো লাগলো ।
আসলে তোমরা পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দাও,অথচ পরকালের জীবন উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী। সূরা আল-আ’লা: ১৬-১৭
এই ত্রুটি থেকে নিজেদের সংশোধন করে সমাজের জন্য কাজ করা দরকার।
মন্তব্য করতে লগইন করুন