"জুলুমের পরিণতি"
লিখেছেন লিখেছেন মাহবুবা সুলতানা লায়লা ১৩ মে, ২০১৫, ০১:৩৫:২৪ রাত
মানুষ যেন হঠাৎ করেই সচেতন থেকে অচেতন হয়ে যাচ্ছে। হয়ে যাচ্ছে মানুষ থেকে অমানুষ। দিন দিন মানুষের মনুষত্য হারিয়ে যাচ্ছে যেন নদীতে ভাটা পড়ার মত। আজকালকার মানুষেরা যেন কেউই কারোর ভালো চায়না। সবাই যেন সামনে হাসি মুখে কথা বললেও পিছনে ক্ষতিটাই বেশী কামনা করে। সবাই চায় একজন থেকে আরেক জন যেন অর্থে, সম্পদে, ধনে, জনে, এমন কি জ্ঞানেও বড় থাকতে। যার যতটুকুন আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট না থেকে বরং অহংকার নিয়ে চলতে পছন্দ করেন এই যুগের মানুষেরা।
মানুষ কথার মাঝে যুক্তি দেয় অহংকার পতনের মূল কিন্তু সেই অহংকারের রঙেই কিছু মানুষ নিজেকে রাঙিয়ে রাখে যা শোভনীয় নয়। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। এরপরও সেই মানুষই আবার কখনো কখনো নিজের কর্মের কারনে হয় নিকৃষ্ট জীব। ছোট হোক আর বড় হোক কেউ যদি কারোর উপর জুলুম করে তবে কোন না কোন সময় মাজলুমের বদ্দোয়ার স্বীকার হবে এটাই স্বাভাবিক। একজন মাজলুম ব্যক্তি সরকারি চাকুরীর পাশাপাশি একটি ছোটখাট ক্ষেতে কিছু সবজির চাষ করতেন। তার সংসার বড় তাই সেই সবজি বাগান থেকে যা কিছু আসে তা থেকে নিজেরাও খেতেন আবার পাড়া প্রতিবেশীদেরকেও দিতেন।
কারন মাজলুম লোকটি মনে করতো বাগানের আশেপাশে যারা থাকে তারাও বাগানের একটি অংশ রয়েছে। আর প্রতিবেশীর হক্ব তো সাথে আছেই তাই তিনি সব সময় যা কিছু ফলন ফলে তার থেকে প্রতিবেশীদেরকে ও কিছু দিতেন। কিন্তু একজন এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি তার গরু দিয়ে সে সবজি বাগান খাইয়ে ফেলতো মাজলুম ব্যক্তিটি যখন না থাকতো বাড়িতে, তখনই গরুটাকে তার ক্ষেতের পাশে এসে বেঁধে রাখতো আর পশু তো পশুই সে সামনে যা পায় তা তার মনে করে খেতে থাকে। সে বুঝেনা এই সম্পদ কার? কিন্তু মানুষ তো বুঝে এতে কারো ক্ষতি হচ্ছে বা হবে।
তারপরও কেন যেন সে মাজলুম ব্যক্তির ক্ষেতের ফসল খাইয়ে খুব মজা পেত মনের মাঝে। মাজলুম ব্যক্তি ভাবতে থাকে একবার ভালো করে বলে দেখি তিনি সঠিক পথে আসেন কিনা। তাই তিনি কয়েকবার তাকে ভাল করে, সুন্দর ভাষায় বলেছেন ভাইজান আপনার তো অনেক সম্পদ আছে আপনার কোন ক্ষতি হবেনা কোন কিছু নষ্ট হলে আর আমরা তো দিন আনি দিন খাই, এর উপর সংসার বড় আমাদের একটু ক্ষতি হলে অনেক খেসারত দিতে হয় আপনি এরপরে আর আপনার গরুটা ক্ষেতের পাশে বাঁধবেন না। কারন আশেপাশে তো আরো অনেক জায়গা আছে সেখানে বাঁধেন তাহলে তো আর কোন সমস্যা থাকলো না।
আর এখানে যা কিছুই চাষ করি তার একটি অংশ তো আমি আপনাকেও দেই তবে কেন আপনি গরু দিয়ে তা খাওয়ান? আপনি বড় ভাইয়ের মত আমরা আপনার ছোট ভাইয়ের মত বড়ভাই হয়ে কি আরেক ছোট ভাইয়ের ক্ষতি করতে পারে কেউ? জুলুমবাজ লোকটি হাসে আর বলে গরুর রিযিকে ছিলো তাই গরুর পেটে গেছে তোমার ফসল তাতে আমি কি করবো? আমার গরু খাবেই তুমি পারলে তোমার ক্ষেত সামলিয়ে রাখো। এভাবে আরো কয়েকবার সেই জালেম লোকটি তার গরু দিয়ে মাজলুমের ক্ষেতের ফসল খাওয়ায়। মাজলুম ব্যক্তি নিরবে কয়েকবার এই অবস্থার উপর ধৈর্য ধারন করে।
মাজলুম ব্যক্তিটি কখনো ক্ষেতে লাউয়ের চাষ করেন প্রথমে লাউ শাক হয় এরপর লাউ ধরে। তিনি সবাইকে এর একটি অংশ করে দেন। এবার ক্ষেতে অনেক লাউ বের হয়েছে কিছুদিন খুবই যত্ন করলেন মাজলুম ব্যক্তিটি এমন কি রাতে উঠে উঠে পাহাড়া দিতেন ক্ষেতের। একদিন মাজলুম লোকটি কিছু লাউ শাক নিয়ে জালেম লোকটির মায়ের কাছে যায় এবং সেগুলো তার হাতে দিতে দিতে বলে চাচী আম্মা বড় ভাই দেখেন গরু দিয়ে আমার ক্ষেতের ফসলগুলো খাইয়ে ফেলে আপনি নিষেধ করবেন। চাচী আম্মা ভাইজান যেন এমনটি আর না করে আপনি বললে হয়তো ভাইজান শুনবে। চাচী আম্মা বলে ঠিকআছে আমি বলো দেব যাতে আর এমনটি না করে। মাজলুম তার কথা শুনে চলে আসে।
এভাবে প্রায় সবজির বাগান যখন ফুলে ফলে ভরতি হয় তখনই সেই জুলুমবাজ লোকটি তার গরু দিয়ে খাইয়ে ফেলে ক্ষেত। মাজলুম লোকটি এবার মনের মাঝে অনেক কষ্ট পায় সে রাগে ক্ষোবে গরুটিকে বেঁধে রাখে বাড়ির পেছনের একটি বরই গাছের সাথে। কিন্তু যখনই জুলুমবাজ লোকটি জানতে পারে যে একজন মাজলুম তার গরু বেঁধে রেখেছে তখনই সে শরীর আর ক্ষমতার জোরে মাজলুম ব্যক্তিকে প্রহার করে এমন কি জরিমানাও নেয় আদায় করে। তারপরও ক্ষান্ত হয়না সে পরিশেষে ক্ষেতের ফসলগুলো কেটে ফেলে দেয় এতে করে মাজলুম লোকটি মনের মাঝে অনেক ব্যথা পায় এমন কি তার চোখের কোনে পানি এসে যায়। সে নিরবে কাঁদতে থাকে তার দু'চোখ থেকে কষ্টের অশ্রু ঝরে পড়ে।
শরীরে প্রহারের ব্যথা আর মনোকষ্টের তীব্রতায় সে মহান আল্লাহর কাছে দু'হাত তুলে বলেই ফেলে এই লোক যেভাবে আমাকে জ্বালিয়েছে তাকে তুমি দুনিয়াতেই সেভাবে জ্বালিয়ে পুঁড়িয়ে নিও। কিছুটা সময় নিয়ে হলেও মাজলুমের দোয়া আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে গেলো। তারও প্রায় অনেক বছর পরে সেই জালেম লোকটির যখন বয়ষ হলো সে বিছানায় পড়ে গেলো তখন জালেম লোকটি হঠাৎ হঠাৎই চিৎকার করে করে বলতো আমার শরীরে আগুন লেগেছে তোমরা নেভাও, তোমরা আমাকে বাঁচাও তখন তার ছেলের বউয়েরা এসে দেখতো কোনই আগুন নাই লোকটা এমনি এমনি এসব বলছেন। তখন তারা রাগ করে চলে যেত আর বলতো শুধু শুধু আমাদেরকে পেরেশানি করাতেই উনার এই কাজ। নয়তো কেন এসব বলে বলে আমাদেরকে প্রতিদিনই পেরেশানিতে রাখে?
এভাবে কয়েক বছর বিছানাতে কাটিয়ে দিলেন মালেম লোকটি! আর প্রায় প্রতিদিনই বলতেন আমার শরীরে আগুন লেগেছে তোমরা নেভাও! বাস্তবে আগুন লাগেনি! ছেলের বউ ও মেয়েরা তার এই কথা শুনতে শুনতে অনেক বিরক্তবোধ করতো! আর ঘরে গিয়ে ছেলেদের বলতো, দেখ তো আব্বা শুধু শুধু আগুন লেগেছে বলে চিৎকার করে, কিন্তু আগুন তো লাগেনা! এসব শুনে একদিন ছেলেরা বাপের ঘরে এসে বললো আপনি প্রতিদিনই তো বলেন আগুন লেগেছে, আগুন লেগেছে কই একদিনও তো দেখিনা আগুন লাগতে, তবে কেন প্রতিদিন এভাবে চেঁচামেচি করে সবাইকে বিরক্ত করেন? লোকটি চুপ করে থাকে!
ছেলেরা ও এক রকম খুবই বিরক্তবোধ করে! এভাবে আরো অনেকদিন চলে যাওয়ার পর হঠাৎ আবারো আগুন লেগেছে বলে চিৎকার করতে শুরু করে সেদিন আর কেউই আসেনি! সেদিন জালেম লোকটি লোকটি চিৎকার করতে করতে শেষে বোবার মত হয়ে যায় তখন আর কোন কথাই বুঝা যাচ্ছিলো না! যখন পুঁড়ে প্রায় শেষ, তখন সবাই এসে দেখে আজকে সত্যিই আগুন লেগেছে! আর পরনে ছিলো পলেস্টার কাপড়ের লুঙ্গি তা গলে চামড়ায় পড়ে পড়ে চামড়া সহ খসে পড়ছে! এভাবেই পুঁড়ে লোকটি মারা গেলো! আল্লাহ আমাদের সকলের সহায় হোন!
আমরা যেন ছোট বড় কারোর উপর কোন রকমের জুলুম না করি! সেই মাজলুম লোকটিও আজ বেঁচে নেই আর জালেম লোকটিও বেঁচে নেই! দু'জনেই চলে গেছেন আল্লাহর কাছে! আমরা দোয়া করি মহান আল্লাহ উভয়কেই ক্ষমা করে তার জান্নাতের বাসিন্দা হিসেবে কবুল করুন! আমিন! আর আমরা যারা বেঁচে আছি তাদের সকলকে জুলুমের গুনাহ থেকে হেফাজত করুন! আমিন ছুম্মা আমিন!
শিক্ষনীয়ঃ- প্রতিটা মানুষের জীবনই এক একটি গল্প! মানুষের জীবনই উপন্যাস! মানুষ দিয়েই পৃথিবীর সকল ইতিহাস! আর এই গত হয়ে যাওয়া মানুষের পরিণতি থেকেই আমাদের শিক্ষা নিতে হবে! চলতে হবে ন্যায়-পরায়ন হয়ে! মানুষের কঠিন বাস্তবতা গুলো পড়ে পড়ে নিজেরা সতর্ক হই! যেন আমাদের কারোর দ্বারা কারোর উপর জুলুম না হয়! আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন! নিজের যা আছে তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থেকে আল্লাহকে খুশি করে যেতে পারলেই আসল কামিয়াবী আমাদের! মহান আল্লাহ সকলের সহায় হোন!
বিষয়: বিবিধ
১২৭৪ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
"الظلم ظلمات يوم القيامة"
" জুলুম ক্বিয়ামত দিবসে অন্ধকার হয়ে দেখা দেবে!"
এটা হল পরকালীন শাস্তি কিন্তু দুনিয়াতেও অন্যায়-জুলুমের ফল অবশ্যই ভোগ করতে হয়!
অন্যের উপর জুলুম করার ভয়াবহ পরিনাম চিন্তা করলেই মানুষ এ থেকে বিরত থাকতে পারে!
শিক্ষণীয় চমৎকার সাবলীল উপস্হাপনায় 'জাযাকিল্লাহ' এবং সুন্দর দোয়ায় 'আমিন ছুম্মা আমিন' জানাচ্ছি হে শ্রদ্ধেয়া জ্বী!!
মজলুমের দোয়া আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়। এই জন্যোই যুগে যুগে জালেম শাসকদের পরিণতি হয়েছে অত্যন্ত ভয়াবহ। তবুও জালেম রা শিক্ষা নেয় না।
বিষয়টা আসলে এমন না, দোয়া তাহলে আল্লাহ কবুল করেছেন সাথে সাথেই তবে বাস্তবায়নটা হয়েছে অন্য সময়, যে সময়টা আল্লাহর মতে উপযুক্ত ছিলো।
ভালো লেখা।
একবার দুবার এরকম হতে পারে । এরপর তো শক্ত বেড়া তৈরি করাই তার জন্য উচিত ছিল । আর জালিম এটা করতো যখন মাজলুম বাড়িতে থাকতো না ।
মাজলুম তো তার ক্ষেতের ফসলগুলো তার প্রতিবেশীদেরকেও কিছু কিছু দিত ।
তো মাজলুমের অনুপস্থিতিতে জালিম যখন তার ক্ষেতে গরু ছেড়ে দিত তখন মাজলুমের প্রতিবেশীরা কি করতো ? চেয়ে চেয়ে দেখতো ?
মন্তব্য করতে লগইন করুন