পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ ইসলামে গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা কী
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক ০৫ মে, ২০১৩, ০১:২৪:৪৯ রাত
গণতন্ত্র সম্পর্কে ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে ইতোপূর্বে যে আলোচনা করেছি, ফেসবুকের পরিসরে তা বিস্তারিত হলেও বিষয়বস্তুর নিরিখে সেগুলো সংক্ষিপ্তসার এর বেশী নয়। লক্ষ্য করেছি, অতি সংক্ষিপ্ত হলেও কনক্লুসিভ বক্তব্য দেয়ার পরেও কিছু পাঠক প্রশ্ন করে বসেন, ‘‘... আপনার বক্তব্যের মূল কথা কী?’’ অথবা, ‘‘গণতন্ত্র তো একটা কুফরী মতবাদ। আপনি এটি মানছেন না কেন?”
গণতন্ত্র বিরোধী চিন্তাগোষ্ঠী এক এক সময়ে এক এক কথা বলে। সম্প্রতি ‘ইসলামে গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা কী’ শিরোনামের একটা ব্লগ পোষ্ট হতে তাঁদের বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ যে তাত্ত্বিক দাবীগুলো পেয়েছি তা হলোঃ
১. ‘যদি তুমি অধিকাংশের মত অনুসরণ করো তবে তাঁরা তোমাকে আল্লাহর পথ হতে বিচ্যূত করে দিবে’ - সুরা আনআমের ১১৬ নং আয়াতের মাধ্যমে গণতন্ত্রক নাকচ করে দেয়া হয়েছে
২. ‘কর্তৃত্বতো কেবল আলাহরই’ ধরনের বহু সংখ্যক কোরআনিক আয়াতের মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌমত্বকে ইসলামে বাতিল করে দেয়া হয়েছে।
৩. গণতন্ত্রে প্রতিটি রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় নিজস্ব সংবিধান তৈরা করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ইসলামে আল্লাহর বিধান পরিবর্তন করাটা একেবারেই হারাম।
৪. গণতন্ত্র হলো জুয়া। কেননা, এটি অনিশ্চিত ব্যবস্থা এবং কে জয়ী হবে এবং কে পরাজিত হবে তা কেউ জানেনা। এটি ভাগ্যের ব্যাপার। তাই গণতন্ত্র হলো ভাগ্য পরীক্ষার মতোই। জুয়া কিম্বা ভাগ্য পরীক্ষা ইসলামে হারাম।
প্রথম পয়েন্টের উত্তরঃ
কোরআন-হাদীসের কোন বাহ্যিক বর্ণনার সাথে সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সঃ) ও সাহাবীদের আমল যদি সাংঘর্ষিক হয় তখন সংশ্লিষ্ট রেফারেন্সকে শানে নুযুল ও সুন্নাহ’র আলোকে ব্যাখা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ওয়াহী প্রচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি নবী করিম (সঃ) ও তাঁর অনুসরণকারীদের আচরিত কর্মপন্থাই কোরআন হাদীসের কোন রেফারেন্স এর সঠিক তাৎপর্য।
এটি সত্যি যে, কোরআনের যত জায়গায় অধিকাংশ শব্দটি এসেছে তত জায়গায় তা নেতিবাচক অর্থেই এসেছে। এর ফলশ্রুতিতে, বিশেষ করে সুরা আনআমের ১১৬ নং আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামে অধিকাংশ মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহনের কোন বিষয় থাকার কথা নয়। অথচ, আমরা দেখি, রাসূল মুহাম্মদ (সঃ) বিভিন্ন যুদ্ধ পরিস্থিতিসহ বহু বিষয়ে অধিকাংশ মতকেই গ্রহন করেছেন।
অধিকাংশ মতকে গ্রহন করার সুন্নাহ উদাহরণসমূহকে গণতন্ত্র বিরোধীরা কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
উল্লেখ্য যে, রাসূল মুহাম্মদ (সঃ) শুধুমাত্র রাষ্ট্র নায়কই ছিলেন না, তিনি মূলতঃ ছিলেন রাসুল। তাই ঈমান-আক্বীদা ও ফৌজদারী দন্ডবিধির ক্ষেত্রে তাঁর পক্ষে তৎকালীন অনৈসলামী অধিকাংশ মতকে গ্রহন করা আদৌ সম্ভব ছিল না।
দ্বিতীয় পয়েন্টের উত্তরঃ
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের সার্বভৌমত্ব বলতে বুঝানো হয় না যে, জণগণ নিজেদেরকে নিজেরা সৃষ্টি করেছে বা তাঁরা বিশ্ব-প্রকৃতির সৃষ্টিকর্তা। তাঁরা প্রাকৃতিক আইনকে ‘তৈরী’ করার দাবীও করেনা। গণতন্ত্রের অনৈসলামী অনুসরণকারীরা মনে করে যে, প্রাপ্ত এই বিশ্বে (ইন দিজ ‘গিভেন ওয়ার্ল্ড’) প্রাকৃতিক আইনকে অনুসরণ ও অনুকরণ করে আইন রচনা ও প্রয়োগের কর্তৃত্ব প্রদানের অথরিটি মানুষকে প্রদানের গত্যন্তর নাই।
সেক্যুলার বা এথিস্ট গণতন্ত্রের স্বয়ং-বিশ্বের স্থানে আল্লাহ’র মহান সত্ত্বাকে এবং প্রাকৃতিক আইনের সংকলন হিসাবে প্রত্যাদেশকে গ্রহন করে নেয়ার পরে আল্লাহর আইনকে ব্যাখ্যা ও এর প্রায়েগিকতার মাত্রা, পর্যায় ও ধারাক্রম নির্ধারণ করার ব্যাপারটি মানুষের হাতেই চলে আসে। ঐশ্বরিক আইনের এই মানবিক যাচাইযোগ্যতা নিরূপণে যে সব বিষয়কে স্কলারলি নির্ধারন করা দুরূহ সেসব বিষয়ে সামষ্টিক মতকে গ্রহন করাই শ্রেয়তর বিকল্প নয় কি?
আল্লাহর সার্বভৌমত্বের নিরিখে কোন সত্ত্বারই কোন প্রকারের স্বয়ং বা স্বতন্ত্র স্বাধীনতা নাই। এমতাবস্থায়, সর্বশক্তিমান তথা পরম সার্বভৌমের প্রতিনিধি হিসাবে এই অপরিবর্তনীয় বিধিমালার প্রয়োগ বিধি ও ধারাক্রম কী হবে তা নির্ধারণ করার অথরিটি কে? ঐশ্বরিক সার্বভৌমত্ব এর সামাজিক প্রয়োগ কর্তৃত্ব তো মানুষেরই হাতে যাদের সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে রাসূল ও নবী এবং সর্বনিম্ন স্তরে সাধারণ নাগরিকবৃন্দ। এটিই হলো পাশ্চাত্য পপুলার সভরেইনটি বা জনগণের সার্বভৌমত্বের ট্রু সেন্স।
সাধারণ মানুষের অবস্থা বা সামাজিক গ্রহনযোগ্যতার কোন প্রয়োজন বা প্রসঙগ যদি না থাকতো তাহলে আল্লাহর আইন নাযিলে ধারাবাহিকতা কেন? আল্লাহর আইন তথা শরীয়াহ’র ইম্প্লিম্যান্টারি প্লুরালিটিকে একোমোডেইট করার জন্য ব্যাখ্যা ও বিবেচনার সহযোগিতা নেয়া অত্যাবশ্যক। ব্যাখাসাপেক্ষ কোনকিছুর বিশেষ কোন ব্যাখ্যা গ্রহন বা কোনকিছুর বাস্তব প্রয়োগ নির্ধারণ কিম্বা কোন বিধির প্রয়োগ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত দেয়ার জন্য নবী-রাসূলের অনুপস্থিতিতে মতামতভিত্তিক বিবেচনার কোন বিকল্প নাই। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণের মধ্যে কিম্বা সাধারণ মতামতের ভিত্তিতে – যেভাবেই করণীয় নির্ধারণ করা হোক না কেন, অধিকাংশ মতকেইতো শেষ পর্যন্ত গ্রহন করতে হয়। তাই না?
তৃতীয় পয়েন্টের উত্তরঃ
দ্বিতীয় পয়েন্টের উত্তরে এর মূলকথাগুলো এসে গেছে। সংবিধানের কিছু মৌল কাঠামো থাকে। ইসলামে তা অপরিবর্তীয়। সেক্যুালার আবহে তা হলো প্রাকৃতিক আইন নামক অনির্দিষ্ট কিন্তু অলংঘ্যনীয় একটা ব্যাপার (নোশন)। ইসলামে এটি হলো ওয়াহী বা প্রত্যাদেশ। এই বিষয়ে অতিসতর্কতা অবলম্বনের পক্ষপাতী, অতি সংশোধনবাদীতার ধারক ও ‘অনৈসলামী’ সন্দেহবাতিক গ্রস্তদের মনোজগতে আছে এক বহিরাগত ও বিশেষ আদর্শ তথা বিধি-মালা হিসাবে বহুত্বের বাহুল্য(?) বিবর্জিত এক ইসলাম-আদর্শ ও শরীয়াহ’র ধারনা যা তাঁরা ডগম্যাটিকেলি আরোপ অর্থে কায়েমের নিরন্তর স্বপ্ন দ্যাখেন।
কেউ যদি ওয়াহীর রেফারেন্স বাদ দিয়ে সর্বোত্তম ও প্রাকৃতিক সামাজিক বিধিমালার সন্ধান করেন তাহলে তিনি ‘হাই ইবনে ইয়াকজানে’র গল্পের মতো ওয়াহীর নির্দেশণাতেই পৌঁছবেন।
হাই ইবনে ইয়াকজানের গল্পটি নিম্নরূপঃ পাশাপাশি দুই দ্বীপে দু’ জন ব্যক্তি দু পথে সত্য সন্ধানে ব্রতী হলেন। একজন প্রকৃতিকে অধ্যয়ন করে জ্ঞান অর্জন করেছেন। পার্শ্বের দ্বীপের অপরজন ঐশ্বরিক বা দৈব জ্ঞান অর্জন করেছেন। পরবর্তীতে তাঁরা যখন পরষ্পর মিলিত হলেন এবং প্রাপ্ত জ্ঞান বিনিময় করলেন, তখন তাঁরা দেখলেন, দুটি ভিন্ন দ্বার দিয়ে তাঁরা একই গৃহে প্রবেশ করেছেন!!!
চতুর্থ পয়েন্টের উত্তরঃ
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনিশ্চয়তাকে জুয়ার সাথে তুলনা করে জুয়া সম্পর্কীয় শরীয়াহ বিধিকে এর উপর প্রয়োগ করার এই হাস্যকর প্রচেষ্টা হলো প্রচলিত ডিডাকটিভ ও রেফারেন্সিয়্যাল ইসলাম শিক্ষা ব্যবস্থার চরম একদেশদর্শীতার অন্যতম উদাহরণ। হাতে আগ্নেয়াস্ত্র আছে কিন্তু সে জানে না যে কাকে কখন কিভাবে গুলি করতে হবে এমন সৈনিকের যে দশা বিদ্যমান নন-কনসেচ্টুয়্যাল ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা উতরে আসা ‘পন্ডিত’দেরও সে একই হাল। তাঁরা প্রায়শঃই কোরআন হাদীসের বিভিন্ন উদ্ধৃতিকে প্রেক্ষিত ও ধারাবাহিকতা বিচ্ছিন্ন করে, ক্ষেত্রবিশেষে কিম্ভূতকিমাকার সংযোজন ঘটিয়ে এক ধরনের দ্বীন ইসলাম চর্চা করেন! প্রায় ক্ষেত্রেই তাঁরা না বুঝে এবং সরল মনে, সাওয়াবের নিয়তেই এমন জগাখিচুরী করেন।
যাহোক, কোরআনের আয়াত দ্ব্যর্থহীন হলেই, হাদীস সহীহ হলেই তা ফরয কিম্বা ওয়াজিব হবে এমন কোন কথা নাই। যদি তা-ই হয়, অবশ্যই ব্যাপারটা তা-ই, তাহলে কোনটা ফরয, কখন ফরয, কিভাবে সে ফরযিয়াত আদায় করতে হবে তা সুন্নাহ’র টাইম-লাইন বা লাইন অব কন্সিসটেন্সী হতেই বুঝে নিতে হবে। এক্ষেত্রে রেফারেন্স বা নস-এর শুদ্ধতা, শানে নুযুল, ধারাক্রম ও সার্বিকতা বা সামগ্রিকতাকে বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে।
গণতন্ত্র বিরোধীরা ইসলামকে যুক্তি ও বুদ্ধির সাথে ক্ষেত্রবিশেষে সাংঘর্ষিক হিসাবে দেখাতে চান যা ঠিক নয়। ইসলাম সব বিষয়ে ব্যক্তির স্বাধীন যুক্তি ও বুদ্ধি চর্চাকে বিশেষ গুরুত্ব দ্যায়। বুদ্ধিমান ব্যক্তি যেমন স্বীয় যু্ক্তি ও বুদ্ধির দাবী পূরণ করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞ-মতকে নির্দ্বিধায় গ্রহন করে তেমনি ‘প্রাকৃতিক’ আইনকে বুঝা ও অনুসরণ করার জন্য ইসলাম অনুসরণকারীরা প্রকৃতি-স্রষ্টার প্রতিনিধিকে (নবী/রাসূল) আইডেন্টিফাই করে তাঁর গাইডেন্সের আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। ইসলামে স্থিরীকৃত বিষয়ের তুলনায় বিবেচনাযোগ্য বিষয়ের ব্যাপ্তি এত বেশী যে, মানবীয় স্বাধীনতা চর্চার জন্য প্রাকটিক্যালি সেটি যথেষ্ট। এই অতীব সত্য কথাটা খুব কমই বলা হয়!!!!
গণতন্ত্রের সাথে ইসলামের যেসব বেমিলের প্রসংগ আনা হয়, ইসলাম প্রসংগ বাদ দিয়ে শুধু গণতন্ত্রকে বিশ্লেষণ করলে সেসব বিষয়ে গণতন্ত্রের ভিতরেই চরম অনিশ্চয়তা (ইনডিটারমিনেসি) ও ব্যাপক মতদ্বৈততা দেখা যায়। জনগণ, সার্বভৌমত্ব, অধিকাংশ মত, সমতা, ন্যায় ইত্যাদি টার্মগুলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি। অথচ, গণতন্ত্রের বিভিন্ন প্রবক্তা ও অনুসারী জনগোষ্ঠী বিভিন্নভাবে সেগুলোকে ব্যাখ্যা করেছেন ও তদনুসারে প্রস্তাবণা দিয়েছেন। ইসলামী জীবন দৃষ্টি ও আদর্শবাদের সাথে গণতন্ত্রের কোন ফর্মেরই কোন মিল, ঐক্য বা সাযুজ্যতা হতে পারে না – এই দাবীটি নিতান্তই বাড়াবাড়ি। হতে পারে, এটি ‘গণতন্ত্রই ইসলাম কায়েমের সর্বশ্রেষ্ঠ বা একমাত্র পদ্ধতি’ ধরনের প্রচলিত জনপ্রিয় কিন্তু ভুল রাজনৈতিক শ্লোগানের প্রতিক্রিয়া।
বিষয়: বিবিধ
১৮৪৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন