যুদ্ধাপরাধ বিচার নিস্পত্তিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সংশ্লিষ্টতা জরুরী

লিখেছেন লিখেছেন তুষারের মত ০১ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৩:১০:১৭ রাত

যুদ্ধাপরাধ আইন বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশে মানবতা বিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) বিচারের মুখোমুখি জামায়াত নেতাদের আইনজীবীদের উপদেষ্টা টবি ক্যাডম্যান বিচারকে প্রভাবিত করতে প্রকাশ্য সরকারী হস্তক্ষেপের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বিষয়টির যৌক্তিক ও ন্যায়সসঙ্গত নিস্পত্তির জন্য জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সংশিষ্টতা কামনা করেছেন। তিনি বলেন, এ বিচার নিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের দফতর থেকে জরুরী ভিত্তিতে একটি বিবৃতি দেয়া প্রয়োজন।



গত ২৯ ডিসেম্বর শনিবার সন্ধ্যায় নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের একটি রেষ্টুরেন্টে জনাকীর্ণ এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি এ আহবান জানান। কোয়ালিশন অফ বাংলাদেশী আমেরিকান এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আয়োজিত মতবিনিময়ে সূচনা বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট মানবাধিকার নেতা মাহতাবউদ্দিন আহমেদ। টবি ক্যাডম্যান বলেন, ট্রাইব্যুনাল ও বিচার নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের অন্যান্য মন্ত্রীদের বক্তব্যে এটি সুষ্পষ্ট যে বিচার পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুতর অসততার বিষয় প্রমাণিত হওয়া সত্বেও এ ব্যাপারে সরকার ভ্রুক্ষেপও করছে না। ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া সত্বেও তদন্ত করা ও নতুন করে বিচার শুরু করার পদক্ষেপ নেয়ার আইনসঙ্গত কারণ সৃষ্টি হওয়া সত্বেও সরকার বিতর্কিত বিচার অব্যাহত রেখেছে, যা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

টবি ক্যাডম্যান বলেন, ট্রাইব্যুনাল-১ এ চেয়ারম্যান নিজামুল হক ও জিয়াউদ্দিনের মধ্যে যে আলাপ হয়েছে তাতে এটি ষ্পষ্ট যে শুরু থেকেই ট্রাইব্যুনাল স্বাধীন ছিল না। সরকার যতই দাবী করুক না কেন, ট্রাইব্যুনালের গঠণ প্রক্রিয়া ও সংশ্লিষ্ট বিধিতে যে ত্রুটি রয়েছে তা সংশোধন না করার কারণে এটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল তো নয়ই, জাতীয় ট্রাইব্যুনালও নয়। ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ফৌজদারি আইন ও সাক্ষ্য আইনকে গ্রহণ করা হয়নি এবং আন্তর্জাতিক আইনের ধারেকাছেও যায়নি। ফলে ট্রাইব্যুনালের বিচারে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার যে দাবী সরকার করে আসছে তা রাখা তো দূরের কথা, জাতীয় মানও বজায় রাখা সম্ভব হবে না। তিনি বসনিয়ায় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটর হিসেবে তার আট বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, বসনিয়ার ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল ছিল না, সেটি তাদের ন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ছিল। কিন্তু বসনিয়া সরকার বিচার পরিচালনায় আন্তর্জাতিক আইনের সহযোগিতা নিয়েছে। সেখানে আন্তর্জাতিক বিচারক, আন্তর্জাতিক প্রসিকিউটর ও আন্তর্জাতিক তদন্তকারীরা ছিল বলে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠেনি। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার ‘সমগ্র বিশ্বের জন্য দৃষ্টান্ত’ সৃষ্টি করতে সকল আন্তর্জাতিক আইন অগ্রাহ্য করেছে।

তিনি বলেন, বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করার কারণে সমস্যা দূর হয়নি, ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। কারণ নিজামুল হক ও জিয়াউদ্দিনের মধ্যে কথোপকথনে অন্যান্য বিচারপতির নাম, একজন প্রসিকিউটর, দু’জন মন্ত্রী এবং একটি সংগঠনের নাম এসেছে। তাদের সাথে বিচারিক কাজের সংশ্লিষ্টতা বের করে ট্রাইব্যুনালকে বিতর্কের বাইরে আনতে হলে নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া আবশ্যক এবং একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমেই শুধু এধরনের তদন্ত করা সম্ভব।

তিনি বলেন, জিয়াউদ্দিনের অবস্থান ও ভূমিকা সম্পর্কে সকলের জানার অধিকার ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে প্রয়োজন আছে। কারণ বিচারের ইতিহাসে এ ধরনের গুরুতর বাত্যয় ইতিপূর্বে কখনো ঘটেনি যে একজন বহিরাগত ব্যক্তি প্রতিটি বিষয়ে প্রিজাইডিং জজকে নির্দেশনা দিচ্ছেন এবং তিনি সেই নির্দেশনা অনুযায়ী আদালত পরিচালনা ও রুল ইস্যু করছেন। বিচারপতি নিজামুল যে ট্রাইব্যুনালে তার পুরো মেয়াদে বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেছেন তাতে সন্দেহ নেই। এমনকি রায়ের বিনিময়ে তার পদোন্নতির বিষয় পর্যন্ত আলোচনায় উঠে এসেছে, এর চেয়ে অনৈতিক আর কি হতে পারে। তিনি ৯০ এর দশকে একজন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে গঠিত গণআদালতের তদন্ত কমিটির সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় বিচারকের আসনে বসতে পারেন না মর্মে অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবীরা আপত্তি করার পরও তিনি পদ থেকে সরে না দাঁড়ানোর পিছনে কি কারণ ছিল তাও জিয়াউদ্দিনের সাথে আলোচনায় বেরিয়ে এসেছে। তাছাড়া বিচার চলাকালে সাক্ষী ঠিক করে দেয়া, সাক্ষীরা কি সাক্ষ্য দেবেন তা দর্শানো, সব কিছু মিলিয়ে একটি প্রতারণামূলক ও প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দকে সংক্ষিপ্ত বিচারের পর তার চেেেয়ও সংক্ষিপ্ত সময়ে রায় কার্যকর করার লক্ষ্য স্থির করে সরকার আইসিটি প্রতিষ্ঠা করেছে।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় অসংখ্য মানুষ নিহত হয়েছে। সংখ্যার হিসেবে তিন লাখ ও ত্রিশ লাখ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সে ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই, অস্বীকার করার কারণও নেই। কিন্তু এ অপরাধ শুধু একটি মাত্র পক্ষ দ্বারা সংঘটিত হয়নি। প্রত্যেক পক্ষ কর্তৃক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। মূল অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত ১৯৫ জন পাকিস্তানী সেনা অফিসারসহ অন্যান্য সকল পক্ষকে বাদ দিয়ে একটি মাত্র পক্ষকে বিচারের মুখোমুখি করার পর থেকেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে আপত্তি উত্তাপিত হয়েছে। বাংলাদেশ যদি বিচারের ব্যাপারে নিষ্ঠাবান হয় তাহলে ১৯৫ জনের যারা এখনো জীবিত আছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরর সহায়তায় তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে পারে। কিন্তু মূল অপরাধীকে বিচারের আওতা বহির্ভূত রেখে সংঘটিত প্রতিটি অপরাধের জন্য সরকারের প্রতিপক্ষ একটি দলের শীর্ষ নেতাদের বিচার করে মৃত্যুদন্ড দেয়ার ঘোষণা দেয়ার মাধ্যমে সুবিচার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, বরং এর পরিণতি বিপজ্জনক হতে বাধ্য। কারণ যারা যে অপরাধ করেনি, তাদেরকে সেই অপরাধের জন্য শাস্তি বিধানের সিদ্ধান্ত নিয়েই বিচারের আয়োজন করা হয়েছে।

বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম যেখানে বিচার শেষ করেছেন, সেখান থেকে বিচার শুরু হবে বলে আইনমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এটর্নী জেনারেলসহ অন্যান্যরা যে যুক্তি যে বিধি প্রদর্শন করছে তা নিজামুল হক যে পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করেছেন তার সাথে সংশ্লিষ্ট নয় বলে বিচার কাজ পুনরায় প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। কারণ এখন উভয় ট্রাইব্যুনালে এমন একজন বিচারকও নেই, যিনি কোন একজন অভিযুক্তের ব্যাপারে পুরো শুনানীতে ছিলেন না। কাজেই আইনের বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী উভয় ট্রাইব্যুনালকে প্রত্যেকের ব্যাপারে প্রথম থেকে শুনানী শুরু করতে হবে এবং যাদের ব্যাপারে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে তাদেরকে অপসসারণ করাও ন্যায়বিচারের দাবী।ু কিন্তু টবি ক্যাডম্যানের মতে সরকার একগুঁয়েমী করে বিচারিক বিষয়ে বিচার বহিভর্’ত লোকদের সংশ্লিষ্টতা ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়ার বিষয়কে আড়াল করার জন্য স্কাইপ ও ইমেইল হ্যাকিং এর ব্যাপাওে তদন্ত করতে উৎসাহী হওয়ায় পাশাপাশি বিচার কাজ যেটি যেখানে ছিল সেখান থেকে অব্যাহত রেখে রায় দেয়ার কথা বলছে। কারণ সরকারের দৃষ্টিতে এটি বিচারকার্যকে বাধা দেয়ার একটি চক্রান্ত ছিল। উদ্ভুত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে টবি ক্যাডম্যান বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বহীন আচরণের উল্লেখ করে বলেন যে এটি এখন দিবালোকের মত ষ্পষ্ট হয়ে গেছে যে সরকার গঠিত ট্রাইব্যুনালের পক্ষে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বিচার পরিচালনা করা অসম্ভব ব্যাপার। অতএব এ সম্পর্কে দ্রুত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে।

http://www.pbc24.com/index.php/news/news-details?news_id=13716

বিষয়: বিবিধ

১০৪৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File