‘’প্রিয় থেকেও পরম প্রিয়’’

লিখেছেন লিখেছেন মাহবুবা সুলতানা লায়লা ১৬ জুন, ২০১৩, ০৯:৩২:৫৯ রাত

সমস্ত প্রশংসাই মহান আল্লাহর। যিনি আমাদেরকে আদম সন্তান রুপে গড়েছেন। মুসলমানের সন্তান করে সৃষ্টি করেছেন। এবং এখনো মা বাবার স্নেহের পরশে রেখেছন আল............লাহ। মহান আল্লাহর কাছে অসংখ্য অসংখ্য শুকরিয়া এজন্যই যে, তিনি আমার মা এবং বাবাকে নেক হায়াত দিয়েছেন। আমি প্রার্থনা করি আমার মা বাবাকে মহান আল্লাহ আরো নেক হায়াত দারাজ করেন। দুনিয়াতে সম্মানের সাথে রাখেন আর ঈমানের সাথে মৃত্যু দেন।

ছোটবেলা থেকে আব্বুকে খুবই কম কাছে পেয়েছি। সেই সকালে কাক ডাকা ভোরে চলে যেতেন দোকানে আবার আসতেন রাতে যখন আমরা ঘুমিয়ে যেতাম। আমার বাবা ছিলেন ফলের ব্যবসায়ী। একা একা ঘাট করা, মাল আনা, সেগুলো আবার দোকানে সাজানো, রাতে বসে বসে বেচাকেনা করা। সময় কোথায় যে, আমাদেরকে সময় দিবে? তবে সময় দিত না পারলেও উনি শুকনা খাবার খুব বেশি করে ঘরে আনতেন আর বলতেন কখন কি খেতে চায় তা কিনে দিতে বলতেন। আমার আব্বু একটা অভ্যাস হল উনি কাউকে কোন টাকা হাতে দিবে না। যা খেতে ইচ্ছা করবে তা কিনে আনবে ঘরে সবাই মিলে খাবে।

সকল ক্ষমতাই মহান আল্লাহর, সমস্ত প্রশংসাই আল্লাহর। আমার মত ছোট বান্দির মহান আল্লাহর দানের প্রশংসা করে কখনোই শেষ করতে পারবেনা। তবুও এই ক্ষুদ্র জবানে মহান আল্লাহরই প্রশংসা করি। আমি এই পৃথিবীতে মহান আল্লাহ ও তার প্রিয় হাবীব (সঃ) এর পরে আমার বাবাকে বেশি পছন্দ করি। আল.........লাহ আমার বাবার পক্ষ থেকে যেকোন বিষয়ে যতটা সাপোর্ট পাই আর কারো থেকে তা কখনোই আশা করতে পারিনা। আর আমার বড় ভাইও নেই বাবাই সবকিছু করে দেন আমাদের। তিনি বাজারের সবচেয়ে উত্তম পোষাক আমাদের জন্য আনতেন। সবচেয়ে দামী খাবার আমাদেরকে খাওয়াতেন। দামী বলতে এখানে আমি বুঝাতে চাইছি একই জিনিস অন্য লোকে কিনছে সামান্য কম দামে, যেগুলো একটু আধটু পঁচা, বা দাঁগী কিন্তু আমার বাবা বলতেন ছেলে মেয়ের জন্য নেবো বাজারের সেরাটা না হলে হয়? আর আমিই যদি কম দামী বা পঁচাটা তালাশ করে কিনে আনি তবে আমার সন্তানেরা ভাল কেনাকাটা কিভাবে শিখবে? আমার থেকেই তো শিখবে ভাল বাজার করা, ভাল মানের পোষাক কেনা ইত্যাদি ইত্যাদি।

বাবাকে নিয়ে স্বরণীয় একটি ঘটনা বলি হয়তো আপনাদের ভাল লাগবে। ঘটনাটা এরকম, আমার বাবা সব সময় চাঁন রাতে আমাদের জন্য কেনাকাটা করতেন। আমরা রাতে ঘুমিয়ে থাকতাম আর মাঝরাতে বাবা আমাদের সবার ঈদের পোষাক কিনে এনে আমাদেরকে ঘুম থেকে জাগাতেন। আর যার জন্য সেই পোষাক তার টা তার হাতে তুলে দিতেন। একবার হল এর ব্যতিক্রম রমজানের ঈদে আমার বাবা আমাদের ঈদের পোষাক কিনতে পারেনি সময়ের অভাবে। আর আমরাও হতাশ হইনি, আত্মীয় স্বজনেরা কেউ কেউ এসে বলছে, এবার তোর বাবা তোদেরকে পোষাক না দিয়ে টাকা জমাবে, পোষাক কিনতে গেলে বেশি খরচ হবে তাই কিনবেনা। আমি বলছি আমার বাবা যদি পোষাক নাও কিনে দেয় তবুও আমার আফছুছ করবোনা। কারন বাবা তো সব সময়ই আমাদের জন্য ভাল টা জিনিসই ক্রয় করে। একবার যদি না দেয় তাতে কি? আমাদের আগের যে পোষাক আছে তাই পরবো। আমার জেঠি আম্মা বলছে, কেন তোরা ঠকবি? তুই তোর বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকবি তবে তোর বাবা ঈদের দিনেই তোদের জন্য মার্কেট করে আনবে। আমি বলি না আমরা কাঁদবোনা। কারন আমার বাবার ইচ্ছা হলে দেবে নয়তো দিবেনা কাঁদবো কেন? চাঁন রাত শেষ হয়ে সকাল হয়ে এলো কই বাবাতো সত্যিই এলোনা সবাই এসে আবারও সেই কথাগুলো বলছে তোর বাবা টাকা বাঁচিয়েছে তোদেরকে জামা কাপড় না কিনে দিয়ে। আমি বলেছি থাক, আমাদের তো ঈদের বাজার করেছে। আর আব্বু যদি ঈদের পোষাক না কিনে দিয়ে খুশি থাকে তবে আমরাও খুশি আছি। ঈদের দিন সকালে যেই না আব্বু ঘরে এলো তখনই আমার দাদা আব্বুকে ধমকের সুরে বলল কিরে আমার নাতীনদের জন্য কিছু কিনিসনি? আব্বু খুবই নরম ভাষায় বলল আব্বা রাতে কিনবো কিনবো করে বেচা কেনার কারনে কিনতে পারিনি। থাক, কিনিনি যখন পরে কিনে দেব সমস্যা কি? আমার দাদা বললেন না; এখন ঘুমানো লাগবেনা আগে যাও তোমার জন্য কিছু কেনো আর নাই কেন আমার দুই নাতীনের জন্য জামা এনে ঘুমাও, নয়তো আমি কিছু খাবোনা। আব্বু ঘরে এসে বলে তোরা কি তোর দাদার কাছে আমার নামে নালিশ করেছিস? মা বললেন না নালিশ করবে কেন? ওরা তো আরো সবার কাছে বলছে আমার আব্বু এবার কিনে দিতে না পারলে পরের বার কিনে দেবে। আমার জেঠি এসে আব্বুকে অনেক কথা বলে আব্বু সাথে সাথে মার্কেটে গিয়ে আমার ও আমার ছোট বোনের জন্য জামা কিনে আনছে। আমরা তো মহা খুশিহয়েছিলাম সেদিন। কারন আমার আব্বু আমাদেরকে সচরাচর সময় খুব কমই দিতে পেরেছে। কারন তার ব্যবসা, কিন্তু আমার দাদা ভাইয়া আমাদেরকে সময় দিতে উপদেশ দিতো আমার আব্বুকে, বিষয় গুলো ছিল এরকম;

(১) সপ্তাহে শুক্রবারে বা যেকোন দিন ছেলে মেয়েদের সময় দিবা।

(২) তাদের প্রয়োজন অপ্রয়োজনের খবর নিবা।

(৩) ওদের পড়াশুনার খবরা খবর নিবা।

(৪) কার কি দরকার তা জেনে তা এনে দিবা।

(৫) ওদের কে কি খেতে পছন্দ করে সপ্তাহে তা এনে খাওয়াবে।

(৬) কারো অসুখ বিসুখ হলে সময় মত খোজ নিয়ে ডাক্তার দেখাবা। মনে রেখ তোমার সন্তান তোমার মত করে কেউ দেখবেনা।

(৭) কখনো কোন সন্তান যদি কিছু তোমার কাছে আশা করে তবে তা সরাসরি নিষেধ করবেনা। বরং বলবে যে, বাবা সামনে দিতে চেষ্টা করবো।

(৮) কোন ব্যপারেই নিরাসা প্রকাশ করবেনা। বরং তাদেরকে আল্লাহর প্রতি ভরসা করতে শেখাবে।

(৯) কোন ব্যপারেই মহান আল্লাহ থেকে তুমিও নিরাস হবেনা আর সন্তানদেরকেও নিরাস হতে দেবেনা।

(১০) সব সময় তুমি নামাজ পড়বে আর সন্তানদেরও নামাজের তাকিদ দেবে। তাদেরকে বুঝাবে নামাজের গুরুত্ব, নামাজের ফজিলত, আর নামাজ না পড়ার কঠিন আযাবের কথা।

(১১) মাঝে মাঝে সন্তানদের মাঝে মহান আল্লাহ গুণ কীর্তন বা প্রশংসা করবে যাতে সন্তানেরা তা শিখতে পারে। তুমি যত মনোযোগ দিয়ে তোমার সন্তানদের দ্বীন, আক্বিদা শিখাবে তারা ততটা গুরুত্বের সাথে তা মানবে। আর একবার তা অন্তর দিয়ে বুঝতে পারলেই তা আর কখনোই ছুটবেনা। বরং তা খুব মূল্যায়নের সাথে পালন করবে।

(১২) তুমি যে কোন বিষয় যতটা গুরুত্বের সাথে আলোচনা করবে তোমার সন্তানেরা ততটা গুরুত্বের সাথে তা পালন করতে সচেষ্ট হবে।

(১৩) তুমিই যদি আল্লাহ বিধান পালনে অলসতা করো তবে সন্তানদের থেকে তার চেয়েও ভাল কিছু আশা করতে পারবেনা।

(১৪) বাজারে সবচেয়ে সেরা খাবার খাওয়াবে সন্তানদের। কারন তুমি ভাল জিনিস কিনবে তাতে সন্তানেরা ভাল জিনিস কিনতে শিখবে।

(১৫) তুমি বাসায় আসলে খোজ নেবে তোমার পরিবারের সদস্যরা সবাই নামাজ পড়েছে কিনা। সবাই রাতে খেয়েছে কিনা। মনে রেখ দায়িত্বশীল বাবাই পারে সন্তানদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে।

(১৬) আমি থাকবো না কিন্তু আমার কথাগুলো থাকবে হয়তো কারো ভাল লাগবে আবার কারোর কাছে আমার এই কথাগুলো খারাপ লাগবে তাতে কি? একজনও যদি তাদের সন্তানদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে তবে আমি খুবই খুশি হবো।

(১৭) আর আমার নাতীদের থেকে পারলে সবাইকে না পারলে একজনকে হলেও আলেম বা হাফেজ বানাইও। আমি মরলে তো আমার নাতী বা নতনীরা আমার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দু;হাত তুলে দোয়া করতে পারবে। আমার গুনাহ গুলোর জন্য ক্ষমা চাইতে পারবে।

(১৮) তোমরা আমার কথা গুলো রেকোডিং করে রাখো আমার নাতী বা নাতনীদের শুনাইও যাতে তারা আমার কথাগুলো রাখতে সচেষ্ট হয়।

(১৯) আর কখনোই নামাজ ত্যাগ করনা। আর ছেলেদের নিয়ে জু’মার নামাজের দিন মসজিদে যাবে যাতে করে তাদের মসজিদে যাওয়ার অভ্যাস হয়।

(২০) আর আমাকে তোমরা সবাই অন্তরের অন্তস্থল থেকে ক্ষমা করে দিও, কেউ কোন দাবী রেখনা আমার উপর আমি তোমাদেরকে যথাযথ ভাবে পালন করতে পারিনি। তোমাদের সব চাহিদা মেটাতে পারিনি। আর আমি তেমন কোন সম্পদও তোমাদের জন্য রেখে যেতে পারবোনা। তবে তোমরা ভাইয়ে ভাইয়ে মিলে মিশে থেকো তাতে করে কেউ কখনো তোমাদের কে কিছ বলতে হিসাব করে বলবে। মনে রেখ একটি লাঠি খুব সহজে ভেঙে ফেলা যায়। আর দশটি লাঠি ভাঙা সহজ নয়। আর তোমরা একত্র হয়ে থাকলেই দশটি লাঠির মত হবে কেউ কখনোই তোমাদের সামান্য ক্ষতি করতে পারবেনা।

এইগুলো ছিল আমার দাদার মনের কথা। যেগুলো আমি পেয়েছি একটি ক্যাসেটে রেকোডিং করা। আমি মাঝে মাঝে শুনতাম। আর আমার দাদার জন্য দোয়া করতাম। আমার দাদার অনেকগুলো গুণ ছিল যেগুলো পরে কখনো সময় করে লিখবো। আজকে বাবা দিবসে শুধুই দাদাকে মনে পড়ছে কারন আমার দাদা ভাই ছিল খুবই ধার্মিক তিনি খুব নম্রতার সাথে সবাইকে ভাল কাজের পরামর্শ দিতেন। আমার দাদা নেই তবে দাদার কথাগুলো আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে না পারলেও চেষ্টা করি পালন করতে। আজকের এই দিনে আমার বাবার জন্যও আপনাদের কাছে দোয়ার প্রার্থী আর আমার দাদার জন্যও আপনাদের সবার বাবার জন্য আমার আন্তরিক দোয়া। প্রিয় থেকে পরম প্রিয় এই মানুষটার জন্য আজকে মনটা খুবই কাঁদছে। আর তাইতো মন ভরে দোয়া করছি মহান আল্লাহ যেন আমার দাদা ভাইকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করেন। আমার দাদার সব গুনাহ মাফ করে দেন। আমার দাদার সবচেয়ে ভাল গুণ যেটা ছিল তা হল উনি সবসময় খুব জিকির করতেন এবং বিশেষ করে শিশুদের কোলে করে। মহান আল্লাহ উনার এই ভাল গুণের কারনে যেন উনার জীবনের সব গুনাহ মাফ করে দেন।

আমিন। আমিন। আমিন।

বিষয়: বিবিধ

১৮১৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File