"ওপারের ডাক"
লিখেছেন লিখেছেন মাহবুবা সুলতানা লায়লা ২৯ নভেম্বর, ২০১৪, ১০:২৭:১১ রাত
যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে চারিদিক অন্ধকারে ঢেকে যায়! সকল পশু পাখি ও মানুষেরা সহ সবাই ফিরে তাদের সুখের নীড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে! কর্মব্যস্ত মানুষ গুলো ভোরের সূর্যদ্বয়ের অপেক্ষায় থাকে কখন রাতের আঁধার কেটে ভোরের আলো ফুটবে? কখন তারা পৃথিবীর আয়োজিত কাজে ব্যস্ত হবে? জীবনকে সাজাতে গুছাতে যত ব্যস্ততা, যত আয়োজন! পৃথিবীর সকল চাহিদা পূরনের জন্য ব্যস্ত আমরা পিছনে বা অগ্রে তাকানোর কোন সময়ই পাইনা বা আমাদের হাতে সেই সময় নেই। আর সেই প্রয়োজন পূর্ণ করতে করতেই চলে আসে যাওয়ার ট্রেন। কেউ হয়তো পারে সেখানে যেতে যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে আর কেউ পারেনা। চলে যাওয়ার সময় হতেই চলে যায়। তারপরের কি অবস্থা বা কি উপায় তা ভাববার সময়ই পাওয়া যায়না। মৃত্যু এমনই একটি বাস্তবতা যে, তাকে কেউই অস্বীকার করতে পারেনা।
জীবনের সকল ব্যস্ততায় সময় কাটতে কাটতে জীবনের সন্ধ্যা যে কখন নেমে এলো সিরাজ উদ্দীন খানের কোন খবরই ছিলোনা। যৌবনের শুরু থেকে এই সময় পর্যন্ত পিছনে তাকানোর সময়ই পাননি তিনি। শুধু বিলাসিতার পিছনে ছুটেছেন অহরহ! বুঝতেই পারেননি কখন যে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌছেছেন। জীবনের স্বপ্ন পূরণের ব্যস্ততায় ভুলে গিয়ে ছিলেন ওপারের কথা! ভুলে গেছেন সেখানে রয়েছে চির আবাস স্থল। অর্থোপার্জনের পিছনেই কেটেছে ব্যস্ত কর্ম জীবন। বর্তমানে অর্থের সমস্যা দুর হয়েছে বাকি আছে শুধু বাড়ির কাজটা সম্পন্ন করার। কোন এক বিকেলে স্বামী স্ত্রী বসে চা পানের সময় স্ত্রী বলল আর কতদিন এভাবে ছোট বাসাতে থাকবো? ছেলের বন্ধু বান্ধব আসলে লজ্জা লাগে এবার বাড়ির কাজে হাত দাও! এখন তো মুটামুটি টাকার সমস্যা নেই তবে দেরি করছো কেন? সিরাজ উদ্দীন খান বলেন বাড়ির কাজে হাত দিলে তো সেখানে সময় দিতে হবে। তখন আর বাহিরে যাওয়া যাবেনা এখানেই ডিউটি করতে হবে। তিনি আরো বলেন হ্যাঁ ভাবছি এবারই সেটাতে হাত দেব। সিরাজ উদ্দীন খান এবার হাত দিয়েছেন বাড়ির কাজে। যথা সময়ে রাজমিস্ত্রী আসলো বাড়ির ফাউন্ডেশন দেয়া হলো পাঁচতলা। আপাতত নিচতলা কমপ্লিট করে থাকবেন। পরবর্তীতে তিনতলা কমপ্লিট হলে সেখানে উঠে যাবেন। মিসেস মনোয়ারা সিরাজের ও এমনই ইচ্ছা। বাড়ির ফাউন্ডেশনের পর এবার ছাদ ঢালাই দেয়া হলো। স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে গল্প করছেন এবার জীবনের কাংখিত আরেকটা স্বপ্ন পূরন হতে চলেছে। মিসেস মনোয়ারা সিরাজ এবার বেজায় খুশি। ছোট ছোট দু্ইটা রুম নিয়ে এতটা বছর অনেক কষ্ট করতে হয়েছে এবার কষ্টের দিন শেষ আর কষ্ট করতে হবেনা রুম নিয়ে। এবার দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে কয়েকটা রুম নিয়ে রিল্যাক্স ভাবে থাকা যাবে। মেহমান আসলেও তেমন অসুবিধা হবেনা। দুই মেয়ে দুই রুমে আর ছেলে এক রুমে নিজেরা এক রুমে আর মেহমানদের জন্য একটা বড় ড্রইং রুম। জীবনকে আরেকটু পরিপাটি করে সাজানো যাবে। দুজনেই যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। আপাতত ছাদ হয়ে গেছে এরপর কিছু দিনের বিরতি দিতে বলে গেছে রাজমিস্ত্রীরা আরো বলে গেছে সকাল বিকাল পানি দিয়ে ছাদ ভিজিয়ে রাখতে।
সিরাজ উদ্দীন খানের মন এখন বেশ প্রফুল্ল। জীবনের সবকিছুকে আজ পূর্ণ মনে হতে লাগলো। ছেলে মেয়েদের বসবাসের জন্য একটি শান্তির আবাসস্থল হতে চলেছে মনে মনে আত্মশান্তি লাভ করলেন তিনি। বাড়ির ছাদ সম্পন্ন তাই তৃপ্তির ঢেকুর তোলার সাথে সাথে তৃপ্তির হাসিও হাসলেন। মনের মাঝে খুবই আত্মতৃপ্তি নিয়ে রাতে ঘুমালেন সিরাজ উদ্দীন খান। পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে জেগেই ফজরের নামাজ পড়ে ছাদে উঠার সময় বউকে বলে যান ছাদে পানি দেয়ার কাজটা আগে সেরে আসি এরপর এসে নাস্তা করবো। ছাদে উঠে মটর দিয়ে পানি দেন ছাদে। কিছু সময় সেই পানিতে হাঁটাহাঁটি ও করেন সাথে একমাত্র ছেলে রনি। বাবার পিছু পিছু হাঁটছে। হঠাৎ রনির বাবা বলে রনিরে আমার কেমন যেন লাগছে আমাকে একটা চেয়ার এনে দে তো। রনি দৌড়ে চেয়ার আনতে যায় বাসার নিচতলা থেকে। চেয়ার এনে বাবাকে বসতে দেয় রনির বাবা চেয়ারে বসেও বলছে রনি আমার কেমন যেন লাগছে আমাকে একটু ধরে নিচে নামাতে পারবি? আমাকে ঘরে নিয়ে যা। রনির বাবা খুব স্বাস্থবান লোক তাই রনির পক্ষে একাকি তার বাবাকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সে তার বাবাকে বলে বাবা আমি কাকাদেরকে ডাকি আপনি একটু বসুন বলেই রনি নেমে যেতে যেতে রনির বাবা বলে রনি দেরি করিস না আমার খুবই খারাপ লাগছে। রনি দৌড়ে যাওয়ার সময় মাকে বলে যায় আম্মা বাবা যেন কেমন করছে। রনির মা দৌড়ে যেতেই দেখে তার স্বামীর চোখগুলো যেন কেমন হয়ে গেছে সে বলছে আমাকে তাড়াতাড়ি নামিয়ে নিয়ে যাও আমার খুবই খারাপ লাগছে। রনির মা রনির বাবাকে ধরতে ধরতেই রনির বাবা ঢলে পড়েন হাত পা গুলো যেন অসাড় হয়ে আসে মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে থাকে রনির মা তো কাঁদতে থাকেন এরই মাঝে রনির দুই চাচা ও ভাড়াটিয়া একজন এসে ছাদ থেকে নামিয়ে আনেন সিরাজ উদ্দীন খানকে এবং রনি একটি সি এন জি ডেকে আনেন রনির বাবাকে সি এন জিতে উঠানো হয় সাথে রনির মা ও দুই চাচা হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন পরের গাড়িতে রনির আরো দুই চাচা সহ আরো কয়েক জন রওয়ানা দেন। এদিকে পথি মাঝেই রনির বাবা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। হাসপাতালের নেয়ার পর কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোসনা করেন। ডাক্তারটা আরো ভালো করে দেখেন এবং বলেন উনি ব্রেইন স্টোক করেছেন। ভেতরে অনেক রক্তক্ষরন হয়েছে এবং ঘাড়ের একটি রগ ছিড়ে মারা গেছেন। হাসপাতালের করিডোরে কান্নার রোল পড়ে যায়।
রনির বাবাকে বাসায় আনা হয় কিন্তু বাসার ভেতরে আর নেয়া হয়না। বাসার সামনেই একটি খাটের উপর রাখা হয় এবং একটি চাদরে ঢেকে রাখা হয়। এখন আর কেউ বলেনা সিরাজ উদ্দীনখান বরং বলে সিরাজ উদ্দীন খানের লাশ। সবাই বলে একটি লাশ। কেউ আর নাম উল্লেখ করেনা। কেউ তার নিজ বাড়িতে রাখার কথাও বলেনা কারন রনির বাবা এখন শুধু একটি লাশ। এখন আর তার সেই আগের মূল্যায়ন নেই। এখন শুধু সবাই অপেক্ষা করছে কখন কাফন হবে আর কখন দাফন হবে। মসজিদের মাইকে বলা হচ্ছে অমুকের ছেলে অমুক ইন্তেকাল করিয়াছেন "ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজীউন"। অমুক সময় জানাজা হবে। রনির দাদী কাঁদে, মা কাঁদে, রনি কাঁদে, রনির চাচারা ও ফুপুরা কাঁদে একি হলো নিজের বাড়ির কাজ ধরেছে ছাদ হয়েছে আরো কিছুদিন পর বাড়িতে উঠবে অথচ তার আগেই পরোপারের ডাক এসে গেলো। কেউই কিছু বুঝতে পারলো না কি থেকে কি হলো? একটু আগেও যে লোকটি সিড়ি দিয়ে হেঁটে ছাদে উঠেছেন সেই লোকটি আর নিজের পায়ে হেঁটে ছাদ থেকে নামতে ও পারলেন না। একটু আগে যিনি ছাদ থেকে এসে নাস্তা করবেন বলেছেন তিনি আর কোনদিন নাস্তা করতে পারবেন না। নাস্তা তৈরি হলো, বাড়ির ছাদ ও তৈরি হলো, মাথা থেকে একটি বোঝা নামলো ঠিকই কিন্তু যিনি এতটা পরিশ্রম করে সবকিছু সহজ করে দিয়েছেন তিনি নিরবে চলে গেছেন পারোপারের ডাকে। কেউ তাকে আটকে রাখতে পারলোনা। একেই বলে "ওপারের ডাক" যখন সময় ফুরিয়ে যায় স্বপ্ন বাকি থাকলেও আর পূরনের সুযোগ থাকেনা। চুপচাপ চলে যেতে হয়। এই যে সিরাজ উদ্দীন খান জীবনের সকল প্রয়োজন মোটামুটি পূর্ণ করেছেন কিন্তু ওপারের প্রয়োজন কতটুকু পূর্ণ করেছেন তাই লক্ষনীয় বিষয়। যখন ডাক এসেছে সবকিছু ফেলে চলে গেছেন স্ত্রী, পুত্র, কন্যা কাউকেই বলে যেতে পারেননি তার চলে যাওয়ার কথা। সব সম্পদ পড়ে আছে, স্ত্রী ও সন্তানেরা ও রয়ে গেছে শুধু তিনি চলে গেছেন সবকিছুর মায়াকে চির ছিন্ন করে। এভাবে আমাদের সবাইকেই চলে যেতে হবে। কেউ হয়তো স্বজনকে বলতে পারবো আর কেউ হয়তো বলতেও পারবোনা। তাই এখানের আবাসস্থল তৈরির আগে ওপারের আবাসস্থল তৈরি করা জুরুরী আমাদের সকলের। কারন আমরা কেউই জানিনা কার জীবনের সূর্য কখন অস্তমিত হবে। কেউই জানিনা কোনদিন আর হবেনা জীবনের সূর্যদ্বয়। তাই আমাদের সবারই আখেরাতের সামানা আগে গুছাতে হবে। জীবনের শেষ সন্ধ্যা আসার আগেই আমাদের সকলকে প্রস্তুত হয়ে থাকতে হবে যেন সেই যাত্রা হয় কল্যানের দিকে, শেষ আবাসস্থল হয় চির শান্তির আবাসস্থল। আল্লাহর খাস রাহমাত ও ক্ষমা নিয়ে যেন সবাই সেই যাত্রা শুরু করতে পারি। মহান আল্লাহ আমাদেরকে ঈমান ও আমলের সাথে কবুল করুন।
"বাড়ির জায়গায় রইলো বাড়ি
মালিক গেলো কোথায়?
সম্পদের জায়গায় সম্পদ থাকলো
মালিক শূন্য গেলো সেথায়।
এভাবে আসা যাওয়া
বাস্তবতা কঠিন।
হঠাৎ করে মৃত্যু আসা
পৃথিবীর নির্ধারিত রুটিন।
পৃথিবীর সকল ব্যস্ততা
সকল চাহিদা পাশে পড়ে থাক।
প্রস্তুত হই ওপারে যেতে
কখন আসে যে "ওপারের ডাক"
মদিনা মনোয়ারাহ
২৯ শে নেভেম্বর ২০১
বিষয়: সাহিত্য
১৩৪৪ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যাযাকুমুল্লাহ আপনাকে
ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
যাযাকুমুল্লাহ আপনাকে
মালিক গেলো কোথায়?
সম্পদের জায়গায় সম্পদ থাকলো
মালিক শূন্য গেলো সেথায়।
ক্ষণস্হায়ী জীবনের মিথ্যে মোহে পড়ে চির স্হায়ী আবাস স্হল পরকালীন সময় কে একেবারেই ভূলে যাই আমরা!
চিন্তার মোড় ঘুরানো দরদময় উপস্হাপনা অনেক ভাল লাগল!
ধন্যবাদ ও জাযাকুমুল্লাহু খাইরান জানাচ্ছি!
কবি কায়কোবাদের কবিতাটি আপনার মনে পড়ে কি " যে ভুলে তোমাকে ভুলে, হিরা ফেলে কাছ তুলে, ভিখারি সেযেছি আমি, আমার সে ভূ্ল প্রভু তুমি ভেঙ্গে দাও"
মন্তব্য করতে লগইন করুন