একজন বৈমানিকের আত্মকথন
লিখেছেন লিখেছেন মেরাজ ০৪ জুলাই, ২০১৫, ০৩:৩৪:৩২ রাত
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর কোন একটা বিমান দুর্ঘটনার পর সাধারণ মানুষের মতামতের সারমর্ম অনেকটা এই রকম "বিমান বাহিনী কিছু বস্তা পচা বিমান চালাচ্ছে, আর আমাদের দেশের সম্ভবনাময় ছেলে গুলো ক্রেশ করে নির্মম ভাবে মারা যাচ্ছে।" অনেকে আবার বিমান বাহিনী আর সরকারকে ব্যাপক বকাঝকাও করে থাকেন। আমি অবশ্য এই ব্যপারটাকে সাধারণ মানুষের ঐ সব বৈমানিকের প্রতি ভালবাসারই বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখি।
এইবার একটা বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করি। আমরা যখন ইউএন মিশনে থাকি তখন আমাদের নানা ধরনের প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে উড্ডয়ন করতে হয়। অগনিত বার আমাদের হেলিকপ্টার আক্রমনের স্বীকার হয়েছে। আমাদের বৈমানিক উড্ডয়নরত অবস্থায় গুলি খেয়েছে। তা থাক ঐ সব কথা, এবার আসল কথায় আসি। একদিন suddenly সব পাইলটদের ডাকা হল কনফারেন্স রুমে। ইউএন প্রতিনিধি ব্রিফিং করলেন। ব্রিফিং এর সারমর্ম বলি। ইউএন force এর সাথে রেবেলদের যুদ্ধ চলছে, তারা ইউএন সৈন্যদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। রেডিওয়ের মাধ্যমে ইউএন force জানিয়েছে তাদের বেশ কয়েক জন মারা গেছে আর জরুরী ভিত্তিতে তাদের তুলে না আনলে বাকীরাও মারা পরবে কারন তাদের গোলাবারুদ শেষের পথে। শত্রুর মধ্য থেকে ইউএন সৈন্যদের তুলে আনা কতটুকু বিপদজনক একবার ভেবে দেখুন। তারপর আমাদের বলা হল এই মিশনের জন্য কাওকে ডিটেল করা হবে না, আমি আপনাদের কাউকে বলবও না এই মিশন কেরি আউট করার জন্য। কিন্তু আপনারা যদি এই মিশন না করেন তাহলে ঐ সৈন্যদের কপালে কি আছে তা সহজেই অনুমেয়। আর আমরা খুব ভাল করেই বুঝতে পারছিলাম ফায়ার পাওয়ার (আকাশ থেকে অন্য একটা এয়ারক্রাফট এর মাধ্যমে গোলাবর্ষণ) ছাড়া এমন মিশন কেরি আউট করা আর সুইসাইড করা অনেকটা একই। সবশেষে জিজ্ঞাস করলেন, আপনারা কেউ কি এই মিশন কেরি আউট করতে চান? প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই সব গুলো হাত মাথার উপরে। ভদ্রলোক ৫ সেকেন্ডের জন্য স্তব্দ হয়ে গেলেন। বললেন সব জানার পরও আপনারা সবাই এই টাইপের একটা মিশন করতে আগ্রহী......!! একবার ভাবুন, একটা অচেনা দেশের অচেনা সৈন্যদের বাঁচানোর জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতে যারা এক সেকেন্ড সময় নেয় না তারা নিজের দেশের নিজের মানুষের জন্য কতটুকু করবে...!! কিন্তু কিঞ্চিৎ দুঃখ হয় তখনি যখন দেখি এই নিজের দেশের মানুষগুলা একজন তরুন বৈমানিকের সাগরে নিখুজ হওয়ার খবরে বিদ্রুপ মূলক কমেন্ট করে (যদিও তার সংখ্যা কম)।
এবার মৃত্যু নিয়ে অল্প কিছু কথা বলি। মৃত্যু ভয়ংকর, এতে কোন সন্দেহ নেই। আর সেই মৃত্যু যদি হয় বিমান দুর্ঘটনা তাহলেতো আর কথাই নেই। বিমান দুর্ঘটনায় মৃত ব্যাক্তিদের চেহারা এতটাই ভয়ংকর হয় যে সাধারণত ঐ লাশ তার বাবা-মা বা স্ত্রীকে দেখতে দেয়া হয় না। আমি প্রথম বিমান দুর্ঘটনা কবলিত মৃত দেহ দেখি সম্ভবত ২০০৬ সালে। ফ্লাইট ক্যাডেট তানিউল, বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান যাকে আমি সকালে অফিসের বারান্দায় হাঁটতে দেখলাম, সেই তানিউলের লাশ দুপুরে হেলিকপ্টার থেকে নিজ হাতে নামালাম। সে কি ভয়ংকর দৃশ্য। মৃত মানুষের চেহারাযে এতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তা আমি নিজে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। আমার মনে আছে ঐ রাতে আমি আমার রুমের বাতি নেভানোর সাহস পাইনি। মানুষ অভ্যাসের দাস। তারপর থেকে মৃত দেহ দেখতে দেখতে অভ্যাস হয়ে গেল। ৭/৮ জন বৈমানিকের জানাযা পরেছি, বিধ্বস্ত বিমানের মধ্যে বৈমানিকের শরীরের মাংস লেগে থাকতে দেখেছি, স্বামীর পোড়া মৃত প্রায় শরীর দেখে স্ত্রীকে অজ্ঞান হতে দেখেছি, ছেলে হারা মাকে শাড়ির আচল মুখে ডুকিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে দেখেছি, অসহায় বাবাকে তার আদরের ছেলেকে হারিয়ে পাগলের মত আচরণ করতে দেখেছি, দেখিছি ভাইকে এক কোনায় দাড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিস্তেজ হয়ে মাটিতে পরে যেতে। আর তখনি মনে হয়েছে যাদের জানাযা পরছি, তাদের জায়গায় আমি থাকতে পারতেম, ঐ সব অসহায় আত্মীয়- স্বজনের জায়গায় থাকতে পারত আমার আপন কেউ। যতবার ভেবেছি, ততবারই আতংকে শিউরে উঠেছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, নিজে যখন আকাশে উঠি তখন আর বিন্দু মাত্র আতংকিত হইনা। ভয় নামক শব্দটাই যেন জীবনের ডিকশেনারী থেকে গায়েব হয়ে যায়। বিমানের ইঞ্জিন চালু হওয়ার সাথে সাথে যেন হয়ে যাই অন্য জগতের এক মানুষ, ভয়-ডর কিছু নেই, মনে হয় খোলা আকাশে মুক্ত বিহঙ্গের মত ঘুরে বেরানোর জন্যই হয়তো জন্ম।
বিশ্বাস করুন, আমাদের কেউ জোর করে উড্ডয়ন করাচ্ছে না। আজ যদি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সব পাইলটদের এক জায়গায় বসিয়ে জিজ্ঞাস করা হয়- পর পর দুইমাসে দুই জন মারা গেল, ভবিষ্যতে হয়তো আর মরবে, এখন তোমাদের কে সুযোগ দেয়া হচ্ছে, তোমরা ইচ্ছা করলে বিমান উড়ানো বাদ দিয়ে গ্রাউনডে যে কোন ব্রাঞ্ছে জয়েন করতে পার? হলফ করে বলতে পারি- একজন পাইলটও রাজী হবে না।
আর বিমান অত্যন্ত জটিল একটা যন্ত্র। এই যন্ত্রের প্রতিটি অংশের একটা নিজস্ব লাইফ থাকে। এই লাইফ শেষ হওয়ার পর তা আর ব্যবহার করার সুযোগ নেই। একটা নির্দিষ্ট সময় পর পুরো বিমানকেই তার মেনুফাকচারের কাছে পাঠানো হয়। এবং অবশেষে বিমানের লাইফ শেষ হয়ে গেলে তার জায়গা হয় মিউজিয়ামে অথবা শোভা পায় রাস্তার বিভিন্ন মোড়ে। আর একটা বিমানকে এত পরিমান টেস্টের উপর দিয়ে প্রতিনিয়ত যেতে হয় যে বিমানের প্রান থাকলে হয়তো উঠে বলত - বাবা মাফ করে দে, আর কত...!!
মেইনটেনেন্স খারাপ হলে সবার আগে আমরাই প্রতিবাদ করতাম। কারন আলটিমেটলি জীবন গেলেতো আমারটা যাবে, মেইনটেনেন্স স্টাফদের তো কিছু হবে না। তাহলে কেন আমরা মেইনটেনেন্স-এর সাথে কম্প্রমাইজ করব......!!!
"দয়া করে বিনা কারনে না বুঝে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে গাল-মন্দ করবেন না"। এই বাহিনী আপনার, এই দেশ আপনার আর বাংলা মায়ের স্বাধীনতা রক্ষার স্বপ্নে যে সব নির্বোধ (জীবনের ঝুঁকি থাকা স্বত্তেও যারা জেনে শুনে এই কাজ করছে, তাদের নির্বোধ ছাড়া আর কি বা বলা যেতে পারে) জীবনের ঝুকি নিয়ে আকাশে উড়ে বেরাচ্ছে তারা আর কেউ না, আপনাদেরই একজন।
বিষয়: বিবিধ
১৫৪৫ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যথাযথ লেখেছেন।
একটা প্রশ্ন বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড সম্পর্কে আপনার জানা আছে?মানে তারা কতটা সাহসী।
না মনে কিছু করবেন না,আগে বিডিআর যখন ছিল তখন ইন্ডিয়া আর মায়েনমারের বাহিনী নাকি অনেক ভয় পেত তাদের সাথে লড়াই করতে। কিন্তু বডার গার্ড নাম করনের পর তা আর দেখা যাচ্ছে না।
তবে শিকার ভুলেনি সুযোগ আর সময়ের অপেক্ষায় আছে। আর যে গুলো দেশের ভিতরে গুলি করে মানুষ মারে তারা হায়না কিংবা নেকড়ে প্রকৃতির কাপুরুষ মতো জানোয়ার
শ্রদ্ধেয়
এই পোষ্টটি অনেক ভালো লেগেছে । অনেক ধন্যবাদ । আশা করি এই রকম পোস্ট আপনার কাছ থেকে আরো পাবো । জনপ্রিয় নিউজ সাইট http://www.onn24.com এ আমি চিফ রিপোর্টার হিসেবে দায়িত্বরত । আমাকে আপনার লিখাগুলো পাঠাবেন । আমি তা প্রকাশনার ব্যাবস্থা করবো। আমার ইমেইল
মন্তব্য করতে লগইন করুন