নববর্ষ নাকি নব-ধ্বংস?
লিখেছেন লিখেছেন মাহবুবা সুলতানা লায়লা ০১ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৬:৩৮:১১ সন্ধ্যা
পঞ্জিকার পাতার হিসাব শেষ হয়ে এলো! এলো নতুন বছর! নতুন বছরের আগমনি ধ্বনি বেজে উঠেছে পৃথিবীর আকাশে-বাতাসে! কে কতটা মূল্যায়ন করেছে গত বছরকে তার হিসাব করার সময় কারোর নেই! তবে এই রাতকে কে কিভাবে উপভোগ করবেন তার চেষ্টায়ও কেউ পিছিয়ে নেই! একেকজন একেক রঙ-রুপে সাজিয়ে রেখেছে এই থার্টি ফার্স্ট নাইটকে! তাকে ঘিরে নানা রকম জল্পনা-কল্পনা কতেক নির্বুদ্ধি আর বিবচণাহীন যুবক-যুবতীর!
মুনা আর মুনিয়া দুইজন চাচাতো বোন! একসাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে! পাশাপাশি বাসা হওয়ার কারনে একসাথে আসা-যাওয়া করে। দু'জনই খুব ভালো বন্ধু! কেউ কাউকে ছাড়া খায়ওনা, কোথাও যায়ওনা! এমন কি কেনা-কাটাটাও একই সাথে করে! তবে দুজনে মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে মুনার থেকে মুনিয়া কিছুটা লাজুক স্বভাবের! সে সবসময় বোরকা না পরলেও বড় ওড়না দিয়ে মাথাসহ শরীর ঢেকে চলা-ফেরা করে! এই কারনে মুনা মাঝে মাঝে মুনিয়াকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে! মুনা বলে মুনিয়া তুই এখনো সেই সেকেলেই রয়ে গেলি! আধুনিক হতে পারলিনা! অথচ শহরে জীবন-যাপন করছিস! নিজেকে খানিকটাও পরিবর্তন করতে পারলিনা! এসব লজ্জা-টজ্জা এবার বাদ দে নইলে আধুনিক পৃথিবীতে দখল দিতে পারবিনা! মুনিয়া হাসে আর বলে তুই পুরোটাই দখল দিস আমারটা সহকারে! মুনা রেগে গেলেও সয়ে যায় মুনিয়ার কথা! তোকে কোনকিছু দিয়েই পরিবর্তন করতে পারবোনা থাক তুই তোরমত করে আমি গেলাম! মুনা যাই বলুক মুনিয়া সে কথাগুলোকে তেমন মূল্যায়ন করেনা!
দু'জন একসাথে পড়া-লেখা করলেও দুজনের চলা-ফিরা একেবারে ভিন্ন! মুনিয়া কখনোই সন্ধ্যার পরে বাহিরে থাকেনা আর মুনা প্রায়ই রাত করে বাড়ি ফেরে! মা বাবা তেমন একটা খোজ-খবর রাখেনা কারন বাবা বাবার ব্যাবসা আর মা মায়ের বন্ধু-বান্ধব নিয়েই ব্যস্ত! কখন নেবেন মেয়ের খবর? সময় কোথায় অত? শুধু মাস শেষে মেয়ের টাকার দরকার হলে মাকে একবার মা বলে ডেকে বলবে টাকার দরকার এত টাকা দাও! ব্যসঃ মায়ের মেয়ের প্রতি দায়-দায়িত্ব শেষ! আর মুনাও টাকা চাইতেই হাতে টাকা পেয়ে যায় তাই মাকে দ্বিতীয়বার মা বলে ডাকতে হয়না! এতই আধুনিক আর আভিজাত্যপূর্ণ হয়েছে ওরা যে মাকে মা বলে ডাকে মাসে একবার! আর মেয়ের ও মায়ের সাথে দেখা হয় মাসে একবার! মুনার কাছে ওর বন্ধু-বান্ধবরাই সবচেয়ে আপনজন! তাদেরকে নিয়েই মুনার আরেক জগত! আর মা বাবার সাথে শুধু ফর্মালিটি মেন্টেন করে চলা বৈ কিছু নয়! আর মুনার একমাত্র ভাই ফরহাদ বিদেশে থেকে পড়া-শুনা করে! সেও ফোনে মা-বাবার খবর নিয়েই শেষ আর কোন দায়িত্ব নেই কারোর প্রতি কারো! কতটা আধুনিক তারা চিন্তা করলে সহজেই বুঝা যায়!
এভাবেই বছর ঘুরে আরো কয়েকদিন পরে আসবে অভিশপ্ত থার্টি ফার্স্ট নাইট! মুনা নিজের মনের মত করে চিন্তা করে রাখে সে এইরাতে সারারাতই বাহিরে কাটাবে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে! আর নিজেকে ভাসিয়ে দেবে এই রাতের উদ্দীপনায়! কেউ তাকে ফেরাতে পারবেনা আর একবছরের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন থেকে! অপরদিকে মুনিয়ারা দুইবোন একভাই! মুনিয়া, মুনীরা ও মাহদী! ভাই তো যুগ হিসেবে একেবারে সাদামাটা জীবন-যাপন করে! যেন সে আরো একশত বছর আগে পৃথিবীতে এসেছে তাই এতটা সেকেলে! ওদের পুরো পরিবারই অনেকটা সাধারণ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত! ভাই বোন একে অপরের সাথে খুব ঘনিষ্ট সম্পর্ক! বাবা-মা ভাই বোন সবাই মিলে একসাথে খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে, সবাই সবার নিত্য খোজ-খবর নেয়া যেন প্রতিদিনের কাজ! ওরা একে অপরের সাথে খুব মিলেমিশে চলে! একজনের কোন সমস্যা হলে সবার সাথে শেয়ার করে ও ভালো পরামর্শ চায় এবং সেই পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করে! এই কারনে এই পরিবার এতটা ধার্মীক না হলেও এতটা উগ্র না! মুনিয়াদের পরিবার মুনাদের চাইতে কিছুটা শান্তি ও স্বস্তিতে আছে! মুনিয়ার মা সন্তানদের ব্যপারে খুবই আন্তরিক! আর মুনিয়ারাও সবাই মা-বাবার প্রতি খুবই আন্তরিক! ওদের পরিবারের সাদাসিদে জীবন-যাপনের কথা আত্মীয়-স্বজনরা পিছনে বললেও সামনাসামনি কেউই কিছু বলেনা! বরং যারা বুঝে তারা এই পরিবারটিকে খুবই শ্রদ্ধার নজরে দেখেন!
বছরের চাকা ঘুরে ঘুরে আবার এলো অভিশপ্ত সেই থার্টি ফার্স্ট নাইট! মুনা মুনিয়াকে এই রাতে আনন্দ করার ব্যপারে খুব রিকোয়েস্ট করলেও মুনিয়া বড়ভাই ও বাবার ভয়ে রাজি হলোনা! সে বললো ভাইয়া শুনলে পিঠে চালতা পড়বে রে! তুইও এসব বাদ দে! মুনা মুনিয়াকে নানা রকম ঠাট্রা করে চলে গেলো! মুনিয়া বাড়িতেই থাকলো! নুমা তার কয়েকজন বন্ধুর সাথে চলে গেলো থার্টি ফার্স্ট নাইটের আনন্দ-উল্লাস করার জন্য! সে তার বন্ধুদের খুব বিশ্বাস করতো! আর মনে করতো বন্ধদের মত আপন হয়তো তার মা-বাবাও নয়! আরো ভাবতো বন্ধুরা হয়তো তার কোন ক্ষতি কখনোই হতে দেবেনা! আজকে সবাই মন খুলে আনন্দ করো শ্লোগানে মুখরিত করে পৃথিবীর আকাশ-বাতাস! মুনা তার বন্ধুদের সাথে একসাথে নাচে, গান গায়, এমন কি নেশাও করে সবার সাথে তাল-মিলিয়ে! এক সময় মুনাও তার বন্ধু-বান্ধব সবাই যখন মদের নেশায় মাতাল ঠিক তখনই মুনার উপর তার প্রান-প্রিয় বন্ধুরা পশুর আচরণ করে! মুনা নিজেকে নিজে চিনতে যেন কষ্ট হচ্ছে! সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না! কি করেছে তার প্রানপ্রিয় বন্ধুরা! যাদেরকে সে আপন মা-বাবার চাইতেও বেশী আপন মনে করতো! কিন্তু ইংরেজী নববর্ষের এই কালো রাতে মুনার সেই বিশ্বাসে আগুন লাগলো, পুঁড়ে ছাঁই হলো সেই বিশ্বাসের মোম! সেই বিশ্বাসের ঘরে আগুন জ্বললো! মুনা এই অভিশপ্ত থার্টি ফার্স্ট নাইটে হারালো আপন সতীত্বসহ আত্মবিশ্বাস! অভিশপ্ত এই থার্টি ফার্স্ট নাইটে গা ভাসিয়ে দিতে চাওয়া মুনা আজকে জীবনের সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব! সে ভাবতেও পারেনি তার প্রিয় বন্ধু-বান্ধবেরা এমনটি করবে! অভিশপ্ত এই থার্টি ফার্স্ট নাইটে মুনার পূর্ণ বিশ্বাসের মর্যাদা একেবারেই ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছে বন্ধু নামের বন্যদের বুনো উল্লাস! আর এক নিরপরাধী নারী হয়েছে সেই নির্মম পরিণতির স্বীকার!
অভিশপ্ত সেই থার্টি ফার্স্ট নাইটের পরে মুনা একেবারে চুপসে যায় হয়ে যায় একেবারে শান্ত! মুনা এখন আর বন্ধুদের সেই আড্ডায় যায়না! সেই বন্ধু-বান্ধব আর অভিশপ্ত সেই থার্টি ফার্স্ট নাইটকে মুনা এখন মনে প্রানে ঘৃনা করে! সে নতুন করে হলেও বুঝতে পেরেছে জীবনের আসল মানে! বুঝতে শিখেছে বাস্তবতা! জীবন যে রঙের ভেলায় ভাসিয়ে দেয়ার বস্তু নয় সেটাও বুঝতে পারছে! চিনতে পেরেছে অচেনা সেই বন্ধুদেরকে যাদেরকে বিশ্বাসের উচ্চাসনে রেখেছিলো! অভিশপ্ত সেই থার্টি ফার্স্ট নাইট মুনার জীবনকে চিরদিনের জন্য বদলে দিয়ে গেলো! মুনার জীবনিতিহাসে দিয়ে গেলো কালো এক কলংকময় অতীত! মুনা এখন আর সেই মুনা নেই! মুনা যেন নতুন করে জন্ম গ্রহন করেছে! নিজেকে ও পৃথিবীর চারিপাশকে নতুন করে চিনতে শুরু করেছে! সে আর মুনিয়াকে এখন আগের মত ঠাট্রা-বিদ্রুপ করেনা! ভেতরে ভেতরে অনুশুচণার অনলে পুঁড়ে ছাই হয়! আর মাঝে মাঝে মুনিয়াকে বলে মুনিয়া আবেগে, উল্লাসে, অন্ধ হয়ে আমি অনেক ভুল করেছি আর তুই সেই ভুল থেকে অনেক দুরে আছিস! তুই-ই ভালো আছিসরে মুনিয়া! আমি শেষ হয়ে গেছি! মুনিয়া মুনাকে শান্তনা দেয়, কি হয়েছে জানতে চায় মুনা বলেনা তার কি হয়েছে তবে শুধু বলে তুই ভালো আছিস মুনিয়া! আমিও এখন থেকে তোর মত হতে চাই! তুই কি আমাকে তোর মত হতে সহযোগীতা করবি?
মুনিয়া মুনার সবকথা না শুনলেও মুনাকে কথা দেয় তোকে সব রকমের সহযোগীতা করতে রাজি আছি আমি! কি করতে হবে আমাকে বল! মুনা বলে তুই শুধু আমাকে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করবি! আমি এই আধুনিক মুনা আর থাকতে চাইনা! আমি হতে চাই সাধারণ বাঙালি আর সহজ-সরল মনা মুনা! মুনিয়া মুনার হাত ধরে বলে মুনারে তোকে আমি বোন, বান্ধবী যাই বলিস তার থেকেও বেশী ভালোবাসি তাই তোর জন্য আমি সবকিছু করতে রাজি! তুই আমাকে তোর সব সমস্যায় কাছে পাবি! আমি তোর শুধু সহপাঠিই নই, আমি তোর বান্ধবী ও বোন! তুই আগের মত প্রজাপ্রতি হয়ে উড়ে বেড়া! তোর মুখে সেই হাসি ফিরিয়ে আন! মুনা বলে মুনিয়া আমি সেই আগের মুনা হতে চাইনা! সেই মুনা তো অভিশপ্ত সেই থার্টি ফার্স্ট নাইটে মরে গিয়ে এখন নতুন মুনার জন্ম হয়েছে! তুই এই নতুন মুনাকেই সঠিক পথ চিনিয়ে এগিয়ে নিয়ে যা বোন! আর আমাকে ক্ষমা করে দিস তোকে অনেক গাল-মন্দ করেছি বলে! মুনা বলে আমি তোর কথায় কখনোই কিছু মনে করিনি! আর তুই যে জীবন এবং বাস্তবতা বুঝতে পেরেছিস তাতেই আমি খুশি! মহান স্রষ্টা বাকি জীবন তোকে সেই সুন্দর ও বুঝমান পথেই রাখুন! দু'জন দু'জনকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে, কাঁদে মুনা কাঁদে মুনিয়া উভয়ের কান্নার অশ্রু যেন দু'জনের বুকের মাঝে শান্তির হাওয়া বইয়ে দেয়! আর মুনা সেই কান্নার জলে নিজেকে যেন কলুষ মুক্ত করতে চেষ্টা করে! দুজনের কান্না যেন সুন্দর আগামির সূচনা করে! ইঙ্গিত দেয় কলুষমুক্ত নতুন জীবনের! নতুন সূর্যদ্বয়ের! নতুন আগামির!....................! আর সেই প্রত্যয়েই মুনা নিজেকে আধুনিকতার শেঁকল থেকে মুক্ত করে সাধারণ জীবনকে বেছে নেয়! মুনা কি পাবে সেই সুন্দর ও নির্মল জীবনের ছোঁয়া?
বিষয়: সাহিত্য
১৪১৭ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
নতুন বছর যেন কাটে সকল পাপ থেকে বেঁচে!
তবে কেন যে ,মানুষ ঠেলা গুতা খাওয়ার আগেই সোজা হয়না!!!
সময়োপযোগী লিখা, প্রাসঙ্গিক বিষয়কে দারুণ ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পচ্ছলে।
আপনাকে স্বাগতম আমার ব্লগ বাড়িতে.....।
মন্তব্য করতে লগইন করুন