প্রবাস ও আত্মার প্রশান্তি!
লিখেছেন লিখেছেন মাহবুবা সুলতানা লায়লা ১৮ মে, ২০১৫, ০৯:৩৭:২৭ রাত
কা'বা ঘরের ছবি।
মসজিদে নব্বীর ভেতরের অংশ। উপরে সবুজ গম্বুজ দিয়ে শনাক্ত করা রাসূল (সঃ) এর রওজা। আর পাশেই রিয়াদুল জান্নাহ।
এই সেই রিয়াদুল জান্নাহ এর জলপাই রঙ ও সাদা রঙে মিশ্রিত কার্পেট! যেখানে দুই রাকাত নামাজ পড়ার জন্য সকল মুসল্লি আকাংখিত। এখানে দুই রাকাত নামাজ পড়ে যে দোয়া করা হয় তা কবুল করে নেন আল্লাহ তা'য়ালা।
কি বর্ণে বর্ণনা করবো মনের ভাষা। ভাষা যেন খুজেই পাইনা। বরকতময়তা। আলহামদুলিল্লাহি। একমাত্র মহান আল্লাহর প্রতি সিজদাহ এ অবনত হয়ে আর তার দানের প্রশংসা করে সাথে শুকরিয়া আদায় করলেও এর শুকরিয়া আদায় হবেনা। আলহামদুলিল্লাহ! মহান আল্লাহ আমাদেরকে মদিনাতে থাকার সু-ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এই জন্য মহান আল্লাহর অসংখ্য শুকরিয়া আদায় করি। তিনি যেন সব সময় এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দেন।
প্রবাস যেন একটি কারাগারের মতই। যেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা বলতে কিছুই থাকেনা। তারপরও জীবনের চাহিদা মেটাতে আমার ভাইয়াদেরকে স্বদীচ্ছায় পাড়ি জমাতে হয় প্রবাসের সেই কারাগারে। পরিবারের সবার জরুরত পূর্ণ করতে, তাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখতে, যখন যা প্রয়োজন তার চাহিদে মেটাতে অনেকেই বেছে নেয় সেই প্রবাস বরণকে। স্বদেশীরা মনে করে সেখানে শুধু টাকাই টাকা। আসলে কি তাই? না! টাকা সেখানে উড়ে না। বরং খুব পরিশ্রমের বিনিময়ে টাকা পাওয়া যায়। টাকা আছে তবে রক্তে অর্জিত সেই টাকা। জীবনের মহা-মূল্যবান সময়গুলো পাড় করে দিতে হয় প্রবাসে সেই টাকার জন্য। সেখানে নেই মা-বাবা ভাই-বোন বা অন্য কোন আত্মীয়-স্বজন। তারপরও একেঅপরের বন্ধু হয়েই চলে এখানে।
সারাদিনের অনেক পরিশ্রম আর ক্লান্তিতে যখন শরীর খুজে বেড়ায় আরামের বিছানা। মন খুজে বেড়ায় একটু সুখের ছোঁয়া। সারাদিন শেষে এ'শার সময় অনেকেই কাজ থেকে অবসর পান। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে খুজে নিতে চেষ্টা করেন কিছুটা আরাম। তখনই মনের মাঝে উপলদ্ধি আসে আহাঃ যদি দেশে থাকতাম তবে সন্তান কোলে নিয়ে আনন্দোপভোগ করতে পারতাম। আহঃ যদি দেশে থাকতাম তবে মা-বাবা ভাই-বোনকে নিয়ে একসাথে থেকে খেতে পারতাম। গল্প করতে পারতাম। যাদের বউ আছে তারা ভাবেন শশুর বাড়িতে বেড়াতে পারতাম। কিন্তু প্রবাস যেন সবকিছুরই বাঁধা হয়ে আছে। এসব ভেবে তখন মনের মাঝে যে হতাশা আসে, যে কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সেই অবসর সময় থেকে কোন প্রবাসী ভাই-ই মুক্ত নয়।
ভাবনা কখনো কখনো চোখের কোনে অশ্রুধারা প্রবাহিত করে দেয়। কখনো বা মনের মাঝে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। কিন্তু কিছুই করার থাকেনা। নিজের স্বদেশের দিকে তাকালে তখন সকল কষ্টই মেনে নিয়ে প্রবাসেই থাকতে হয় বছরের পর বছর ধরে। অনেকে ঘুম ছাড়া বাকি সময় কোন না কোন কাজে ব্যয় করেই থাকেন কারন হিসেবে তারা বলেন অবসর থাকলে নানা রকম ভাবনা আসে আর সে সব ভাবনা ভেবে ভেবে মনে কষ্ট পাই তাই কোন সময়ই হাতে রাখিনা। জেগে থাকলে কাজ করা আর ঘুমিয়ে থাকাটা শুধুই বিশ্রাম করার জন্য।
প্রবাস জীবনটা যে কত কষ্টের তা স্বদেশীরা স্ব-নজরে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেনা। যদি একবার দেখতো প্রবাসীদের কি পরিমাণ কষ্টের কামাই দিয়ে তারা বিলাসিতার জীবন চালায় তবে হয়তো বুঝতো। প্রবাসীদের ঘাঁম ঝরা অর্থ আর রক্ত ঝরা অর্থোপার্জন দিয়ে স্বদেশীদের কত আরাম আয়েসের জীবন চলে তা কল্পনাও করা যায়না। তারা যদি স্ব-চোক্ষে একবার দেখতো তবে হয়তো বিলাসিতার জীবন পরিত্যাগ করতো। আমার বোনেরা যদি একবার দেখতো তবে হয়তো কখনো ভালোভাবে খেতেও পারতো না। দামী পোষাক পরিধান বন্ধ করে দিতো। অলংকারের চাহিদা তাদের থাকতো না। কিন্তু স্ব-নজরে দেখেনা বলে সবকিছুই তারা করছেন অবলীলায়।
দেশে অনেক অনেক পড়া-শুনা করে এদেশে এসে এমন কাজ করেন যা সবার কাছে উল্লেখ করা যায়না। প্রবাসীরা অসহায় হয়ে থাকে প্রবাস বরণ করে। আরো অসহায় হয়ে থাকে পরিবারের সবার চাহিদা মেটাতে। অনেকে না বললে ও তাদের কষ্টের দীর্ঘশ্বাসে বুঝা যায় তারা কতটা কষ্ট বুকে নিয়ে প্রবাসে পড়ে আছেন। তারা বাস্তবিকই কতটা অসহায়। তা মুখে না বললে ও যারা প্রবাসে পরিবার নিয়ে থাকতে পারছেন আমার সেই বোনেরা কিছুটা উপলদ্ধি করতে পারছেন। বাকি যারা দেশে থেকে শুধু টাকা চাই টাকা চাই, গয়না চাই, বাড়ি চাই, গাড়ি চাই করছেন তারা প্রবাসীদের কষ্টের ক' ও বুঝতে পারছেন না।
প্রবাসী সেই ভাইয়ারা যার যার পরিবারের চাহিদা মেটাতে অনেক সময়, বিয়ে পর্যন্ত করতে পারেন না সময়মত। বিয়ের বয়ষ পাড় হয়ে যায় তারপর বিয়ে করেন। অনেকে ভাই বোনদের দেখতে দেখতে জীবনের মহা মূল্যবান যৌবনের সময় শেষ করে ফেলেন। পরিশেষে যখন বউ বাচ্চা হয় নিজের, তখন বউ-বাচ্চাদের সময় দেয়ার ও সময় থাকেনা। অনেক সময় দেখা যায় এ নিয়ে বউয়ের সাথে নানা রকম উচ্চ-বাচ্চ চলে। সেই কষ্টও মনের মাঝে বয়ে বেড়ান অনেকেই।
প্রবাসীদের কষ্টের শেষ নেই। হাজার রকমের কষ্ট বুকে নিয়ে তারা প্রবাসে কাটায়। এখানে আরামকে হারাম করে চলতে হয়। চলে সবাই। কারন একদিন বসে থাকলে কে দেবে এক প্লেট খাবার? তাই পাড়ত পক্ষে কেউই বসে থাকেনা। ওদিকে প্রবাসীদের পরিবারের চাহিদার শেষ নেই মাকে কল করলে বলেন তোর ছোট বোনদের ঈদ খরচ দিতে হবে। তোর বাবার অসুস্থতার জন্য ভালো চিকিৎসা করাতে হবে। বাবাকে কল করলে বাবা বলেন তোর মায়ের ওষুধ খরচ লাগবে। বাবা আরো বলেন তোর ছোট বোনের বিয়ে দিতে হবে। ছোট ভাইকে কল করলে বলে পরীক্ষার খরচ ও তারপর ভর্তির খরচ দিতে হবে ভাইয়া। ছোট বোনকে কল করলে সে বলে আপনাদের জামাই একটি মটর সাইকেল চাইছে। ভাইয়া কি করবো? অপরদিকে বাসার মেহমান খরচ। বউয়ের কসমেটিক খরচ, সন্তানের খাবার খরচ। শালির বিয়েতে উপহার দিতে হবে এমন হাজার খরচের তালিকা পেশ করা হয় প্রবাসীদের কাছে। তিনি বাধ্য সবার চাহিদা মেটাতে।
প্রবাসী শুধু মায়ের কথা গুলো শুনে বলে দেয় আচ্ছা চেষ্টা করবো দিতে, আপনারা কোন চিন্তা করবেন না। কিন্তু একবারও কি কারো মনের মাঝে উদয় হয় যে, ছেলেটি কোথা থেকে এত কিছু করবে? সবাই সবার চাহিদাকে পেশ করে যায় কিন্তু একবারও মা-বাবা ছেলের চাহিদার প্রতি তাকায় না। ভাই-বোনেরা ভাবেনা ভাইয়ের বিয়ের বষয় শেষ হয়ে যাচ্ছে। সে কিভাবে সন্তান প্রতি-পালন করবে? আর যাদের বউ আছে তাদের জন্যেও ভাবেনা পরের মেয়েটা কতটা কষ্ট করছে স্বামীকে প্রবাসে রেখে।
আমার লেখাটা কারো কারো কাছে বিষের মত লাগবে। কিন্তু আমি এই লেখার মাধ্যমে বুঝাতে চাইছি যে, প্রবাস জীবন কতটা কঠিন। কতটা কংকরময় এই জীবনের ধাপগুলো। কত কষ্ট বুকে বয়ে নিয়ে জীবনের সময়গুলো পাড় করেন প্রবাসীরা। সারাদিনের কঠিন পরিশ্রম শেষে অনেকে বিকেলে বা সন্ধ্যায় আসেন প্রিয় নবী (সঃ) এর মসজিদে (মসজিদে নব্বীতে) কিছুটা সময় কাটিয়ে যান। এখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে খুজে নিতে চান মনের প্রশান্তিকে।
আমি নিজেকে দিয়ে বুঝতে পারছি প্রবাস কতটা কষ্টময় জীবন। সারাদিন একাকি বাসায় থাকি, মেয়ের লেখা পড়া, রান্না করা, ঘরের বাকি কাজের পর যখনই অবসর পাই তখনই মনের মাঝে উঁকি মারে স্বজনদের দুরে রাখার কষ্টগুলো। কখনো চোখের কোনে ভেসে উঠে প্রিয় প্রিয় মুখগুলোর ছবি। কতদিন দেখিনা তাদেরকে। হাজারো কষ্টের পরে প্রিয় মুখগুলো চোখের পাতায় ভেসে উঠে মনের মাঝে কিছুটা আনন্দ আনয়ণ করলেও কষ্টই বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। মনে পড়ে যায় আহঃ যদি একসাথে থাকতে পারতাম। সেই কষ্টগুলো মনের মাঝে যে হতাশা তৈরি করে সেই হতাশা দুরীভূত করতেই অনেকে মসজিদে নব্বীতে এসে সময় কাটান। এখানে আসলে মনের মাঝে যেন প্রশান্তিতে ভরে যায়।
মসজিদে নব্বীতে আসলে কোথা থেকে যেন অনাবিল তৃপ্তি এসে মনের সকল হতাশাকে দুর করে দেয়। এটা সেই মহান আল্লাহরই বিশেষ অনুগ্রহ। কিছু সময় পূর্বে ও মনের মাঝে অনেক হতাশা জমে ছিলো। চোখের কিছুটা অশ্রুও ঝরে ছিলো, কিছুটা মুখের উপর প্রকাশিত ও হয়েছিলো কিন্তু যখনই এই মসজিদে আসি মনের সকল হতাশা, সকল কষ্ট, সকল না পাওয়ার কষ্ট যেন মসজিদে নব্বীর (হারামের) আশা-পাশের শীতল বাতাসের সাথে হারিয়ে যায়। মনের মাঝে এনে দেয় প্রশান্তির পরশ।
প্রবাসী ভাইয়ারা আরো শান্তি খুজে নেন রিয়াদুল জান্না এর মত মূল্যবান স্থানে দুই রাকাত নামাজ পড়ে। মনের সকল কষ্ট, সকল ক্লান্তি, সকল চাহিদা, সকল চাওয়া পাওয়া, সকল প্রার্থনা মসজিদে নব্বী ও সকলের মালিক আল্লাহর কাছে পেশ করে। এভাবে যারা মক্কা-মোকাররমায় বসবাস করেন তারাও কা'বার সামনে গিয়ে মনের প্রশান্তি অনুভব করেন। মায়ের কথা মনে পড়েছে? কাকে বলবেন এখানে তো আপনজন কেউই নেই তাই কা'বা ঘরে গিয়ে দুই রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে ধৈর্য চেয়ে নেন। আর নেক হায়াতের দোয়া করেন আপনার মায়ের জন্য।
আমরা অনেক গুলো বাংলাদেশী পরিবার এখানে থাকি (যাদেরকে প্রবাসী পরিবারও বলা যায়)। কেউই আমার কাছাকাছি নেই। তারপরও একটু অসুখ হলে আপন জনের মত খোজ খবর নেন। এখানে প্রায় সবার মাঝেই স্বদেশ প্রেম জাগ্রত। স্বজন প্রিয়তার দুরুত্বের কষ্ট বিদ্যমান। তারপরও তারা প্রবাসে পড়ে থাকেন পরিবার নিয়ে। আর যারা আপন বউ ছেলে মেয়ে দুরে রেখে আছেন তাদের সবার কষ্টই এই পবিত্রতম স্থানগুলোতে গেলে কিছুটা শান্তনা পায়। আপনি প্রবাসী? আপনি মদিনায় থাকেন? আপনি মক্কা-মোকাররমায় থাকেন? তবে দিনের কিছু সময় সেখানে কাটান আল্লাহর সাথে ভালো সম্পর্ক করতে। তার প্রিয় রাসূল (সঃ) এর সাথে বন্ধুতের সম্পর্ক রাখতে, মনের না বলা অনেক কষ্টকে ভুলে থাকতে, আর নিজের সকল গুনাহ সমূহ ক্ষমা করিয়ে নিতে। মক্কা-মদিনা হোক আপনার আমার কষ্ট ভুলে থাকার স্থান।
আমারও যখনই স্বদেশের কথা মনে পড়ে। স্বজনের কথা মনে পড়ে, মায়ের চির আপন মুখটি চোখের কোনে ভেসে উঠে, ছোট ছোট ভাই-বোনদের মায়ার বাঁধনের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে সহপাঠীদের সাথে থাকা মধুময় সময়গুলো তখন মসজিদে নব্বীতে আসি। মনটাকে প্রশান্ত করে নেই কিছু সময় কাটিয়ে। মন যেন ভরেনা এখানে সময় কাটিয়ে। আর যখন কোন শান্তনা বোধ না হয় তখন চলে যাই রিয়াদুল জান্নাহ তে সেখানে মনের সকল ক্লান্তি, সকল কষ্ট, সকল ব্যর্থতা, সকল আকাংকা মহান আল্লাহর কাছে পেশ করে মনকে খালি করে নেই। অনুভব করি কি প্রশান্তি? কি তৃপ্তি?মসজিদে নব্বীতে মক্কার কা'বা ঘরে।
বিষয়: বিবিধ
১২৮২ বার পঠিত, ২৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এত আরামসে তিনজন লোক বসে আছে !!! কোন সময়ের ছবি এটি ?
প্রবাস জীবনের কষ্টের কথা বলছেন এবং সাথে দেশের জন্য , দেশের পরিবার পরিজনের জন্যও হাহাকারের কথাও বলছেন ।
যেই না বলবো যে দেশে ফিরে আসেন অমনি '' আমি দেশে গেলে অভাগা এই প্রবাসের কি হবে '' এ রকম একটা অজুহাত চলে আসবে ।
আপনি গিয়ে থাকলে বুঝতে অসবিদা হওয়া কথা ছিলনা........
আমরা কেন জানি কষ্ট করে নষ্ট হওয়া কেই জিবনের সাফল্য মনে করি।
এই কথাটি প্রবাসীরা বুজলেও বুজেনা শুধু ঐ পাষান মনের মানুষগুলো যারা আমাদের রুজি করা টাকায় দেশে আরামে খায় ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন