জীবনটা ক্ষনিকের তবুও মনে স্বপ্ন উঁকি মারে! (১০ম পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন মাহবুবা সুলতানা লায়লা ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০১:০৬:১০ দুপুর
কানিজ নিজেকে নিজে দোষারোপ করতে থাকে তার জন্যই আযাদের আজকে আবারও করুন পরিণতি। আমি কেন যে এতদিন ধরে এবাড়িতে এসে থাকতে গেলাম? কেন আরো আগে চলে গেলাম না? তাহলে হয়তো আযাদের এই অবস্থা হতোনা। কানিজ ভাবছে তাহলে কি মনিরই এই কাজ করেছে সম্পদের লোভে? মনিরের যেই কথা সে সরাসরি শুনেছে তাতে করে কানিজের ধারণার সিংহভাগই মনিরের দিকে আসে। কানিজ আরো ভাবতে থাকে মানুষ অন্যকে ধোঁকা দিতে চায়! আর যে ধোঁকা দেয় সেই একসময় বুঝতে পারে সে কাউকেই ধোঁকা দেয়নি। ধোঁকা দিয়েছে শুধু নিজেকে.......সর্ব শেষে বুঝেও কোন কাজ হয়না। আবার এও ভাবে যে, না জেনে, না দেখে কারো উপর দোষারোপও করা ঠিক নয়। তাই কানিজ নিজেকেই বেশী দোষারোপ করতে থাকে। কানিজ আরো ভাবে আচ্ছা বাসায় গেলেই জানা যাবে জালাল তখন কোথায় ছিলো? কিভাবে কি হলো? কিভাবে আযাদ এতটা ব্যথা আবারও পেলো? কানিজ মহান আল্লাহ কাছে প্রার্থনা করতে থাকে হে আল্লাহ তুমি আযাদকে বাঁচাও সুস্থ করে দাও, আমি যেন আযাদের কাছাকাছিই সবসময় থাকতে পারি। কানিজ তার বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে যান আযাদের কাছে আযাদকে দেখতে। আযাদের এখনো জ্ঞান ফেরেনি। ডাক্তার বলেছে আযাদের মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছেন এবং রক্তক্ষরনও খুবই বেশী হয়েছে। ডাক্তার আরো আশংকা করছে আযাদের স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়ে যাওয়ার। কানিজ শুধু অঝর ধারায় কাঁদছে আর নিজেকে দোষারোপ করছে। কিভাবে কি হয়ে গেলো? কানিজের বাবা মেয়েকে শান্তনা দেয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছেন। তিনিও নিরবে কেঁদেই চলেছেন। ভাবছেন মেয়ের কঠিন সিদ্ধান্ত সেদিন মেনে নিয়েছিলাম মেয়ের যুক্তি তর্কের কাছে হেরে গিয়ে তারপরও ভেবছিলাম ওর মুখের হাসিই যথেষ্ট ও যদি সব আনন্দ চিত্তে মেনে চলতে পারে তবে কোন সমস্যা হবেনা। কিন্তু এখন আযাদের ব্যপারে শংকা লাগছে কানিজের বাবার কাছে তবে কি মেয়েটা আরেকটা নতুন কষ্ট পাবে? নানা এ হয়না। এ হয়না। হে আল্লাহ তুমি এত কঠিন নও তুমি তো রাহমান দয়ালু। তুমি আমার কানিজের জন্য যাকিছু কল্যানকর তাই করো। কানিজ তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে বাবা আমার একি হলো? বাবা আমি এখন কি করবো? কাকে সম্বল করে বাঁচবো? বাবা মেয়েকে শান্তনার কথা বলতে থাকেন আল্লাহ যা করেন তাতেই মানুষের কল্যান নিহিত মা। তুই ধৈর্য ধারন কর এর প্রতিদান আল্লাহই তোকে দেবে।
আযাদের মা আযাদের এই খবর শুনে বেচারি হঠাৎই প্রেসার খুব বেড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন তাকেও হাসপাতালে আনা হয়েছে। কানিজ তার শাশুড়ীর কাছে বসে আছে। আযাদের মায়ের জ্ঞান তাড়াতাড়ি ফিরলেও তিনিও মুখে স্পষ্ট করে কথা বলতে পারছেন না। ডাক্তার বলেছে তিনি ও নাকি ব্রেইন স্টোক করেছে যার কারনে মুখের কথা অস্পষ্ট হতে পারে। ডাক্তার আরো বলেছে দুজন রোগীর সামনেই আপনারা খুবই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করবেন যাতে করে আপনাদের কোন আচরণে তারা নতুন কোন কষ্ট পান। সেদিকে সবাই খেয়াল রাখবেন। সব শুনে কাঁদতে কাঁদতে কানিজের মুখের উপর দুটি কালো চিহ্ন পড়ে গেছে। আযাদের বোন বোনাই, কানিজের বাবা, আযাদের ভাই খোকন সহ সবাই হাসপাতালের করিডোরে পায়চারি করছে। সকলের মনের একই কথা হে আল্লাহ তুমি আযাদকে বাঁচাও তাকে তুমি সুস্থতা দান করো। প্রায় বিকেলের দিকে আযাদের জ্ঞান ফিরে আসলেও আযাদ কাউকেই চিনতে পারছেনা। শুধু বেডে শুয়ে ফ্যাল ফ্যাল চোখে সবার পানে তাকিয়ে আছে। কানিজের অবস্থা আরো কঠিন তাহলে কি ডাক্তারের কথানুযায়ী আযাদের স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়ে গেছে? কানিজ আর কিছু ভাবতে পারেনা। জীবন নদীতে যেন উত্তাল ঢেউয়ের পাশাপাশি কঠিন ঝড়ও উঠেছে। এ ঝড় কি যে উঁপড়ে ফেলবে আর কি যে রাখবে কানিজ ভাবতে পারেনা। মাথা নিচু করে আছে সে। আযাদের বোবা চাহনী কানিজের অন্তর যেন ভেঙে খান খান করে দিচ্ছে। আর কানিজের মনের ভেতর বারংবার শুধু জাগ্রত করছে একটিই কথা কানিজ তোমার দুরে থাকাটাই আযাদের এবারের অসুস্থতার কারন। কানিজ কিছুতেই মনকে শান্তনা দিতে পারছেনা। সে নিরবে শুধু কেঁদেই চলেছে। আযাদের বড় বোন এসে কানিজকে শান্তনা দিচ্ছে বোন তুমি এত ভেঙে পড়না। তুমি শক্ত থাকো আল্লাহ অবশ্যই আযাদ ভাইকে সুস্থ করে দেবেন। আর তুমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারলে হয়তো ভাইও আস্তে আস্তে ঠিক হবে। তুমি শান্ত হও বোন শান্ত হও। এদিকে মায়ের অবস্থাও ভালো না। বড় ভাইয়ের জন্য মা ও তো এখন বিছানায়।
হাসপাতাল থেকে আমি মাকে সাথে করে নিয়ে যাবো তুমি বড় ভাইকে দেখ বোন। কানিজ মাথা নেড়ে সায় দেয়। আযাদ সবাইকে দেখছে আর মনে মনে কি যেন ভাবছে একবার ডানে তাকায় আবার বামে তাকায় সবাই লক্ষ করছে আযাদ কাউকে হয়তো খুজছে। সবাই কানজিকে ইশারা করে বলছে দেখতো ভাইজান কি তোমাকে খুজছে কিনা। কানিজ দৌড়ে যায় আযাদের বেডের কাছে আযাদ অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে কানিজের দিকে কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারেনা। কানিজের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে আযাদ কিন্তু অতি দূর্বলতার কারনে সেটাও করতে পারেনা। কানিজ বুঝতে পারে আযাদের জ্ঞান আছে সে কানিজকে চিনতে পারছে এটা বুঝতে পেরে কানিজ মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। এরই মাঝে ডাক্তার আসে আযাদকে দেখতে। কানিজ ডাক্তারের কাছে জানতে চায় আযাদের বর্তমান অবস্থা কি? সে কি আগের মত চলাফেরা করতে পারবে? ডাক্তার কোনই আশাসূচক বাণী শোনাতে পারেনি কারন আযাদের তো আগেই মেরুদন্ডের হাড় ভেঙে গেছিল এখন সেখানে নতুন আঘাত ও সাথে মাথাতেও আঘাত বেচারা যে বেঁচে আছে সেটাই আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহ। ডাক্তার আরো বলল সবচেয়ে বড় কথা হলো আযাদ আর সোজা হয়ে হাঁটতে পারবেনা। বাকি জীবন তাকে শুয়ে শুয়েই কাঁটাতে হবে এমন কি ব্রেইনে আঘাত পাওয়ার কারনে সে মুখেও স্পষ্ট করে কথা বলতে পারবেনা। তার মুখের ভাষাতে জড়তা এসে গেছে হয়তো। এখনো তা বুঝা যাচ্ছেনা তবে পুরোপুরি সুস্থ হলে বলা যাবে কি অবস্থা হয় আযাদের।
কানিজ বেচারী জীবনে যা কিছু চাইলো জীবন তাকে তার চেয়েও বেশীই দিলো। কানিজ ভাবতে থাকে আযাদের কথা। আযাদের সহানুভুতির কথা। আযাদ কতটা ফ্রেশ মনের সে কথা। কানিজ জীবনে ঠকেনি তবে ভাগ্যকে মেনে নিয়েছিলো সবদিক বিবেচণা করে। কিন্তু সেখানেও আজকে সম্পদ লোভীদের হানা। কানিজ ভাবে আযাদ সুস্থ হলে জানা যাবে আসলে সে কিভাবে ছাদে ওঠে আর কিভাবে এই অবস্থার সূচনা হয়। যাক বেঁচে আছে এজন্য কানিজ আবারও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। কয়েক দিনে আযাদের অবস্থা কিছুটা সুস্থতার দিকে গেলে ডাক্তার বলে বাসায় নিয়ে যেতে এবং খুব খেয়াল রাখতে। কানিজ এক'দিন এখানেই ছিলো বাসায় যায়নি একটুক্ষনের জন্যেও। কারন সে চায় আযাদকে সবসময়ই সেবা করতে যাতে করে উঠে দাড়াতে না পারলেও সুস্থতা অনুভব করে আযাদ। নিয়মিত ওষধ আর আন্তরিক সেবায় আযাদ কিছুটা সুস্থ হলেও মনের যে অসুস্থতা আছে সেটা কিন্তু সাড়েনি আযাদের। সেটা সাড়বেও না কোনদিন। কেউ না জানলেও আযাদ তো অনুভব করতে পেরেছিল যে কে তাকে জোর করে ছাদে নিয়ে গেছিলো? কে তাকে নিরবে ধাক্কা মেরে সবকাজ একসাথেই সমাধা করতে চেয়েছিলো? আযাদ কাউকেই কিছু বলেনি আর বলার আগের মত শক্তিও তার নেই। আযাদ কানিজকে ডাকে কেমন যেন অচেনা স্বরে। কানিজের বুকটা তখন ফেঁটে যেতে চায়। যার ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে জীবনটা পাড় করতে চেয়েছিলো তাকে সে এখন কেমন পাচ্ছে? কিন্তু কি করা জীবনের এই বাঁকে এসে মনে হচ্ছে বাকি জীবনটা কি যে এক শংকা নিয়ে কাটে কানিজ ভাবতে পারেনা। সে ভাবে কেন যে মানুষের ভেতরে অর্থ আর সম্পদের লোভ যে কারনে আপন ভাইও ভাইয়ের চরম শত্রুতে পরিণত হয়। কানিজ কষ্ট থেকে প্রার্থনা করতে থাকে হে আল্লাহ তুমি কারোর জীবনে আর আমাদের পুনরাবৃত্তি করনা। তুমি সবসময় সবার সহায় থাকো। কানিজ সবকিছু গোছাচ্ছিল আর এসব ভাবছিলো আযাদকে রিলিজ দেয়া হয়েছে একটু পরই তারা বাসার দিকে রওয়ানা হবে।
বিষয়: সাহিত্য
১৩০৫ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
করুণ বাস্তবতার সাবলীল নান্দনিক উপস্হাপনা অনুভূতি কে নাড়িয়ে গেল! অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি!!!
আর সাথে থাকার জন্য আপনার শুকরিয়া।
যতই এসব থেকে দুরে থাকতে চান দেখবেন এক সময় ততই এর জালে জড়িয়ে পড়েছেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন