জীবনটা ক্ষনিকের তবুও মনে স্বপ্ন উঁকি মারে! (১২ তম পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন মাহবুবা সুলতানা লায়লা ১১ ডিসেম্বর, ২০১৪, ১২:১১:৪০ রাত
আযাদ ইদানিং আরো মনমরা হয়ে থাকে জালাল চলে যাবার পর থেকে। আগের মত যেন হাসতে ভুলে গেছে। ভুলে গেছে গল্প করতে। আর মাঝে মাঝে বাচ্চা শিশুদের মত করে হাউমাউ করে কাঁদে আযাদ। কানিজ অনেক শান্তনা দিতে চেষ্টা করে। অনেক বুঝায় আযাদকে কিন্তু আযাদ যেন আজকাল আরো ছোট খোকা হয়ে গেছে সে কোন কিছুতেই বুঝ মানতে চায়না। কানিজ সংসারের কাজ ছাড়াও আযাদকে আরো বেশী সময় দিতে ট্রাই করে। নানা রকম কৌতুক বলে হাসাতে ট্রাই করে আযাদকে। আযাদের মুখে হাসি ফোটাতে কানিজ কোন কিছুই বাদ দেয়না। কিন্তু আযাদ আর আগের মত হতে পারেনা। হাসতে পারেনা। পারেনা আগেরমত করে সুন্দর ভাবে কথা বলতে। তারপরও কানিজের কোন কমতি নেই আযাদকে হাসাতে সে অবিরাম চেষ্টা করেই যাচ্ছে আযাদ যেন আগের মত হয় সেই জন্য। আস্তে আস্তে আযাদ কিছুটা আগের মত হয় কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ আযাদ যেন অন্যমনষ্ক্য হয়ে যায় তখন আর কিছুতেই তাকে হাসানো বা গল্প শুনানো যায়না। হঠাৎ করেই আযাদের হাস্যোজ্জল মুখে যেন মেঘ জমে যায়। সে মেঘ আকাশের মেঘের চেয়েও কালো। সে মেঘ শুধু আযাদের মুখেই জমেনা বরং কানিজের মন থেকেও ঝরে পড়ে বৃষ্টি হয়ে। জালাল যাওয়ার পরে আযাদকে নিয়মিত ডাক্তারের কাছে আনা নেয়া থেকে শুরু করে অনেক কাজেই বিঘ্ন ঘটছে। কানিজ মহিলা মানুষ সে সবকিছু সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। কানিজ মাঝে মাঝে আযাদের বন্ধু আযাদকে ডাকায় যখন আযাদকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার তারিখ হয় তখন। আযাদের মিতা বন্ধু এবাড়িতে আসা বন্ধ করে দিলেও আযাদের গুরুতর আহতের খবর শুনে আবারো আসা শুরু করে এবং সেই আযাদকে নিয়মিত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। এতে কানিজ কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আযাদ আগের তুলনায় অনেকটা ভেঙে পড়ে।
সব সময় কি যেন ভাবতে থাকে আজকাল আযাদ। কি ভেবে যেন কখনো কখনো মুখকে মলিন করে রাখে। কখনো কাঁদে একাকি নির্জনে বসে বসে কানিজকে সবকিছু বলতে চায়না। কানিজও অনেক চেষ্টা করতে করতে এবার নিজের মনের উপর ছেড়ে দেয় আযাদকে। আযাদের যা ভালো লাগে তাই করে। কখনো খুবই কাঁদে, কখনো মনমরা হয়ে থাকে। কখনো কানিজকে কাছে ডেকে পাশে বসিয়ে এটা সেটা বলে। কানিজ কেবল তখনই তার কথার জবাব দেয়। আযাদ নিজেকে নিয়ে আর কোন কিছুই ভাবতে পারেনা। আযাদ তার আপন ভাইয়ের ব্যবহারে মনের শক্তিগুলোও যেন হারিয়ে ফেলেছে। সে প্রতি নিয়ত ভয়ের মাঝেই থাকে কখন আবার নতুন বিপদের মুখোমুখি হোন। এসব ভাবনাই আযাদকে রোগের চেয়েও বেশী দূর্বল করে রেখেছে। মনের জোর কমিয়ে দিচ্ছে। সে এখন শুধু মৃত্যুর প্রহর গুণছে। কখন সে নিজেও মুক্ত হবে আর কানিজ সহ সবাইকে মুক্তি দিয়ে যাবে। মানুষের জীবনে বিশ্বাসটা একটুকরো কাঁচের মত,ভেঙে গেলে তা আর কখনো জোড়া লাগানো যায়না। তাই বিশ্বাসের টুকরোটাকে আলতো করে রাখতে হয়। নয়তো বিশ্বাস তার আগের অবস্থানে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, আযাদেরও হয়েছে ঠিক সেই অবস্থা। তার আপন ভাইদের প্রতি যে বিশ্বাস আর যে ভরসা ছিলো তার সবটুকুই নষ্ট হয়ে গেছে সেদিন। আযাদ ভাবে আসলে সেদিন একেবারে মরে গেলেই হয়তো অনেক কিছুর সমাধান হয়ে যেত কিন্তু তা তো হলোনা। এরপরও মানুষ বলে কথা যতক্ষন বেঁচে আছে ততক্ষন কোন না কোন অবলম্বন সংগ্রহ করে বা আঁকরে ধরে বাঁচতে তো হবে। কানিজ আযাদকে সব ব্যপারেই শান্তনার বাণী শোনাতে থাকে। বোঝাতে থাকে এরই মাঝে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়তো কোন কল্যান নিহিত আছে এত ভেঙে পড়না তুমি। কানিজের আজকালকার দুরুত্বে আযাদ বুঝতে পারে তার ব্যবহারেই কানিজ এমনটি করছে। এবার আযাদও কিছুটা স্বাভাবিক হতে ট্রাই করে। হতে ট্রাই করে আগেরমত।
আযাদ অনেকটা আগের মত ব্যবহার করছে। কানিজেরও খুবই ভালো লাগছে ইদানিং। কানিজের মনে হয় ইদানিংয়ের দিনগুলো যেন বাতাসে ভর করে চলে যাচ্ছে হারিয়ে যাচ্ছে অতীতের পাতায়। কানিজ মনে মনে আশা করে এভাবেই যেন কাটে পৃথিবীর বাকি সময় গুলো। কোন চাওয়া পাওয়ার বৈরিতা নেই দুজনের মাঝে, আছে শুধু দুজনকে দুজনে হাসি আনন্দে রাখার অক্লান্ত প্রয়াস। কানিজ অনেকটুকু পেরেছে আযাদ উঠে বসতে না পারলেও আগের তুলনায় অনেক স্বাভাবিক হয়েছে। গল্পের মাঝে মাঝে কানিজ আযাদকে অনেক কিছু বোঝাতে চেষ্টা করে, আসলে জীবনের সুখের সময় গুলো খুব দ্রুতই চলে যায়। আর কষ্টের সময় যেন যেতেই চায়না। কয়েক মাস পরে জালাল আসে আযাদকে দেখতে। জালাল গরীব হলেও মানবতাবোধ আছে অনেক। মনের মাঝে আযাদ পরিবারের প্রতি খুব ভালোবাসাও আছে বিশেষ করে আযাদের প্রতি। জালালের মন ভালো নেই এসেই সবার খোজ খবর নেয়। যখন জালালের কাছে জানতে চাওয়া হলো তোমার মা কেমন আছে তখনই জালাল বাচ্চা শিশুর ন্যায় কাঁদতে শুরু করে আর বলে ভাইজান আমার মা তো খুবই অসুস্থ আমারও কোন কাজের ব্যবস্থা হয়নি তাই মায়ের ভালো চিকিৎসা করাতে পারছিনা। আযাদ বলে জালাল কাঁদিসনা ইনশা-আল্লাহ তোর মায়ের কিছুই হবেনা তোর মা সুস্থ হয়ে যাবে তুই দোয়া কর। আর শোন তোর মায়ের চিকিৎসা নিয়ে কিছুই ভাবিসনা আমি ব্যবস্থা করে দেব।
আযাদ কানিজকে ডেকে বলে কানিজ এখনই সময় হয়েছে জালালকে সহযোগীতা করার কারন ওর মা এখন অসুস্থ এখন টাকাটা দিলে জালালের খুবই উপকার হবে তুমি দেখ ম্যানেজ করে দিতে পারো কিনা। কানিজ একবাক্যে রাজি হয় এবং জানতে চায় কত দিতে হবে আযাদ বলে হাজার বিশেক দিলে ভালো হয় এতে করে ওর মায়ের ভালো চিকিৎসা করাতে পারবে আর টাকাটাও কাজে লাগবে। কানিজ হয়তো টাকাটা আগেই ম্যানেজ করে রেখেছিল তাই আযাদ বলার সাথে সাথেই বের করে আযাদের হাতে দেয়। আযাদ জালালকে বলে যা ভাই আজকে আর তোকে দেরি করাবো না তুই দ্রুত গিয়ে তোর মায়ের চিকিৎসা করা। পরে উনি সুস্থ হলে এসে দেখা করে যাস কেমন? জালাল বলে ভাইজান আপনি আমার খুব উপকার করলেন আল্লাহ এর প্রতিদান দিন। যা তুই দেরি করিস না ভাই। কানিজ জালালকে নাস্তা দেয় জালাল হালকা কিছু খেয়েই বাড়ির দিকে রওয়ানা করে। আযাদ কানিজকে বলে কানিজ জানো আজকে মনটাতে খুবই প্রফুল্লতা অনুভব করছি জালালের জন্য কিছু করতে পেরে। কানিজও বলে আসলে বিপদের সময় সামান্য সহযোগীতাও অনেক উপকারে আসে। ভালোই হলো সময়মত টাকাটা ওর হাতে দিতে পেরেছি। ওদিকে আযাদের মা ও অনেকটা সুস্থবোধ করেন মেয়েদের সেবায়। তবে কথা আর আগের মত স্পষ্ট করে বলতে পারেন না। আরো কয়েকমাস পরে জালাল দেখা করতে আসে আযাদের সাথে, সাথে করে নিয়ে আসে তার মায়ের হাতে বানানো কিছু পিঠা আর কিছু মুড়ি ভাজা ও খেজুরেরে রস জাল করে বানানো ঝোলা গুড়। এসব দেখে একরকম আনন্দই বোধ করে আযাদ আর বলে কানিজকে কানিজ আমরা যারা শহরে বসবাস করি তারা অনেক কিছুই মিস করি তাইনা? কানিজ মাথা নেড়ে বলে ঠিক তাই। জালাল বলে ভাইয়া ও ভাবী আপনারা একসময় আসুন না আমাদের গ্রামে আযাদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে জালালরে আর কোনদিন হয়তো সেটা সম্ভব হবেনা রে। তুইই মাঝে মাঝে এসে দেখে যাস আমাকে, তাতেই খুশি আমরা। জালাল মাথা ঝুঁকিয়ে সায় দেয় আসার। সেদিনের মত জালাল বিদায় নেয় আযাদ ও কানিজের কাছ থেকে। আযাদ বলে কানিজ দেখ কত কাছের মানুষেরা সম্পদের কারনে পর হয়ে যায় আর কত পরেরা ও আপনজনের মত হয়, কি বৈচিত্রময়তা মানুষের মাঝে তাইনা? কানিজ হ্যাঁ তাই। মানুষের বৈচিত্রতার কোনই শেষ নেই............আযাদ হুম।
চলছে.....চলবে।
বিষয়: সাহিত্য
১২৮১ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
দারুন বলেছেন। আসলেই কত বৈচিত্রময় এই জীবন! সম্পদের কারণেই কত আপনজনরাও চরম শত্রু হয়ে যায়,আবার কত পর পরম আপন জনে পরিণত হয়!
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!!!
আপনাকেও অনেক অনেক যাযাকুমুল্লাহ খাইরান।
মন্তব্য করতে লগইন করুন