মিশ্র সংস্কৃতির চাপে পড়ে কেমন আছেন? আন্দামান-নিকোবরের মুসলিম অধিবাসীরা
লিখেছেন লিখেছেন এম এ আলীম ২৬ মে, ২০১৩, ০৪:০৭:৩৯ রাত
‘মেয়ে যদি তার পছন্দের পুরুষের হাত ধরে ঘর ছাড়ে তো আমি আর কি করতে পারি।’ এক হিন্দু ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যেয়ে বিয়ে করা একটি মুসলমান মায়ের এই খেদোক্তি দিয়েই এই প্রবন্ধটা শুরু করা যাক
আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের মুসলিম সমাজের বাবা-মা-রা তাদের অল্প বয়সে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের চালচলন ও স্বাধীন আচার-আচরণের মত এতটা স্বাধীনচেতা ও উচ্ছৃঙ্খল ছিলেন না। স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে আন্দামানের বর্তমান বয়স্ক প্রজন্মকে ব্রিটিশরা এখানে নিয়ে এসে জমি-জায়গা দিয়ে বসতি স্থাপন করতে সাহায্য করেছিল। এদের মধ্যে মুসলমানরা ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও ধার্মিক। গোটা দ্বীপপুঞ্জে এখন প্রায় ২৫০টি মসজিদ। কিন্তু বর্তমান তরুণ মুসলিম প্রজন্মের জীবনযাত্রায় ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতির কোন ছাপ নেই। উন্মত্ত ও উদ্দাম মিশ্র সংস্কৃতি আজ আন্দামানে ইসলামী সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় এক বড় বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে।
আন্দামানে এখন বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে মিশ্রবিবাহ প্রায়ই হচ্ছে। সব ধর্মের তরুণদের মধ্যেই উচ্ছৃঙ্খল ও ভোগবাদী সংস্কৃতি প্রবেশ করেছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের তরুণদের মধ্যে মদ্যপানের প্রতি আসক্তিও বাড়ছে। ভারতের মূল ভূখন্ড থেকে কেন্দ্রশাসিত এই দ্বীপরাজ্যে অন্যান্য নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সঙ্গে মদ আমদানী করার সরকারি নীতিও পরোক্ষভাবে দ্বীপের অধিবাসীদের মধ্যপানে অভ্যস্ত হতে সাহায্য করছে। জুমাবার ও ঈদের নামাযকে এখানকার মুসলিমরা নামমাত্রভাবে পালন করেন। বেশির ভাগ মসজিদই জুমাবার ছাড়া একেবারেই খালি থাকে।
বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত এই দ্বীপপুঞ্জে ছোট-বড় ৩০০টিরও বেশি দ্বীপ আছে। এগুলোর মধ্যে মাত্র ৩৫টিতে জনবসতি আছে। বাকি দ্বীপগুলোতে প্রকৃতি যেন তার সবটুকু সবুজ উদার হাতে ঢেলে দিয়েছে। গোটা দ্বীপপুঞ্জের চোখ ধাঁধানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সোনালী বেলাভূমি প্রতি বছর কয়েক হাজার দেশি-বিদেশী টুরিস্টকে এখানে টেনে আনে।
এই দ্বীপে ১৭৮৯-এর আগে কোন অভিযাত্রী পা দেয়নি। ১৮৫৭-তে ভারতের ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ হয়, যা ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। ১৮৫৭ থেকে ১৮৬০-এর মধ্যে প্রায় ২০০০-৪০০০ সিপাহীকে এই দ্বীপে নির্বাসনদন্ড দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনে ধরা পড়া বহু বন্দীকেই শাস্তি হিসেবে হাতকড়া পরিয়ে ব্রিটিশরা মূল ভূখন্ড থেকে আন্দামান চালান করত। এভাবে ভারতের প্রায় সমস্ত অঞ্চলের দন্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত স্বদেশীদের নিয়ে গড়ে ওঠা আন্দামান অচিরেই হয়ে উঠল এক খুদে ভারত। এখন ৩৫টি দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে থাকা অধিবাসীদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ। এদের মধ্যে হিন্দু, মুসলিম, খ্রীস্টান ও শিখ সব ধর্মের লোকই আছে। অধিবাসীদের ১০ শতাংশ হল মুসলিম। এসব মুসলিম অধিবাসীদের পূর্বপুরুষরা অধিকাংশই ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর দ্বীপের অধিকাংশই ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর দ্বীপের অধিকাংশ অধিবাসীই ভারতের মূল ভূখন্ডে ফিরে গেলেও- কিছু সংখ্যক মানুষ দ্বীপে থেকে যাওয়াই ভাল মনে করেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল কুখ্যাত সেলুলার জেলে বন্দীদের তালিকায় কোন মুসলমানের নাম উল্লেখ নেই। যদিও একথা সত্য যে দ্বীপরাজ্যের মোপিল্লা (দক্ষিণ ভারতীয়) মুসলিমদের অধিকাংশই সেই সব স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বংশধর যারা ১৯২১- এ দক্ষিণ ভারতের ‘মালবার মোপিল্লা স্বাধীনতা আন্দোলনের’ বিদ্রোহের প্রাক্কালে এই দ্বীপে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হল-ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের যেমন-মালয়ালী, তামিল, তেলেগু, বাঙালি এবং সেই সঙ্গে হিন্দি ও উর্দুভাষী মুসলিমদেরও এখানে দেখা পাওয়া যায়। এখানকার সব চেয়ে বড় মসজিদ হল- রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ারে অবস্থিত জামে মসজিদ। বাবরী মসজিদের সাথে এর কিছুটা সাদৃশ্য আছে।
ধর্ম ও সংস্কৃতির সামাজিক বাতাবরণ মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর একটা সূক্ষ্ম প্রভাব ফেলেছে। অন্য সম্প্রদায়ের উৎসব-অনুষ্ঠানে মুসলমানরা অংশগ্রহণ করে- যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতার সুন্দর উদাহরণ।
সকলেই এখানে শান্তিতে ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করে। এই দ্বীপে এখন পর্যন্ত কোন রকম সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ঘটেনি। কিন্তু তার মানে কি এই যে একটা বৃহৎ সম্প্রদায় অপেক্ষাকৃত ছোট একটা সম্প্রদায়ের সমস্ত বৈশিষ্ট্যকে বিলুপ্ত করে দেবে? নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসী নিকোবরবাসীদের উৎপত্তি মঙ্গোলিয়ান জাতি থেকে। এদের মধ্যে খ্রীস্টান ও মুসলমান দুই ধর্মের মানুষই আছে। নিকোবরী মুসলিমদের হার বিশ শতাংশ।
আন্দামানের মুসলিমদের এই রকম হতাশাব্যঞ্জক সামাজিক অবস্থার মধ্যেও আশার আলো হল আত্মনিবেদিত একদল মুসলিম নতুন স্বপ্ন নিয়ে দ্বীপের দাওয়াতের মাধ্যমে এই দ্বীপপুঞ্জে ইসলামিক সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু করেছেন। পোর্ট ব্লেয়ারের এক গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এই লক্ষ্যে ‘মধুর সন্দেশ ভবন’ নামে একটি নতুন ইসলামিক কেন্দ্র গড়ে উঠতে চলেছে। আশা করা যায় এভাবেই দ্বীপরাষ্ট্রের মুসলিম অধিবাসীরা তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় তুলে ধরতে পারবে। উল্লেখ্য এই দ্বীপের অধিবাসীদের অনেকেই বাংলাভাষী।
বিষয়: বিবিধ
৪৪৭০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন