"আলোকিত হবে যে"
লিখেছেন লিখেছেন মাহবুবা সুলতানা লায়লা ১৮ মে, ২০১৪, ০২:৫২:১০ রাত
অস্বস্তিতে আছে রাত্রি! কাউকে বলতেও পারছেনা আবার মনের মাঝে রাখতেও পারছেনা! কেমন যেন অপরাধী অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে! কেন এমন হলো? কেন এমন হয়? কলি না হতেই, ফুল হয়ে না ফুটতেই ঝরে যেতে হয়! না! রাত্রি পৃথিবীর মানুষের কাছে লজ্জিত হতে পারবে কিন্তু সে আল্লাহর কাছে কিছুতেই লজ্জিত হতে পারবেনা! কাউকে না কাউকে বলতেই হবে এই কথা! কাকে বলা যায়? ভাবতে ভাবতে মন থেকে জবাব আছে তুমি তোমার প্রিয়তম স্বামীকেই বলো! দেখবে সমাধান পাবে খুব সহজে! সে তাই করবে চিন্তা করে রাখে!
রাত্রির বিয়ে হয়েছে সবে মাত্র দুই মাস! এরই মাঝে সুসংবাদ এসেছে রাত্রি মা হতে যাচ্ছে! কিন্তু এই সুসংবাদটা ওর শশুর পরিবারের কেউই মেনে নিতে পারছেনা! তারা বলছে এখন কয়েক বছর যাক তারপর! কিন্তু রাত্রির স্বামীর সম্মতিতে রাত্রি পড়েছে বিপাকে! সে কি করবে? কার কথা মানবে? একদিকে নতুন সংসারের সদস্য সে! অন্যদিকে একজনের স্ত্রী! প্রায় প্রতিদিনই কাজের ফাঁকে শাশুড়ী বলে তোর কি নিজের কোনস্বাধীনতা নেই? কেন তুই আমার ছেলের কথায় এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা নিচ্ছিস? তোর নিজের মত খাটাতে পারিস না? রাত্রি কি বলবে? কোন জবাব জানা নেই তার! অনেক সাহস আর লজ্জা ভেঙে বলে যে আম্মা আপনার ছেলের ইচ্ছা! তারপরও মানাতে পারেনা শাশুড়ীকে! তিনি এক কথার মানুষ! যে করেই হোক এ সন্তান যেন না হয়! তাই তিনি নেমে গেলেন চেষ্টায়! অবশেষে রাত্রি তার প্রিয়তম স্বামীকে বলে আম্মা এসব বলছে কি করবো? আমার এই বিষয়গুলো এমনিতেই খুব লজ্জা লাগে! আর মুরুব্বীদের সাথে কথা বলতে তো আরো বেশী লজ্জা! স্বামী বলে আমি সবকিছু ম্যানেজ করছি তুমি এই বিষয় নিয়ে কোন রকম দূশ্চিন্তা করবেনা! তুমি তোমার মত চলো!
এদিকে রাত্রির স্বামী কয়েকদিন আগে কি জন্য যেন বলেছে আমার অগচরে যদি আমার আব্বা আম্মা তোমাকে কোন ওষধ খেতে দেয়! সাবধান আমাকে না দেখিয়ে খেওনা! রাত্রি কোন প্রশ্ন করেনা! শুনে শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়! কারন এই পরিবারে সে নতুন কাকে কি বলবে? আবার কোন সমস্যার সৃষ্টি হয় কিনা! এজন্য যে যা বলে রাত্রি শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়! কয়েকদিন পরেই (বলে রাখি রাত্রির শশুর হোমিও প্যাথিক ডাক্তার!) উনারা স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে একটি ওষধ এনে দিলো রাত্রির হাতে! রাত্রি হাতে নিয়ে জানতে চাইলো কিসের ওষধ আব্বা? বলল তোর শরীর দূর্বল তাই এ ওষধ দিয়েছি কাজ না হলে দুইদিন পর আবারও পাল্টে দেব! রাত্রির মনে হলো স্বামীর নিষেধের কথা! সে বললো আচ্ছা ঠিক আছে! বলেই রেখে দিলো ওষধ! স্বামী তখন বাসায় ছিলোনা! সে আসলো অনেক রাতে! খাবার খেয়ে, ঘুমাতে যাওয়ার সময় রাত্রির মনে পড়েছে ওষধের কথা! স্বামীকে বলে আব্বা আম্মা এসে এই ওষধ দিয়ে গেছে! রাত্রির স্বামী তো পেরেশান তুমি ওষধ খেয়েছ? রাত্রি বলে, না! খাইনি! তুমি না আমাকে নিষেধ করেছিলে? তাই খাইনি! পরেরদিন রাত্রির বাবার বাড়ি যাওয়ার তারিখ ছিলো! রাত্রির স্বামী বললো ঠিক আছে এক কাজ করো এই ওষধ তো খাবেই না এবং এবাড়িতেও ফেলবেনা! কাল তোমাদের বাড়িতে যাওয়ার পথে ফেলে দেব! রাত্রি বললো কি সমস্যা এই ওষধে? ওর স্বামী রাগত কন্ঠে বললো কোন প্রশ্ন করোনা! যা বলেছি তাই করো! তোমাদের বাসায় যে ব্যাগ নেবে তাতে রেখে দাও এই ওষধ!
রাত্রি ওষধ রেখে দিলো! তখন ওর স্বামী আবার বলে উঠলো ওষধ খেয়েছ কিনা এসব আব্বা আম্মা জানতে না চাইলে, ইচ্ছে করে কিছু বলোনা! রাত্রি মাথা নাড়ে! পরদিন চলে গেলো বাবার বাড়ি! ওখানে গিয়ে স্বামী প্রকাশ করলো আমার বাবা মা চাচ্ছেনা আমাদের সন্তান হোক! কিন্তু আমি চাই! আমি খাওয়াবো! আমি পালবো! এখন উনারা যা বলে আমার চাওয়ার কারনে তোমাকে তা মেনে নিতে হবে! চুপ করে থাকে রাত্রি! কি হবে তার অনাগত সন্তানের? যাক আল্লাহ ভরসা! স্বামী তো তার সাথে আছে! রাত্রির স্বামী নির্ধারিত সময় পরে পাড়ি জমাবে প্রবাসে! রাত্রিকে ভাসিয়ে দিয়ে যাবে আল্লাহর উপর ভরসা নামের ভেলায়! রাত্রির আত্মীয় স্বজনেরা ও রাত্রির শাশুড়ীকে বুঝায় যে অনেকে তো অনেক চেষ্টা করেও ছেলে মেয়ে হয়না আর আল্লাহ আপনাদেরকে খুশি হয়ে দিতেছে আপনারা নিতে চান না! এখন কোন ব্যবস্থা করে নিলোনা! এরপর যদি আর নাই হয় তখন কি করবেন? তখন আমাদের মেয়ের কোন দোষ দিতে পারবেননা! রাত্রির চাচী ফুফু খুব বুঝালো বেয়াইনকে! রাত্রির শাশুড়ী কারো কথাই মানতে রাজি নন!
রাত্রির স্বামী রাত্রিকে বাপের বাড়ি রেখে নিজের বাড়িতে যায়! সারাদিন সেখানে থাকে সুযোগ বুঝে মাকে ডেকে বলে মা একটা কথা বলি কিছু মনে করবেন না তো? মা বলে বল কি বলবি? ছেলে বলে মা বলেন তো আমার বয়ষ কত? মা বলে কেন একত্রিশ বছর! ছেলে বলে যদি আমি বাইশ বছরে বিয়ে করতাম তবে এখন আমার আট নয় বছরের একটি আর চার বছরের একটি ছেলে বা মেয়ে থাকতো তাইনা? মা বলে হাঁ থাকতো! কিন্তু এসব কথা এখন কেন বলছিস? ছেলে বলে রাত্রি পরের মেয়ে ওকে বকে, রাগ করে কোন লাভ নেই কারন সন্তান আমি চেয়েছি ভুল আমি করেছি বকতে হয় আমাকে বকুন! আর যা বলার আমাকে বলুন! পরের মেয়েকে কিছু বলবেন না আর! মা বলে এযুগের মেয়ে সে কিছুদিন খেলাতো বেড়াতো এরপর বাচ্চা হলে ভালো হতো! এত তাড়াতাড়ি হলে সে তো কিছুই করতে পারবেনা! ছেলে বলে মা! আল্লাহ যাকে যা দেয় সে যোগ্যতা দিয়েই দেয়! আপনি দয়া করে ওকে আর কিছু বলবেন না! আপনি পরের মেয়ের দিকে না তাকিয়ে আপনার ছেলের দিকে তাকান! আর কয়েক বছর পর যদি বেবী আসে তবে আমি তাদেরকে কবে লালন-পালন করবো? আমার বয়ষ শেষ হয়ে যাবে আর ওরা তখন ও ছোট থাকবে! ভাবুন তখন ওদেরকে কে মানুষ করবে? মা চুপ করে যায়! আচ্ছা তোদের যা ভালো লাগে কর গে আমি তোদের ভালো মন্দ কোনটাই আর বলবোনা! ছেলে মাকে অনেক বুঝায়! এরপর আল্লাহর কৃপায় মেনে নিলো বিষয়টা তবে অটতা খুশি নন! তারপরও কিছুটা সহজ হলো রাত্রির জন্য! এবার রাত দিন গণনা করে পাড় করছে সময়! পূর্ণ বিশ্বাস আল্লাহর উপর রেখে! আর অনেকটুকু সাহস যোগাচ্ছে তার স্বামী প্রবাস থেকে কল করে করে! নানা রকম শান্তনা দেয় প্রতিদিন প্রতিরাতে!
এভাবেই সময় গড়িয়ে মেয়াদপূর্ণ হবার আরো একমাস বাকি কিন্তু এখন নতুন সমস্যা হলো ছেলে হবে? না মেয়ে হবে? শশুর বাড়ির সবাই ছেলের আকাংখা নিয়ে বসে আছে! কিন্তু মহান আল্লাহর ইচ্ছা ভিন্ন তিনি যা চান তাই হবে! রাত্রির কিছু সমস্যা ছিলো (সে এই অবস্থায় একবার এক্সিডেন্ট করেছিলো হুন্ডা এক্সিডেন্ট যা ওর পেটের উপর উঠে গিয়েছিলো) সে ভয়ের কারনেই আলট্রা সাউন্ড করাতে হলো! আর রাত্রিও জানতে পারলো যে তার মেয়ে হবে! আর এর আগেই রাত্রি গভীর ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখে তার একটি সুন্দর মেয়ে হবে! সে এই কথাটা তার স্বামীকে বলে! স্বামী বলে স্বপ্ন তো স্বপ্নই তাইনা? আল্লাহ যা দেয় আমি তাতেই খুশি! এখন ডাক্তারের কথা শুনে রাত্রি তার কান্না কিছুতেই লুকাতে পারছেনা! সে কাঁদছে! অঝর ধারায় হচ্ছে তার কান্না! ডাক্তার জানতে চায় কেন কাঁদছেন? নিজে থেকেই বলে আপনার শশুর বাড়ির লোকেরা ছেলে চেয়েছিল তাইনা? এখন মেয়ে হবে জেনে কাঁদছেন? সে চুপ থাকে! ডাক্তার বলে এজন্যই এখন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি কাউকেই বলা হবেনা ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে! শুধু সমস্যার কথা বলা হবে! কারন কয়েকদিন আগেও একটি পরিবার মেয়ে হবে জেনেই বউকে তালাক দিয়েছে! একটি সুন্দর সংসার ভেঙে গেলো! এখন থেকে আর বলা যাবেনা! কারন জেনে যেহেতু সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে না বলে যদি মানুষদের সংসার টিকে থাকে সেটা অনেক ভালো! ডাক্তার কথাগুলো শুনে রাত্রি ডাক্তারের রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো! বাহিরে ওর ফুফু ও মা বসা ছিলো! রাত্রি ভাবছে কাউকেই বলবেনা তার কি সন্তান হবে! সে ভাবছে তার মেয়ে হবে জানলে সবাই আগে থেকেই মেয়েটাকে অবহেলা অবজ্ঞা করবে? তাই সে নিজের মা বাবা এবং শশুর বাড়ির কাউকেই জানালো না তার মেয়ে হবার কথা! শুধু জানালো তার স্বামীকে! স্বামী খুব খুশি প্রকাশ করলো রাত্রির কাছে! আর বললো আল্লাহ তো কত মানুষকে কন্যা সন্তান ও দেন না! আর আমাদেরকে তো মেয়ে হলেও দিচ্ছেন! আমি সন্তুষ্ট আছি! তুমিও থাকো! আপাতত কাউকেই বলোনা! যখন এসে যাবে তখন আর কেউই কিছু করতে পারবেনা! রাত্রি মেনে নেয় স্বামীর কথাগুলো!
দশমাস পূর্ণ হয়েই একটি সুন্দর ফুটফুটে কন্যা সন্তান হলো রাত্রির! গভীর শীতের রাত! রাতের সাড়ে বারোটায় একটি কন্যা শিশু আসলো পৃথিবীতে! পরদিন সোমবারের সূর্যদ্বয় এ কন্যার জন্য প্রথম সূর্যদ্বয়! ওর মায়ের মনে হতে লাগলো যে আলোকিত হবে পৃথিবীর আলোয়! যে হাসবে পৃথিবীর রাতে ও দিনে! যে খেলবে পৃথিবীর অলি-গলিতে তাকে কে বাঁধা দিয়ে আসতে নিষেধ করে! কারন তার রিযিক তো সে নিয়েই আসছে তার প্রতিপালকের থেকে! রাত্রির স্বামী যখন এই খবর জানতে পায় যে তার একটি কন্যা সন্তান হয়েছে এবং সে সুস্থ আছে তখন সে আল্লাহর প্রিয় ঘরে গিয়ে সিজদায় পড়ে গেলো! কাঁদতে কাঁদতে তার চোখের পানিতে যেন মুখটা ধোয়া হয়ে গেলো! সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেই আবার কল করলো বেবীর মা কেমন আছে? জানলো এখনো ওটিতে ( অপারেশন থিয়েটারে) আছে! তবে ডাক্তার বলেছে ভালো আছে!
পরদিন সোমবার সকালে স্বামীর কল পেলো রাত্রি! গত বিকেল থেকে আর কথা হয়নি মনে হচ্ছে কতদিন যেন কথা হয়নি প্রিয় মানুষটার সাথে! মোবাইল হাতে নিতেই দেখলো মেসেজে ভরে আছে ইনবক্স! আচ্ছা পরে দেখবো! কল রিসিভ করে সালাম বিনিময়ের পর স্বামী অভিনন্দন জানালো রাত্রিকে রাত্রির মনে খুব প্রশান্তি পেলো তার জীবন সাথীর ইচ্ছাটা পূর্ণ হয়েছে! সে সশব্দে আলহামদুলিল্লাহ পড়লো শুনে তার স্বামী ও পড়লো! রাত্রি তখন তার স্বামীকে বললো আমরা একটি আয়াতের আমল করতে পেরেছি! কারন আমরা হত্যা করতে চাইনি তাকে যে পৃথিবীতে আসবে মা-বাবার দু-চোখকে শীতল করতে! হতে পারে সে হবে পৃথিবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একজন! হতে পারে তাকে দিয়ে আল্লাহ দ্বীন ইসলামের কাজ করাতে পারেন! দুজনেই বললো ইনশা-আল্লাহ! ফোন রেখে দিলো সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে!
وَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلاقٍ نَّحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَإِيَّاكُم إنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خِطْءًا كَبِيرًا (31
দারিদ্রতার ভয়ে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না। তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমিই জীবনোপকরণ দিয়ে থাকি। নিশ্চয় তাদেরকে হত্যা করা মারাত্নক অপরাধ!
সূরাহ বনী-ইসরাইল আয়াত ৩১
আমরা সকলেই শিশুদের জন্য উদার হৃদয় ধারন করি! যে আসতে চায় তাকে আসতে সুযোগ করে দেই! হত্যা না করি! তাকে পৃথিবীর আলো বাতাস দেখতে সুযোগ করে দেই! আমরা সকলেই পৃথিবীতে মানুষ আগমনের ধারাকে সহজ করে দেই যেন আল্লাহ বলে ডাকার জন্য অনেক অনেক মু'মিন বান্দা বান্দি থাকে পৃথিবীতে আর পৃথিবীরও আয়ু বৃদ্ধি করি কারন একজন মানুষ যতদিন আল্লাহ বলার জন্য পৃথিবীতে থাকবেন পৃথিবী ততদিন ধ্বংস হবেনা! মহান আল্লাহ আমাদেরকে তৌফিক দিন! আমিন!
বিষয়: সাহিত্য
১৩৬২ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন