শাহবাগ আন্দোলনে জামায়াতের লাভ
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক ২৫ মার্চ, ২০১৩, ১২:৪৩:২৫ দুপুর
ফিজিক্যাল ক্যজুয়্যালিটি অনলিঃ শাহবাগ আন্দোলন উত্তর পরিস্থিতি ও মানবতাবিরোধী চলমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের বিচার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বিশেষভাবে লাভবান হয়েছে। জামায়াতের ক্ষতি যা হবার তা হলো সাকুল্যে কিছু ফিজিক্যাল ক্যজুয়্যলিটি। অন্ততঃ দুইশত মানুষের প্রাণহানিসহ মামলা-হামলায় আহত-ক্ষতিগ্রস্তদের অবর্ণীয় সাফারিংস হিসাব করলে এটি নিঃসন্দেহে একটা মানবিক বিপরযয়! এমনকি একজন নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুও অপূরনীয় বড় ক্ষতি, সন্দেহ নাই।
জামায়াত-শিবির মিথঃ কিন্তু জামায়াতের সাংগঠনিক লাভ-ক্ষতির দিক থেকে দেখলে চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের। ইসলাম পন্থী দল হিসাবে পরিচিত এই দলটির সারাদেশে সব সেক্টরে রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনশক্তি যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে যে কোন সময়ে প্রাণ বিসর্জনে প্রস্তুত। খোদা না করুক, প্রতিদিন দুই শত কর্মী নিহত হলেও এরা মাসের পর মাস আন্দোলন ও প্রতিরোধ চালিয়ে নিতে সক্ষম। জামায়াতের, বিশেষ করে একে সর্বাত্মকভাবে সমর্থনদানকারী ইসলামী ছাত্র শিবিরের মাঠ পর্যায়ের মোকাবিলার সক্ষমতা-শক্তি বাংলাদেশে অলরেডি একটা মিথ তৈরী করেছে যা অনেকাংশেই বাস্তব।
শাহবাগের ‘গণ’(?) আন্দোলনঃ শাহবাগ আন্দোলনকে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাহ’র ‘লঘু’ দন্ডাদেশের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে যে গাল-গল্প ছড়ানো হচ্ছে তা মোটেও সঠিক নয়। খোদ ইন্ডিয়ান টাইমস প্রত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনেই দাবী করা হয়েছে যে, শাহবাদ আন্দোলনে ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা রয়েছে। ইদানীং টক শো গুলোতে বলা হচ্ছে যে, শাহবাগ আন্দোলন প্রথমে ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ হিসাবে গড়ে উঠলেও বিএনপি এতে যোগ না দেয়ায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একে ‘ছিনতাই’ করেছে!? আদতেই কোন ব্লগার না হয়েও অখ্যাত ইমরান কিভাবে প্রথম থেকেই এর নেতা হলেন? কারা তাঁকে নেতা বানিয়েছে? শাহবাগীদের মূল ব্লগসমূহে এই আন্দোলন গঠন ও এর নেতৃত্ব গঠন নিয়ে কোন লেখা আমার নজরে পড়েনি। আমি সামু’তে লিখেছি প্রায় তিন বৎসর।
আওয়ামী লীগ কর্তৃক শাহবাগ ছিনতাইঃ যারা প্রথম থেকে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, শ্লোগান দিয়েছে, মিডিয়ার প্রতিনিধি হিসাবে অংশগ্রহন করেছে – তাঁরা সবাই ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফন্ট্র ও ছাত্রলীগ ঘরানার প্রাক্তন ও বর্তমান নেতা-নেত্রী। তাঁদের মূল পরিচয়কে যথাসম্ভব আড়াল করে বিভিন্ন সামাজিক পরিচয়ে তাঁরা আবির্ভূত হয়েছিলেন। শাহবাগ ছিলো আপদমস্তক রাজনৈতিকদের একটা ‘অরাজনৈতিক’ সমাবেশ; সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতায় পরিচালিত ‘গণ আন্দোলন’।
শাহবাগ আন্দোলন ছিল প্রকৃত অর্থেই গণ আন্দোলনঃ এর মানে এই নয় যে, শাহবাগ আন্দোলন গণআন্দোলন ছিল না। আমার দৃষ্টিতে শাহবাগ আন্দোলন প্রকৃত অর্থেই ছিল একটা গণজাগরণ। গণআন্দোলন ও বিপ্লব সম্বন্ধে এমনকি শিক্ষিত লোকদের মধ্যেও তাত্ত্বিক অস্পষ্টতা লক্ষ্য করা যায়। যে কোন গণআন্দোলন, সংগ্রাম ও বিপ্লব কোন না কোন সুসংগঠিত শক্তির পরিকল্পিত অংশগ্রহন ও নিয়ন্ত্রণ ব্যতিত সম্ভব হয় নাই, হতে পারেনা। সেটি বায়ান্না’র ভাষা-আন্দোলন বলুন, উনসত্তরের গণআন্দোলন বলুন, একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ বলুন, ৭নভেম্বরের বিপ্লব বলুন, নব্বইয়ের গণআন্দোলন বলুন। প্রকাশ্য হোক বা গোপন হোক, একটা ক্ষুদ্র কিন্তু সংগঠিত শক্তি যখন নিজের ও প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির নিস্ক্রীয় সমর্থকদের স্বীয় দাবীর সমর্থনে সক্রিয় করতে সক্ষম হয় তখন আমরা ভদ্রভাষায় একে গণজাগরণ বা গণআন্দোলন ইত্যাদি বলি। এমতাবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি কোনঠাসা হয়ে একপর্যায়ে রণেভঙ্গ দ্যায়। যাকে আমরা বিপ্লব বলি।
শাহবাগ আন্দোলন কিভাবে ব্যাকফায়ার করেঃ শাহবাগ আন্দোলনের এই গণজাগরণীর নেতৃত্বে যারা ছিলেন তাঁরা সুদীর্ঘ একপ্রকারের গণ-বিচ্ছিন্নতার পরে হঠাৎ করে বসন্তের সুন্দর পরিবেশে এতো লোকজন দেখে অতি-আত্মবিশ্বাসী হয়ে ভুল সমীকরণে পা বাড়ান। তাঁরা জামায়াতকে সিঙ্গেল আউট করার কার্যকর পদক্ষেপের পরিবর্তে তাঁদের আরাধ্য ডিইসলামাইজেশানের এজেন্ডাকে বিভিন্ন মাত্রা ও পরিচয়ে প্রকাশ্যে হাজির করে ফেলে। রাজীবকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ হিসাবে প্রতিকায়ন তাঁদের প্রথম বড় ধরনের ভুল পদক্ষেপ। পরিণতিতে ইসলাম কার্ড নিয়ে অগ্রসর হওয়া ইতোমধ্যে কোনঠাসা জামায়াতের লাভের পাল্লা দ্রুত ভারী হতে থাকে। সৃষ্টি হয় জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তির পক্ষে পাল্টা গণজাগরণের।
জামায়াতের অতিরাজনৈতিকতার রোগঃ এদেশের আলেম সমাজ একসময়ে রাজনীতিকে হারাম মনে করতেন। জামায়াতে ইসলামীর এটি এক নম্বরের অবদান যে, তাঁরা পুরো আলেম সমাজকে রাজনীতিতে টেনে আনার কাজে সক্ষম হয়েছেন। ইসলাম ইজ এ কমপ্লিট কোড অফ লাইফ – এটি এখন বিশেষভাবে জনপ্রিয় শ্লোগান। পাগলকে ভাল করতে গিয়ে পাগল সুস্থ হয়েছে বটে তবে সেবা-শুশ্রষাকারী নিজেই বেশ খানিকটা পাগলে পরিণত হয়েছেন! জামায়াতের অবস্থা হয়েছে অনেকটা অনুরূপ। এ কথার তাৎপর্য হলো এই যে, জামায়াত তাত্ত্বিক ইসলামের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাকে গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে নিজের অজান্তে ও অঘোষিতভাবে অতি-রাজনৈতিকতার দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে। মুখে বা নিজেদের সাহিত্যে যতই দাবী করুক যে, জামায়াত একটা ইসলামী আন্দোলন, বাস্তবে জামায়াত নিজেকে ইসলামপন্থী একটা রাজনৈতিক দল হিসাবে প্রতিপন্ন করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে দু’বছরের সেনা শাসনের সময়ে সকল রাজনৈতিক কাজ নিষিদ্ধ করার পরে জামায়াত কর্তৃক সকল ধরনের সাংগঠনিক কর্মকান্ড বন্ধ রাখা এর অন্যতম প্রমাণ।
ৎ
একদেশদর্শীতা হতে মুক্ত হওয়ার কাজে জামায়াতের ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টিঃ যাহোক, শাহবাগ আন্দোলনের ধাক্কায় এই চরম একদেশদর্শীতা হতে মুক্ত হওয়ার একটা সুযোগ জামায়াত, অন্ততঃ জামায়াতের জনশক্তি অর্জন করেছে। তাঁরা সেটি কাজেও লাগাচ্ছে। নারী অধিকার, বিনোদন সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি, প্রযুক্তি ও গণমাধ্যম - এসব গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সেক্টরগুলোকে কাজে লাগিয়ে বামধারা এদেশে একটা সাংস্কৃতিক বলয় সৃষ্টি করে যার ধাক্কায় জাতীয় পতাকা লাগিয়ে সরকারী গাড়ীতে ঘুর বেড়ানো জামায়াত নেতাদেরকে লাল দালানের বাসিন্দা করতে সক্ষম হয়েছে। অত্যন্ত কুৎসিতভাবে জামায়াতের নেতাদের মিডিয়া ট্রায়াল সম্পন্ন করলেও বামধারার বেহিসাবী থিংকট্যঙ্কয়ের অতি-বিপ্লবী তোড়জোড়ের কারনে দ্রুততরভাবে এই জাগরণমঞ্চ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ততক্ষণে, শাহবাগ আন্দোলনের ধাক্কায় সেসব অবহেলিত কিন্তু অতিগুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে জামায়াত কর্মীগণ (ব্যক্তিগতভাবে হলেও) ব্যাপকভাবে কাজ শুরু করেছে। নিঃসন্দেহে এটি জামায়াতের মৌলিক লাভ।
জামায়াতের সংগঠনবাদীতার জোয়াল হতে নিষ্কৃক্তি প্রচেষ্টাঃ আমার জানা মতে, জামায়াতের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষকতার চাকুরী করা সদা-সক্রিয় ও নিবেদিতপ্রাণ এক কর্মী প্রশাসনিক তথা রাজনৈতিক ও নৈমত্তিক সাংগঠনিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষক দায়িত্বশীলদেরকে বারম্বার বলাবলি করার পর কোন কাজ না হওয়ায় একপর্যায়ে লিখিতভাবে প্রস্তাব ও অনুরোধ পেশ করেন। সেই ত্যাগী কর্মীর প্রস্তাবণা নিয়ে একটা মিটিং করার সময় ও গরজ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলগণ অনুভব করেন নি। সেই কর্মীর অনড় মনোভাবের কারনে অবশেষে দুজন দায়িত্বশীল তাঁর সাথে ‘কন্টাক্ট’ করে বলেন, ‘‘এসব কাজ তো সংগঠনের করবার নয়। আপনি বা অমুক অমুক যারা এসব সীমিত আকারে করছেন, তাতে আমাদের সহযোগিতা আছে। আমরা নিয়মিত বৈঠকাদিই ঠিকমতো করতে পারিনা, এসব কিভাবে করবো?????!!!!!!!!!!!’’
যেসব সংগঠনবাদী জামায়াত নেতা-কর্মী পেশাগত দায়িত্বের বাহিরে পত্রিকা পড়া ছাড়া কম্পিউটার ব্যবহারকে সময়ের অপচয় মনে করেছেন তাঁরাই এখন ফেসবুকে একাউন্ট খুলছেন, ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাচ্ছেন। আই.টি. টি.সি. করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন। শাহবাগ শুরু হওয়ার আগে যার ফেসবুক ফেন্ড সংখ্যা ছিলো শ তিনেক মাস দেড়েকের মধ্যে তাঁর ফ্রেন্ড সংখ্যা বারো শত ছাড়িয়ে গেছে।
শাহবাগ আন্দোলন জামায়াত-শিবিরের লিনিয়্যান্ট ও অল্টারনেটিভি পটেনশিয়্যালিটিগুলোকে ট্রিগারিং করেছে, ইগনাইট করেছে। শাহবাগীরা হোহাইট হাউজে পিটিশান খোলার পরে জামায়াতের লোকজনও একটা পাল্টা পিটিশান খুলে। দেখা গেল, নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই জামায়াতীদের পিটিশানে স্বাক্ষর সংখ্যা ৯৭,০০০ এ পৌঁছে যখন শাহবাগীদের এ সংখ্যা ছিলো মাত্র ৩৭,০০০ !!!
শাহবাগে কে কী পেলঃ শাহবাগ আন্দোলনে তাঁদের নতুন কোন লোক, শক্তি বা ক্ষেত্র সৃষ্টি হয় নাই। দশকের পর দশক ধরে এ দেশে বিভিন্ন অলটারনেটিভ পেরিফেরীতে আশ্রয় নেয়া বামধারার সঞ্চিত সাংগঠনিক ও মিডিয়ানির্ভর সামাজিক শক্তি একটা পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে যা প্রাথমিকভাবে সফল হয়েছে। কিন্তু শাহবাগ আন্দোলনকে মোকাবিলা করতে গিয়ে জামায়াত যা পেয়েছে তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ও অভিনব। প্রযুক্তি ও গণমাধ্যমে তাঁদের সরব উপস্থিতির সাথে সাথে বিএনপি কে সরকারবিরোধী আন্দোলনে বেশ আগে ভাগে নামাতে সক্ষম হওয়া – জামায়াতের অন্যতম প্রাপ্তি। ১৯৭০ সাল ও ১৯৭১ সালের প্রথমাংশের পরে এবারই প্রথম ঢাকা-চট্টগ্রাম শহরের বাহিরে বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রামে-গঞ্জে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছে। দেশের যেসব জায়গায় এ পর্যন্ত ‘গন্ডগোল’ তেমন হয় নাই, আসলে সেসব জায়গায় ক্রাকডাউন করে নতুন করে কোন ফ্রন্ট খোলার ব্যাপারে সরকারের অনীহা ও ভীতির কারনেই সেসব অঞ্চল তুলনামূলকভাবে শান্ত ছিল বা আছে।
ইসলামী শক্তির ইন্টিগ্রেশানের ঐতিহাসিক সম্ভাবণা ও ঘটনাঃ সম্প্রতি সরকারপন্থী মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ কর্তৃক আয়োজিত ঢাকার মতিঝিল চত্বরের কথিত মহাবেশের মহাব্যর্থতার মাধ্যমে জামায়াত দেশের সকল ইসলামী শক্তিকে প্রত্যক্ষভাবে শাহবাগী-নাস্তিকদের বিরুদ্ধে ও পরোক্ষভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। জামায়াত যদি ভবিষ্যতে দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর মতো পাবলিক ফিগার তৈরী করতে পারে ও তাঁদেরকে জামায়াতের ‘সিল’ মেরে ‘নিরাপদ (নপুংসক!?) করার মতো হঠকারীতা না করে দেশের প্রতিষ্ঠিত ইসলামী শক্তিকেন্দ্রসমূহের মধ্যে কাজ করার ও সমন্বয় করার দিকে মনোনিবেশ করে, তাহলে তা দেশ ও জনগণের জন্য বিরাট কল্যাণ বয়ে আনবে।
জামায়াত রি-ব্র্যান্ডিং: শাহবাগ আন্দোলন জামায়াতকে পূণর্বিন্যস্ত হবার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। সরকার যদি জামায়াত নিষিদ্ধ করে তাহলে জামায়াতের লাভ সবচেয়ে বেশী। তাই, সরকার সেটি করবেনা, এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এক্ষেত্রে জামায়াতের উচিত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজেকে রিব্রান্ড করা। এক্ষেত্রে কামারুজ্জামান সাহেব জেল হতে যে প্রস্তাব দু বছর আগে পাঠিয়েছিলেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এই প্রস্তাবণা অনুসারে, জামায়াত থাকবে। এর পাশাপাশি জামায়াত আধুনিক শিক্ষিত ও পরিচ্ছন্ন ইমেজের লোকদেরকে দিয়ে একটা মধ্যবর্তী দল তৈরী করবে। যারা জামায়াতের কোন অপবাদ বহন করবেনা। এরা আগামী দিনে এ দেশে তরুণ প্রজন্মকে ইসলামের আওতায় ফিরিয়ে আনার কাজে নিয়োজিত হবে।
রি-ব্র্যান্ড তথা এডাপটেশানে জামায়াতের সমস্যাঃ পাকিস্তান-পূর্ব সময়ে প্রতিষ্ঠার দেড় দশকের মধ্যেই, ঐতিহাসিক মাছিগোট সম্মেলন পরবর্তী সময়ে বৈপ্লবিক আন্দোলন হিসাবে প্রত্যাশিত ও অপরিহার্য্ ন্যাচারাল এডাপট্যশানের সাংগঠনিক-সক্ষমতা হারিয়ে ফেলা বর্তমানের রেজিমেন্টেড জামায়াতের পক্ষে গত দু বছরেও বিকল্প কোন কিছু করা সম্ভব না হলেও শাহবাগ উত্তর পরিস্থিতিতে তা অনেকটাই সহজতর হয়েছে। কথা হলো, জামায়াত সে পথে এগুবে কিনা। জামায়াত এটি না করলেও শাহবাগ-সুনামি উত্তর জামায়াত পূর্ববৎ হবেনা – অন্ততঃ এতটুকু ধরে নেয়া যায়।
জামায়াতের ঐতিহাসিক অবদানঃ জামায়াতের সকল সীমাবদ্ধতা সত্বেও বাংলাদেশের ইতিহাসে জামায়াতের এই অবদানটুকু সবাই স্বীকার করবে যে, বাংলাদেশে অনৈসলামীকরণের মহাজোয়ারকে জামায়াত অনেকটুকুই রুখে দিতে পেরেছে। বাংলাদেশের জাতিসত্ত্বা গঠনে দুটি পরষ্পর বিপরীত অবস্থানে অবস্থানকারী শক্তিকেও জামায়াত হয়তোবা একত্রিত করতে সক্ষম হবে।
বিবাদমান পক্ষদ্বয় ও তাঁদের সাংঘর্ষিক(?) প্রস্তাবণাঃ একপক্ষে আছে কম্যুনিষ্ট ভাবধারার লোকজন যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এদেশ হতে ইসলামকে রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে উচ্ছেদ করতে চেয়েছে। অন্যপক্ষে আছে, ইসলামী শক্তিকেন্দ্রসমূহ, যারা এ দেশকে, এ দেশের মূল পরিচয়কে, সোজা কথায় আমাদের বাংগালীত্বকে ইসলামের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে অবাস্তব ও কৃত্রিম এক ‘ইসলামী’ জাতিসত্ত্বা নির্মাণের ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। ব্যাপারটা নিছক সমঝোতার নয়, এটি ইসলাম-কে বোঝারও একটা সিরিয়াস বিষয়। আমরা মুসলমান তাতে আমাদের বাঙগালী হতে বাধা কোথায়? আমরা প্রধান খাবার হিসাবে রুটি খাই না, খেজুর খাই না, নুডুলস খাই না; ভাত খাই। তাতে মুসলমানিত্বের দিক হতে সমস্যা কী?
বাংগালীত্ব কি মুসলমানিত্বের সাথে সাংঘর্ষিক? জামায়াতের নেতা হিসাবে পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পর্যায়ের জনৈক কর্মী পহেলা বৈশাখের অনু্ষ্ঠানে যাওয়ায় তাঁর সহকর্মী জামায়াত-দায়িত্বশীল ও লোকজনেরা তাঁর নিন্দা করেছে, আজে বাজ মন্তব্য করেছে। অথচ, মেলা হচ্ছে বাংগালীর সংস্কৃতি। চট্টগ্রামের লোক হিসাবে আমি দেখেছি, মেলা শুধু লালদীঘি আর মাইজভান্ডারেই হয়, তা নয়। চুনতির সিরাত মাহফিলে মেলা বসে যাতে বোরকা পড়া মেয়েরাও দলে দলে অংশগ্রহন করে। হাটহাজারী-পটিয়া-চারিয়া-বাবুনগর-আহমদিয়াসুন্নিয়াহ মাদ্রাসাসহ সব মাদ্রাসার বার্ষিক সভার দিনে মেলা বসে। মেলাতে কি কি আইটেম থাকবে, তা ভিন্ন বিষয়। অথচ, ইসলামপন্থীরা বলেছে, মুসলমানদের দু ঈদ ছাড়া কোন জাতীয় উৎসব নাই!!!!!!??????? তাহলে আমরা কি ভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস পালন করবো না? সকল ধরনের খারাপ কাজ কি দু ঈদের দিনেই এ দেশে সবচেয়ে বেশী হয়, এটি কি সঠিক নয়?
শেষ কথাঃ
জামায়াত যে বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতাকে এতদিন পাত্তা দেয় নাই সেটি এখন হবে। শাহবাগ উত্তর পরিস্থিতিতে এসব প্রশ্ন আসবে। এসব প্রশ্নের মীমাংসা হবে। বাংগালিত্ব ও মুসলমানিত্বের সমন্বয়ে আমাদের জাতিসত্ত্বা-সংকটের সুরাহা এবার হবে, আশা করা যায়। দল হিসাবে জামায়াতের যাবতীয় ব্যর্থতার মধ্যে এটি তাঁদের অন্যতম আদর্শিক সফলতা হিসাবে বিবেচিত হবে। যদি হয়। আমি আশাবাদী!!!!!!!!!!!
বিষয়: বিবিধ
৩০৫৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন