আত্মার খোরাক (৮)
লিখেছেন লিখেছেন মাহবুবা সুলতানা লায়লা ০৫ এপ্রিল, ২০১৫, ০৩:২৭:৪৮ দুপুর
সন্তান-সন্তুতিদের হক্ব সম্পর্কে হাদীসঃ-
আমরা আমাদের সন্তানদের সাথে কিভাবে আচরণ করবো সেটাও জানিয়ে দিয়ে গেছেন আমাদের প্রানপ্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)! আমার এই শ্রেষ্ঠ মানুষের জীবনীতে পাই কিভাবে চলতে হবে, কিভাবে বলতে হবে, কিভাবে লেন-দেন করতে হবে, এই শ্রেষ্ঠ মানুষের জীবনেই রয়েছে আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ! আমরা সকলেই যেন তার উত্তম আদর্শে আদর্শিত হতে পারি আর আমাদের সন্তান-সন্তুতির মাঝেও সেই প্রিয় নবী (সঃ) এর আদর্শের আলো ছড়িয়ে দিতে পারি! আসুন সবাই একটু সময় ব্যয় করে জেনে নেই কিভাবে সন্তানের হক্ব আদায় করতে হয়। হতে পারে আপনার আমার সন্তানই আমাদের জান্নাতে যাওয়ার বা জাহান্নামে যাওয়ার কারন! আল্লাহ মাফ করুন আমাদেরকে। আর মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে তৌফিক দিন সন্তানদের মাঝে ইনসাফ করতে।
"হযরত নোমান ইবনে বশীর (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, একদা হযরত নোমানের পিতা তাকে সঙ্গে করে রাসূলুল্লাহ এর দরবারে হাযির হলেন এবং বললেন, হুযুর! আমি আমার এই ছেলেটিকে আমার নিজস্ব একটি গোলাম দান করেছি। আল্লাহর রাসূল (সঃ) বললেনঃ তুমি কি তোমার অন্যান্য ছেলেদেরকে ও অনুরুপ এক একটি গোলাম দান করেছ? তিনি জবাব দিলেন, না। হুযুর (সঃ) বললেনঃ তাহলে এ গোলামটিকে তুমি ফেরৎ নিয়ে নাও। অন্য এক বর্ণনা মতে হুযুর (সঃ) তাকে বললেনঃ তুমি কি তোমার সব'কটি সন্তানকে অনুরুপ এক একটি গোলাম দিয়েছ? তিনি বললেন, না। হুযুর (সঃ) বললেনঃ আল্লাহকে ভয় করো এবং সন্তানদের মধ্যে ইনসাফ করো। অতঃপর আমার পিতা বাড়ি ফিরে এসে দানকৃত উক্ত গোলামটি ফেরৎ নিলেন"। (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ হুযুর (সঃ) এর মদিনা শরীফ হিজরত করার পর মুসলমানদের ঘরে যে প্রথম সন্তানটি জন্ম নেয়, তিনিই হলেন উপরোক্ত হাদীসের রাবী হযরত নোমান ইবনে বশীর। মদিনায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী হুকুমতের প্রথম সন্তান হিসেবে আনসার-মুহাজির নির্বিশেষে সকলেই হযরত নোমানকে অত্যধিক স্নেহ করতেন। তার প্রতি তার পিতার অতিরিক্ত আকর্ষণের হয়তো এটাও একটি কারন ছিলো। এতদসত্ত্বেও হুযুর (সঃ) তার অন্যান্য ভাইদের থেকে অতিরিক্ত কিছু দেয়াকে অনুমোদন করেননি। কেননা সন্তানদের পরষ্পরের মধ্যে ইনসাফ না করে যদি কাউকে অতিরিক্ত কিছু দেয়া হয়, তা হবে শরীয়তের দৃষ্টিতে দোষনীয়। তাছাড়া এর দ্বারা ভাইদের পরষ্পরের মধ্যে ঝগড়া-ফ্যাসাদ সৃষ্টি হবে, ফলে পিতা-মাতার প্রতি অশ্রদ্ধা জন্মাবে।
হযরত সাঈদ ইবনে আস (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ সন্তানদের জন্য পিতার সর্বোত্তম দান হলো উত্তম তালীম ও তরবীয়ত"।
(জামেউল-উসূল, মিশকাত)
ব্যাখ্যাঃ- পিতা সন্তানদের জন্য বাড়ি, ঘর, জায়গা-জমি ইত্যাদি যত সম্পদ-ই রেখে যাক না কেন, যদি সন্তানদের উপযুক্ত তালীম তরবীয়ত না দিয়ে যান, তাহলে তার এ সব সম্পদই ইসলামের দৃষ্টিতে মূল্যহীন। কেননা উপযুক্ত তালীমের অভাবে সে দ্বীন-দুনিয়ার সঠিক পরিচয়ের ব্যপারে থাকবে অজ্ঞ। ফলে কোন সম্পদই তার এ অভাব মোচন করতে পারবেনা। কাজেই সন্তানদের তালীম ও তরবীয়ত পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব।
হযরত আবু হোরায়রা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সঃ) বলেছেনঃ মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তার যাবতীয় কর্ম তৎপরতা রহিত (মানে বন্ধ) হয়ে যায়। কিন্তু তিনটি বিষয় এমন আছে যার তৎপরতা মৃত্যুর কারণে রহিত (অর্থ্যাৎ বন্ধ) হয়না। একটি হলো সদকায়ে জারীয়াহ, দ্বিতীয়টি হলো কল্যাণকর ইলম, আর তৃতীয়টি হলো নেক সন্তান, যে প্রতিনিয়তই পিতা-মাতার জন্য দোয়া করে"।
(বুখারী)
ব্যাখ্যাঃ সদকায়ে জারীয়াহ বলা হয় এমন কোন সুদূর প্রসারী মহৎ দানকে, যার ফলাফল দাতার মৃত্যুর পরেও সাধারণ লোক দীর্ঘদিন ধরে ভোগ করতে থাকে। যেমন জনগণের কল্যাণার্থে রাস্তা তৈরী করে দেয়, মাদ্রাসা-মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। যদি কোন ব্যক্তি অনুরুপ কোন কাজ করে মৃত্যু বরণ করে, তাহলে মৃত্যুর পরেও তার আমলনামায় এর ছওয়াব জমা হতে থাকবে।
অনুরুপ ভাবে কোন লোক যদি কাউকে কল্যাণকর ইলম শিক্ষা দান করে থাকে যা দ্বারা সে দুনিয়া আখেরাতের সঠিক পরিচয় লাভ করতে পারে, তাহলেও উক্ত শিক্ষক মৃত্যুর পরে এর ছওয়াব পেতে থাকবে। কেননা তার কল্যাণকর শিক্ষা দ্বারা লোক দীর্ঘদিন উপকৃত হবে।
তদ্রুপ যদি কোন পিতা-মাতা এমন কোন সু-সন্তান রেখে মৃত্যু বরণ করে, যে সন্তান মৃত্যুর পর তার পিতা-মাতার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করে। উক্ত পিতা-মাতা মৃত্যুর পরেও উক্ত সন্তানের কাছ থেকে ছওয়াব পেতে থাকবে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সঃ) বলেছেনঃ কোন ব্যক্তির ঘরে কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সে যেন তাকে জাহেলীয়াতের যুগের ন্যায় জীবিত কবর না দেয় এবং তাকে তুচ্ছ মনে না করে, আর পুত্র সন্তানকে উক্ত কন্যা সন্তানের উপর প্রাধান্য না দেয় তাহলে আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করবেন।
(আবু দাউদ)
হযরত আয়েশা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা একজন বিপন্ন মহিলা তার দুটি কন্যা সন্তানসহ আমার কাছে কিছু পাওয়ার আশায় এসেছিলো। কিন্তু আমার কাছে তখন একটি খোরমা ব্যতীত অন্য কোন খাদ্য বস্তু ছিলোনা। আমি তাই তাকে দিলাম। মহিলাটি খোরমাটি দু'ভাগ করে দুই কন্যাকে দিলো এবং নিজে কিছুই খেলোনা। অতঃপর সে চলে যাওয়ার পর পরই নবী (সঃ) ঘরে প্রবেশ করলেন এবং আমি তাকে ঘটনা-টি বর্ণনা করলাম, হুযুর (সঃ) শুনে বললেনঃ যাকে আল্লাহ এধরনের কন্যা সন্তান দ্বারা পরীক্ষায় ফেলেছে, অতঃপর সে কন্যাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করে। (কিয়ামতে) কন্যাই তার জন্য জাহান্নামের ঢাল স্বরুপ হবে"।
(বুখারী, মুসলিম)
মানুষ সাধারণভাবে পুত্র সন্তানদেরকে কন্যা সন্তানদের উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকে কেননা কন্যা সন্তানরা বিবাহের পর স্বামীর বাড়িতে চলে যাবে। অতঃপর তার দ্বারা পিতা-মাতার এবং তাদের সংসারের বিশেষ কোন উপকার হবেনা। ফলে কন্যা-সন্তানদের ব্যয়ভারকে একটি অপ্রয়োজনীয় বোঝা বলে মনে করা হয়। উপরে উল্লেখিত হাদীসটিতে পিতা-মাতার উক্ত মনোভাবকে ইঙ্গিতে গর্হিত বলা হয়েছে এবং কন্যা-সন্তানদের ব্যয়ভারকে একটি মহৎ কাজ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। এমন কি, সন্তুষ্ট চিত্তে কন্যাদের ব্যয়ভার বহন করাকে জাহান্নাম হতে নাজাতের কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্ণিত হাদীসটির মাধ্যমে আমরা একটি বিষয়ের সন্ধান পাই তা এই যে, কখনো দো-জাহানের সর্দার হযরত মোহাম্মাদ (সঃ) এর ঘরে একটি খোরমার বেশী কিছু থাকতো না। আবার সে ক্ষেত্রেও ক্ষুধার্ত ব্যক্তির প্রয়োজনে ঐ একটি মাত্র খোরমা ও দান করে দিতে আদৌ কুন্ঠাবোধ করা হতো না।
বিষয়ঃ হাদীস শিক্ষা!
বিষয়: বিবিধ
৯৭৩ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আসুন........।
মুবারকবাদ ৷
আল্লাহ্ পাক সবাইকেই আমল করার তৌফিক দিন। আমীন।
চমৎকার লিখাটির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন