মুসলমানরা এত রস-কষহীন কেন?
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক ০৪ অক্টোবর, ২০১৩, ১২:৩০:৩৩ দুপুর
সাংস্কৃতিক তৎপরতাও হতে পারে আল্লাহর শুকরিয়া প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। যখন আমি কাওয়ালি বা সেতার শুনি, কিম্বা ধরুন হাল নাগাদের কোন বিখ্যাত ইরানী সিনেমা দেখি অথবা কোন জনপ্রিয় চিত্রকর্ম দেখি অথবা কোন সংবেদনশীল সাহিত্য অধ্যয়ন করি, তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মহান আল্লাহর প্রশংসায় আমি বিগলিত হই!
আমরা যেখানে থাকি তার আশেপাশে বিগত প্রায় পঁচিশ বছর হতে আমার স্ত্রী স্বেচ্ছা সমাজ-কর্মী হিসাবে কাজ করে আসছেন। তাঁদের একটা ছোট্ট স্কুল আছে যেখানে শারীরিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষায়িত শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। রমজানের শুরুকে উদযাপনের জন্য প্রতি বছর সেখানে উৎসব আয়োজন করা হয়। প্রতি বৎসরই অংশগ্রহনকারীদের পক্ষ হতে এই অনুষ্ঠানে একটা সাধারণ প্রশ্ন করা হয়। তা হলো, মুসলমানের এতটা নিরস কেন? এই রমজান উৎসবে থাকে কোরআনের বিভিন্ন ধরনের ছাপা কপি, বিভিন্ন ডিজাইনের জায়নামাজ এবং হরেক রকমের পোষ্টারের প্রদর্শণী। সেখানে কোরআনের মৃদু তেলাওয়াতও থাকে।
এর পাশাপাশি হিন্দু কম্যুনিটির ‘দেওয়ালি’ উৎসবকে যদি আমরা তুলনা করি তাহলে দেখা যাবে সেটি আঙ্গিক ও উপস্থাপনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। এর ইমপ্যাক্টও অনেক বেশী। তাঁদের এই অনুষ্ঠানে রংয়ের ব্যাপক ব্যবহার ও পোষাকের বিপুল বৈচিত্র্য লক্ষ্যণীয়। এরসাথে আছে নাচ ও বাদ্য-বাজনা। চীনাদের নববর্ষ অনুষ্ঠান ‘ডিট্টো’ ও অনুরূপ সমারোহে পালিত হয়। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা এসবে খুব মজা পায় এবং সারা বছর এর জন্য অপেক্ষা করে। বলাবাহুল্য, রমজান উৎসবের জন্য তাঁরা ততটা উদগ্রীব থাকে না।
আমি বাচ্চাদের সাথে তাঁদের অনুভূতি শেয়ার করি। আমার মনে হয়, আনন্দ প্রকাশের ক্ষেত্রে আমরা ততটা উদার নই। ইসলামকে আমরা কিছু ধর্মাচরণ (rituals) এর মধ্যে গন্ডীবদ্ধ করে ফেলেছি যেগুলো আমরা নিতান্ত যান্ত্রিকভাবে পালন করে থাকি। এমনও দেখা যায়, অতিরিক্ত কিছু নফল ইবাদতের মাধ্যমে কোন কিছুকে ‘সেলিব্রেট’ করার কথা বলা হয়। এমন একটা ডমিন্যান্ট গ্রুপ মুসলমানদের মধ্যে আছে যারা আনন্দ-উৎসব মাত্রকে আদতেই খারাপ ও যথাসম্ভব পরিত্যাজ্য মনে করে!
পরগাছার মতো এমন ‘ইসলামী সরকার/কর্তৃপক্ষ’ও মুসলমানদের মধ্যে দেখা গিয়েছে, আছে যারা ইসলাম তথা ইসলামী শরিয়াহকে মানুষের কাছে বাস্তব জীবনে অসাধ্য হিসাবে প্রতিপন্ন করেছে। এরা গান গাওয়াকে না জায়েয হিসাবে ঘোষণা করে, সিনেমা হলগুলোকে ধ্বংসের পক্ষপাতী। এসব অতি-ধার্মিক ইসলামী কর্তৃপক্ষ যে কোন নৃত্য ও নাট্য মঞ্চকে বন্ধ করার হুকুম/দাবী করে। তাঁদের ইসলাম-চেতনায় ‘ধর্ম-ইসলাম’ ব্যতীত কলা ও মানববিদ্যা সংশ্লিষ্ট সবকিছু আদতে অনৈসলামিক, অতএব না-জায়েয। যার কারনে, জগতের বাদবাকী লোকেরা কখনো এমন ভুল ধারনাও পোষণা করে যে, মুসলমানদের মানবিক-চেতনায় বিশেষ কোন ঘাটতি আছে।
কোন সমাজই এর সর্বজনীনতা নিয়ে টিকে থাকতে পারে না যদি তা সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বলয়ের সুরক্ষায় না থাকে। ইবাদাত হিসাবে যতো ধর্মাচরণ আছে তা আমাদেরকে ধার্মিক ও সত্যানুসন্ধানী হিসাবে গড়ে তোলে। এটি যতটা সত্য, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমেই আমাদের মনুষ্যত্বের পূর্ণতা ঘটে, এটিও ততটা সত্য। তাই, আমাদের শুদ্ধি, সততা ও উন্নতির জন্য কেবলমাত্র প্রার্থনা বা ইবাদাতই যথেষ্ট দাবী করা হলো নিজেদের মনুষ্যত্বকেই অস্বীকার করার নামান্তর।
সংস্কৃতি বিশেষ করে বিনোদন সংস্কৃতির উপভোগের ব্যাপারটা আমাদের মানবিক গড়নের মধ্যে নিহিত। এটি এমন একটা আকাঙ্খা যা আমাদের পরিশীলিত কিম্বা সুপ্ত আবেগ অনুভূতিগুলোর প্রকাশে আমাদেরকে বাধ্য করে। বিনোদন হলো মানবিকতার অপরিহার্য্য বহিঃপ্রকাশ। এতে আমরা নিজেদের সম্পর্কে ভাবিত হই। নিজেদেরকে প্রকাশ করি। আমাদের অপ্রাপ্তি ও অযোগ্যতাগুলোকে আবেগের ডালায় প্রকাশের মাধ্যমে প্রীত হই। বিনোদন সংস্কৃতির মাধ্যমে নিরাপদ সামাজিক সম্পর্কে থেকে আমরা নিজেদেরকে প্রকাশ করে তৃপ্ত হই।
মিউজিক হারাম হওয়ার দাবী কোনক্রমেই গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। এটি কিভাবে হতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এমন একটা জিনিসকে বাদ দিয়ে চলতে বলছেন, যা তিনি বিশ্ব-জগত তৈরীতে অন্যতম অপরিহার্য্য সদর্থক উপাদান হিসাবে ব্যবহার করেছেন? আল্লাহ কি আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অন্যতম একটির আবেদনকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলতে বলছেন? যা কিছু আমাদেরকে রক্ত-মাংসের মানুষ বানিয়েছে, শ্রবণশক্তি এর এক পঞ্চমাংশ নয় কি? গান-বাজনাকে হারাম সাব্যস্তকারীরা মুসলমানদের সমৃদ্ধ ইতিহাসের বিরাট অংশকে অস্বীকার করার চেষ্টা করছেন। গিটারের মতো অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাদ্যযন্ত্র কি মুসলিম স্পেনে আবিষ্কৃত হয়নি? আমরা জানি, সূফী ধারা ইসলাম প্রচারের অন্যতম শক্তিশালী ধারা হিসাবে কাজ করেছে যেখানে আত্মিক উন্নতির সহায়ক মাধ্যম হিসাবে সঙ্গীত সংশ্লিষ্ট সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
স্থিরচিত্র ও চিত্রকলার পুরো ক্যাটাগরিকেই হারাম হিসাবে দাবী করাও একই রকমের এবজার্ড বিষয়। প্রতিকৃতি মাত্রকেই যদি হারাম বলা হয় তাহলে সিনেমা, টেলিভিশন, পেইন্টিং, ভাষ্কর্য এবং প্রতিকৃতি নির্ভর যে কোন কিছুই মুসলিম সমাজে পরিত্যাজ্য হওয়ার কথা। ইসলাম মূর্তি পূঁজার মূলোৎপাটনের দাবী করে। এটি সত্য। কিন্তু এর ভিত্তিতে কেউ যদি বলে যে, প্রতিকৃতি মাত্রই পূঁজার উপাদান এবং সে হিসাবে পরিত্যাজ্য, তাহলে তা কোনমতেই গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। কেউ যদি প্রতিকৃতি মুক্ত কোন তথাকথিত ইসলামী জগতে বাস করতে চান তাহলে তাকে বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থাকে পরিত্যাগ করতে হবে। কারন, প্রতিকৃতির বিভিন্ন ফর্মকে ভিত্তি করে বর্তমান শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠেছে।
সংস্কৃতিই শক্তি। আমাদের বুঝতে হবে যে, সমকালীন বিশ্বে এক অর্থে, সাংস্কৃতিক সামর্থ্যই হচ্ছে বিজয়ী হওয়ার মতো প্রকৃতি সক্ষমতা। বলিউডের বিশ্বব্যাপী প্রভাবের বিষয় বিবেচনা করুন। দেখুন, হলিউড কিভাবে সারা বিশ্বে আমেরিকান সাংস্কৃতিক প্রাধান্যকে চাপিয়ে দিয়েছে। হংকং ভিত্তিক একশান ফিল্মগুলো এবং জাপানি-চাইনীজ আর্ট ফিল্মগুলো কিভাবে হলিউডে প্রাধান্য বিস্তার করছে, সেটিকেও বিবেচনা। সিরিয়াস মুডের জনপ্রিয় পাশ্চাত্য কল্পকাহিনীগুলো কিভাবে বিশ্বব্যাপী পঠিত হয়, প্রভাব বিস্তার করে, তা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। চিন্তা করুন, আর্টের বৈচিত্রপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে কিভাবে বিভিন্ন সমাজিক অংগতিকে তুলে ধরা হয়। খেয়াল করে দেখুন, মিউজিক এবং নৃত্য কিভাবে সর্বত্র মানুষকে এক মেল-বন্ধনের মধ্যে নিয়ে আসছে।
সংস্কৃতি হতে পারে প্রতিরোধের অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম। ম্যাকডোনাল্ডস এবং কোকাকোলা সংস্কৃতির মতো চাপিয়ে দেয়া ডিজ্যুস সংস্কৃতিকে ঠেকানোর একমাত্র পন্থা হলো নিজেদের শক্তিশালী সাংস্কৃতিক প্রডাক্ট বের করা। আপনি যদি মোটাদাগে আর্টের সব ফর্মকে, সিনেমার সব ধরনকে, নৃত্য ও নাট্যের সব প্রকরণকে বাদ দিয়ে ‘নিজস্ব ইসলামী সংস্কৃতি’ গড়ে তুলতে চান, তাহলে, নিশ্চিতভাবে আপনি ব্যর্থ হবেন। নিজেকে ‘নিরাপরাধ ভিকটিম’ হিসাবে উপস্থাপনের স্বআরোপিত অক্ষমতার অজুহাত ফেরী করা হতে বাঁচতে হলে দোষারোপের নেতিবাচক ধারা হতে বের হয়ে ব্যাপকভাবে কর্ম-তৎপর হতে হবে।
সত্যি কথা হলো, শুরুতে যা বলেছি, সাংস্কৃতিক তৎপরতাও হতে পারে আল্লাহর শুকরিয়া প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। আল্লাহ তায়ালা তাঁর অসীম করুণায় আমাদেরকে আত্ম-সন্তুষ্টির এতো বেশী উপায় উপাদান দিয়েছেন যে, এগুলো সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে ঋদ্ধ করে তুলতে পারি। আল্লাহ তায়ালার বিরাটত্ব ও মহত্বকে বুঝবার জন্য তিনি বহুবিধ উপায়-উপকরণের ব্যবস্থা করেছেন। এসব কিছুকে ব্যবহার করে আমরা তাঁর মহান সত্ত্বাকে অনুধাবন ও প্রকাশ করতে পারি। এই দৃষ্টিতে, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডকে অবদমন করা হলো স্রষ্টার প্রতি এক ধরনের নাফরমানী। এজন্যই দেখবেন, সংস্কৃতি-বিমুখ মুসলমানেরা নিতান্তই সংকীর্ণ ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। পারলৌকিক ধর্মানুভূতি ব্যাতীত তাঁদের আর কোন অবলম্বন ও আবেদন থাকে না। যার ফলে, প্রায়ই অন্যদের কাছে আমরা মুসলিমরা বিরক্তিকর (boring) হিসাবে বিবেচিত হই। নির্দোষ মানবিক প্রবণতাসমূহের অনেকখানি বাদ দিয়ে অবদমন চর্চাকেই আমরা পবিত্র দায়িত্ব মনে করি। এটি এক অর্থে স্রষ্টার প্রতি একধরনের অকৃতজ্ঞতা বৈকি ...!
সূত্রঃ “Why are Muslims So Boring?”, Ziauddin Sardar, emel, issue ৮, Nov/Dec 2004 ['এমেল' হলো প্রথিতযশা মুসলিম নেত্রী সারা জোসেফ কর্তৃক লন্ডনভিত্তিক লাইফ স্টাইল ম্যাগাজিন] http://www.emel.com/article?id=9&a_id=1830
বিষয়: বিবিধ
২১২৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন