মদিনার চত্বরে (৩)
লিখেছেন লিখেছেন মাহবুবা সুলতানা লায়লা ১৩ এপ্রিল, ২০১৪, ০২:৩০:৫৪ দুপুর
প্রেমময় মদিনা"
সংসার সন্তান পালন এরপর ইচ্ছে করে তো বেশীটা সময় মসজিদে নব্বীতে বসে কাটাই! কিন্তু প্রতিদিন হয়ে ওঠেনা হারামে যাওয়াটা! এরপরও চেষ্টা করি সপ্তাহের চার, পাঁচ, ছয়দিন নামাজ পড়তে! সবকিছু মিলিয়ে মসজিদে নব্বীতে নামাজ পড়তে যাই কয়েকদিন পর পর! আসরের আগে যাই আসর, মাগরীব, কখনো এ'শা পড়ে আসি কখনো মাগরীব পড়েই বাসায় আসি কারন মাগরীবের আগেই আমার সাথির অফিস ছুটি হয়, ও যদি বেশি ক্লান্ত থাকে তবে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যাই আর নয়তো অনুরোধ করি অথবা সে জানতে চায় কখন যাবো বাসায়? আমি জেনে নেই সে ক্লান্ত কিনা। ক্লান্ত না হলে আমার এ'শা পড়ে যেতেই ভাল লাগে! বেশীর ভাগ সময় এশার নামাজ পড়েই যাই বাসায়!
মসজিদে নব্বীর ভেতরে আসলে যে বিষয়টি হৃদয়ের রক্ত ক্ষরন ঘটায় তা প্রকাশ না করে পারছিনা! প্রতিদিনই কেউ না কেউ গত হয়ে যাচ্ছেন। দিনগুলো যেমনি করে সপ্তাহ, মাস, বছর, যুগের রুপ নেয় এরপর রুপ নেয় শতাব্দীতে আমাদের পাশের মানুষগুলোও তেমনই করেই আমাদের চোখেরা সামনে থেকে গত হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন স্রষ্টার বাঁধা-বাঁধিত নিয়মের সাথে! কোন বিরোধ নেই মহান মালিকের হুকুম অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পূর্ণ হলেই শুরু হয় এই সফর! কেউ বলে যেতে পারেনা তার আপন প্রিয়মতকেও যে, আমি না ফেরার দেশে চলে যাচ্ছি! আর আপনজনেরাও পারেনা তার অপূর্ণ ইচ্ছাগুলো পূরন করতে! আপনজন, সংসার, সমাজ, পৃথিবী সবকিছুর মায়া-মমতা ছিন্ন করে স্মৃতির অর্ন্তরালে লুকিয়ে পড়েন! পৃথিবীতে আমরা সবাই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা অবস্থায় আমরা আমাদের কত ইচ্ছাকে পরিবর্তন করি, কত-শত রঙে সাজাই আমাদের স্বপ্নগুলোকে, মনের ইচ্ছা মত পোষাকে আবৃত করি নিজেকে, কখনো লাল রঙে, কখনো সবুজ রঙে, কখনো মিশ্রিত রঙে, মনের গভীরের আকাংখা গুলোকে পূর্ণ করতে কতটাই না সচেষ্ট হই, আবার এসব ব্যপারে কখনো কখনো সফল ও হই! কিন্তু নিয়মের বিপরীতই আল্লাহর নিয়ম বাস্তব হওয়া! তখন আর মত পরিবর্তনের কোন সুযোগ নেই, নেই সাজানো-গুছানোর আয়োজনের বাহানা, আল্লাহর ডাক এসে গেছে, কোন কথা নেই, বলা নেই, কওয়া নেই চুপিসারে রওয়ানা দেন সবাই! পাওয়া নাপাওয়ার হিসাব ভুলে! অর্জন যা করেছেন সবকিছু রেখে! কোটি কোটি অর্থের সম্পদ, রাজপ্রাসাদসম বাড়ি, কোটি টাকার গাড়ি, সবকিছু! সাথে নিচ্ছেন সামান্য কয়েকশত টাকা মূল্যের কাফন! যার রঙ শুধুই সাদা! এখন আর রঙের ব্যপারে অভিযোগের কোন সুযোগ নেই, যে যাই করো, যেভাবেই সাজায় সেভাবেই মেনে নেয়!
প্রথম যেদিন হারামে গেছি সেদিন ছিল ৩১ জানুয়ারী শুক্রবার! জু'মারদিন! আমরা জু'মার সামান্য আগে গিয়ে পৌছি! হেঁটে হেঁটে যখন মসজিদে নব্বীর ভেতরে যাচ্ছি তখনই চোখদু'টো জুড়িয়ে গেল হারামের সৌন্দর্যে! ভাললাগার সাথে সাথে চোখে পানি এসে গেল! সাথে সাথে প্রার্থনা করেছি হে আল্লাহ আমার দেশের প্রতিটি মানুষকে এবং উম্মতে মোহাম্মদীর সমস্ত মানুষকে জীবনে একবার হলেও তোমার হাবীব (সঃ) এর প্রিয় জম্মভূমি এবং হিজরত ভুমি দেখার সুযোগ করে দিও, আর সরেজমিনে দেখার সৌভাগ্য না হলে স্বপ্নে হলেও দেখিও! আমিন! সমজিদে নব্বীর মাইকে খুৎবার আওয়াজ ভেসে আসছে সবাই বসে খুৎবা শুনছে, এমন সময় পিছনদিক থেকে একদল লোকছুটে আসছে, আরো পরে একদল লোক একটি খাট বহন করে আনছে! একটি লাশের খাট! কার ভাই? কার বাবা? কার স্বামি? কার সন্তান? কিছুই জানিনা কেন যেন মনটাতে তার জন্য মায়া হলো; দোয়া করলাম হে আল্লাহ আমি তো জানিনা উনি কার কি হয়? কিন্তু সে তো তোমারই বান্দা-বান্দি তুমি তার কবরকে জান্নাতের টুকরো বানিয়ে দিও! আর আখেরে জান্নাতুল ফেদাউস নসীব করো। আমিন! হারামে কতহাজার হাজার লোক এই জানাজার নামাজে শরীক হলো! আমি ভয়ে চুপসে গেলাম, মনটা আচমকা কেঁদে উঠলো, আমি কল্পনার ভেলায় ভর করে অনুভব করতে থাকলাম আমি তো কোন এক সময় এভাবেই কিছু মানুষের কাধে চড়ে পাড়ি জমাবো সেই না ফেরার দেশে! তাদের মাঝে হয়তো আমার স্বজনেরা থাকবে নয়তো থাকবে সবাই অপরিচিত! সব কিছু রেখে পাড়ি জমাবো ওপারে! আমি জানিনা কোন দোকানে আমার কাফন জমে আছে, কোন কবর হবে শেষ ঠিকানা, হারামে আসলে প্রতিদিনই কারো না কারো জানাজার নামাজ পড়তে দেখি! কখনো একজনের, কখনো কয়েকজনের একসাথে! জানিনা কার কি হয়, কার স্বজন? অচেনা অজানা মানুষটি এক সময় হয়তো হারামের এই চত্বরে বসে তাসবীহ জপে ছিল, কখনো সিজদাহ করেছিল সৃষ্টিকর্তা স্রষ্টাকে আর আজকে চলে গেলো সবছিন্ন করে! স্বজন, সংসার, সন্তান, অর্থ, বিত্ত, প্রাসাদ, হারামের চত্বর, এমন কি পৃথিবীর সব ভালবাসা সাথে চিরদিনের জন্য সম্পর্ক ছিন্ন করে। আমরা মানুষ শুধু পাওয়ার হিসাব করি কতটুকু চাওয়া পূর্ণ হল? কতখানি বাকি রয়ে গেলো কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছি আমার পাশের মানুষটির কথা জীবনের সব চাওয়াই কি পূর্ণ করতে পেরেছেন তিনি? আমরা নিজেরা নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ করতেই ব্যস্ত আরেকজনের খোজ নেবার সময় কোথায়? হতে পারে সে ব্যক্তিরও অনেক আশা আকাংখা অপূর্ণ রয়ে গেছে! আমাদের বেলাতে ও এর ব্যতিক্রম হবেনা! সময় হলে চলে যেতে হবে সবকিছু রেখে! ফুল দিয়ে সাজানো বেড রুম, ফার্নিচার দিয়ে সাজানো ড্রইং রুম, বড় করে ডাইনিং টেবিলের চারিদিকে সুন্দর চেয়ারে সাজানো ডাইনিং রুম, ব্যাংকে কোটি কোটি জমাকৃত টাকা, এমন কি প্রিয়তম স্বামির ভালবাসা, সন্তানের মমতা সবকিছু ছিন্ন করে! মহান স্রষ্টা মালিকের ডাক এসে গেলে বিরোধ করার কোনই সুযোগ নেই, একান্ত অনিচ্ছা সত্বেও পাড়ি জমাতে হবে সেই ডাকের সাথে সাথে!
ভাবছি; চলে তো যেতেই হবে! কিছুক্ষন আগে পরে! এটাই চরম সত্য বাণী! তবে ঈমানের মত মূল্যবান সম্পদ কি নিয়ে যেতে পারবো সাথে? পারবো কি স্বর্নতুল্য মূল্যের আমলকে সাথি বানাতে? পারবো কি প্রিয়-অপ্রিয় সবার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে? যদি মহা মূল্যবান আমল, ঈমানের মত সম্পদ থাকেও আর এর সাথে থাকে হাজার জনের হক্ব, এসব হক্ব অপূর্ন রেখে গেলে উপায় কি হবে? কার কি চাওয়া পাওয়া দাবি দাওয়া ছিল সেই দায়ের কি হবে? নয়তো কঠিন হাশরের মাঠে দিয়ে দিতে সেই মূল্যবান আমলের নেক, হক্বের দায়ে সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে আর আমি উঠবো মিসকিন হয়ে! হে আল্লাহ এই কঠিন ক্ষনে তুমিই আমার ঈমান বাঁচিও, হে আল্লাহ এই কঠিন ক্ষনে তুমি আমার বন্ধু হইও! আরো প্রার্থনা করি মৃত্যু তো দেবেই হে আল্লাহ; তবে যখন তুমি বেজারি থাকো তখন দিওনা! তখন আমার উপর খুশি থাকো তখন দিও..........................আকুল প্রার্থনা! মদিনার চত্বরে আসলেই বেশী বেশী মৃত্যুর কথা স্বরন হয়! বেশী স্বরন হয় নামাজের পরপরই কারন কারো কারো জানাজা উপস্থিত হয়েই আছে নামাজ শেষ হলেই শুরু হবে আরেক নামাজ তার নাম; জানাজার নামাজ, রুকু সিজদাহ বিহীন নামাজ, এক সালামের নামাজ, সবার জন্য দোয়া রইলো ঈমানের সাথে মৃত্যু আর হেদায়াতের জীবন! আমার জন্যও দোয়া করবেন!
http://www.onbangladesh.org/blog/blogdetail/detail/1729/mslaila/42615#.U1eG2lcTD_w মদিনার চত্বরে (২)
চলছে--- চলবে।
বিষয়: বিবিধ
১৩৭১ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পোস্টে প্লাস++++
জাযাকাল্লাহ খায়ের
আমার আব্বা হজ্বের পর মক্কা শরিফে ইন্তেকাল করেছিলেন বলে তার জানাজা হয়েছিল মাসজিদুল হারাম এ।
মসজিদে নববির আর্কিটেকচার নিয়ে কিছু লিখুন।
আপনার সাথে কথা বলতে পারলে ভাল লাগত। আমার মদীনায় যাবার এবং থাকার ইচ্ছে আছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন