ভাবাদর্শগত বিজয় সত্বেও দলীয়ভাবে জামায়াতের পরাজয়ের শংকাঃ উত্তরণের উপায়

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক ০৮ এপ্রিল, ২০১৩, ১০:৫৯:৪৯ রাত

গত ৬ এপ্রিল ২০১৩ তারিখের লং মার্চ অত্যন্ত সফলভাবে উদযাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বেসরকারী মাদ্রাসসমূহের সংগঠন ‘হেফাজতে ইসলামী’র গ্লোরিয়াস অভিষেক সম্পন্ন হয়েছে। তাঁদের এই প্রবল অরাজনৈতিক রাজনৈতিকতা এ দেশের প্রকাশ্য ও অসচেতন – এই দুই শ্রেণীর ইসলামবিরোধীদের মধ্যে ব্যাপক টেনশন সৃষ্টি করেছে। এক্ষেত্রে আমি বামপন্থী কম্যুনিষ্ট ভাবাপন্নদেরকে প্রকাশ্য ইসলামবিরোধী এবং ইসলামের রাজনৈতিক প্রায়োগিকতার বিরোধীদেরকে অসচেতন ইসলাম বিরোধী হিসাবে গণ্য করছি।

ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা উচিত নয়’ বলে যারা মনে করেন তাঁরা ধর্ম বলতে কি বুঝেন, ধর্ম কী কাজ এর জন্য তা ঠিক করুন। অতঃপর রাজনীতি বলতে কি বুঝেন, রাজনীতি’র কাজ বা দাবী কোন্ কোন্ বিষয়ে – তাও ঠিক করুন। এরপর ‘ইসলাম’ এর আদর্শগত অথরিটি তথা কোরআন ও হাদীসের আলোকে, সুন্নাহ’র মাপকাঠিতে যাচাই করে দেখুন, রাজনীতি’র কোন কমন এজেন্ডা ইসলামে আছে কিনা। দেখবেন, রাজনীতির সব কমন ইস্যু বা এজেন্ডাগুলো ইসলামের মৌলিক কাঠামোর মধ্যে প্রোথিত। এ দৃষ্টিতে, যারা ইসলামের রাজনৈতিকতাকে অস্বীকার করেন বা এর প্রয়োগযোগ্যতার বিষয়ে মোটাদাগে সন্দেহ পোষণ করেন, তাঁরা ইসলাম-কে ভালভাবে জানতে বা বুঝতে পারেন নি – এ ছাড়া আর কি বলা যায়?

ইসলামের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিধানবলীর প্রয়োগযোগ্যতার ক্ষেত্রে মাত্রা ও ক্রমধারা বিবেচনার বিষয়টি অবশ্য ভিন্ন প্রসংগ।

দেওবন্ধপন্থীদের অরাজনৈতিক রাজনৈতিকতার পথ যাত্রা - তাই, হেফাজতে ইসলাম নেতৃবৃন্দ যতই নিজেদেরকে অরাজনৈতিক হিসাবে দাবী করুন না কেন, ইসলামের নামে যারাই ময়দানে নামবেন, তাঁরাই অপরিহার্য্যভাবে নিজেদেরকে রাজনীতিতে জড়াবেন। হতে পারে তাঁরা একপর্যায়ে নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনীতিতে নামবেন অথবা অপ্রকাশ্যভাবে কোন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তিকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে যাবেন।

সায়্যিদ আহমেদ ব্রেলভী’র নেতৃত্বাধীন বালাকোট যুদ্ধে পরাজয়ের ও সিপাহী বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পর তৎকালীন বৃটিশ ভারতে মুসলমানদের ঈমান ও ইসলাম রক্ষার জন্য দেওবন্ধ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়, হাটহাজারী মাদ্রাসাসহ সব ক্বওমী মাদ্রাসা এই ধারাবাহিকতারই অংশ। পাকিস্তান মুভমেন্ট-এ দেওবন্ধ মাদ্রাসা কেন্দ্রিক ইসলামী শক্তির মূল অংশ ভারতীয় কংগ্রেসকে সমর্থন করে প্রাকারান্তরে পরাজিত হয়। অতঃপর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক-নিদ্রাকালীন সময়ে তাঁরা স্বাধীন ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সামাজিকভাবে শক্তি সঞ্চয় করে এক পর্যায়ে মাঠে নেমেছেন। যে ১৩ দফা দাবী তাঁরা দিয়েছেন তা ইসলামী রাজনীতির একটি চিত্র বৈ নয়।

জামায়াত শুরু থেকেই এসবকে রাজনৈতিক বিচেনায় এজেন্ডা হিসাবে দাবী করে আসছে। যেভাবেই হোক না কেন দৃশ্যতঃ জামায়াত বিরোধী ধর্মীয় পক্ষসমূহ অবশেষে অঘোষিতভাবে জামায়াতের (রাজনৈতিক) এজেন্ডাসমূহকে আপহোল্ড করছে। নিঃসন্দেহে এটি জামায়াতের মতাদর্শগত বিরাট বিজয়। কথা হলো জামায়াত এই বিরাট প্রাপ্তিকে আত্মস্থ করতে পারবে কি-না।

জামায়াত কি আদৌ বিপ্লব চায়? জামায়াত যদি আদৌ বিপ্লবে বিশ্বাস করতো বা (ইসলামী) বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত থাকতো, তাহলে ২০১৩ সালের মতো পরিস্থিতিতে তাঁরা সেটি করতে পারতো।

বিপ্লব আগাম-জানান দিয়ে আসে না, ঘোষণা দিয়ে হয় না; সাইক্লোন বা টর্ণেডোর মতো হঠাৎ করেই কোন দৃশ্যতঃ তুচ্ছ কারনে কোনে এক বা একাধিক ক্ষমতা-কেন্দ্র পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। হতে পারে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তি যাকে আমরা আম-জনতা বলি, চরমভাবে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে, জেগে উঠে বিদ্যমান কাঠামোকে ভেঙ্গে তছনছ করে দ্যায়।

নিছক সামাজিক অরাজকতা ও বিশৃংখল পরিস্থিতিতে অরাজকতা-উত্তর সময়ে পূর্ব সমাজকাঠামোকে দ্রুত মেরামত বা নির্মাণ করা যায় যা বিপ্লব-উত্তর পরিস্থিতিতে হয় না। বিপ্লবের জন্য ‘লোক তৈরী’র জামায়াতী ফর্মূলা তাত্ত্বিকভাবে সঠিক হলেও তাঁদের গৃহীত কর্মপন্থার সামগ্রিক মূল্যায়নে এই অন্তহীন ‘লোক তৈরী’র প্রক্রিয়া তাবলীগ জামায়াতের কর্মপন্থার মতোই ইউটোপিয়ান তথা অবাস্তব। এই প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রনির্ভর লক্ষ্যহীন ‘বিপ্লব-প্রস্তুতি’র পথচলা(জামায়াতের ভাষায় ‘কাজ করে যাওয়া’), মৌলিক সমাজ পরিবর্তন তথা বিপ্লবের সমাজবিজ্ঞানের নিরিখেও অবৈজ্ঞানিক এবং এর সুন্নাহ-উদাহরনের নিরিখেও প্রশ্নবিদ্ধ।

যোগ্য লোক তৈরীর তরীকা- তৈরী লোকদেরকে চাহিদা মোতাবেক ময়দান সংশ্লিষ্ট করতে না পারার কারনে ইসলামী ছাত্র শিবিরের যত ক্যডার বের হয়েছে তার অত্যন্ত ক্ষুদ্র অংশই জামায়াতে ইসলামীতে সক্রিয় থেকেছে, নেতৃত্বে এসেছে। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ তৈরী নেতৃবৃন্দকে কাজে লাগানোর উপযোগি কাঠামো ও কর্মসূচী এডপ্ট করার পরিবর্তে জামায়াতের কম্পার্টমেন্টালাইজড লিডারশীপ এদেরকে তারুণ্যজনিত বুঝ-জ্ঞানের গলদ বা ঘাটতির কোটায় ফেলে আত্মতুষ্টিতে ভুগেছে।

হেফাজতে ইসলামী’র প্রবল আত্মপ্রকাশের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট গণ-জোয়ারকে কাজে লাগানোর সাথে সাথে নিজেদের ‘তৈরী লোকদেরকে’ ময়দানে সক্রিয়ভাবে ধরে রাখার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে নিম্নোক্ত বিষয় বা ক্ষেত্রসমূহে কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশের ইসলামপ্রিয় জনগোষ্ঠীর সোশ্যাল সাইকিতে একধরনের বিপ্লবের মাধ্যমে মতাদর্শগত বিজয় ও প্রতিষ্ঠা লাভের পরে বাংলাদেশের সামাজিক পূণর্গঠন ও টেকসই জাতি-রাষ্ট্র গঠনের পরবর্তী বিপ্লবে জামায়াত কতটুকু সফলতা লাভ করতে পারবে তা নির্ভর করছে এর সাংগঠনিক কাঠামো ও কর্মপন্থায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাঁরা কতটুকু বিপ্লব করতে পারবে, তার উপর।

জামায়াতের এই প্রত্যাশিত আভ্যন্তরীণ বিপ্লবের জন্য যা করণীয় –

নারী অধিকারঃ সম্প্রসারিত নাস্তিক্যবাদের পাশাপাশি গণ মানুষের ইসলাম-চেতনা ধারন করে জাতি গঠনে নেতৃত্ব দেয়ার স্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে জামায়াতে ইসলামীকে যা করতে হবে সে তালিকায় নারী অধিকারের বিষয়টিকে আমি সর্বাগ্রে স্থান দিতে চাই। সনাতনী ইসলাম চর্চায় যে রক্ষণশীল নারীনীতিকে ফলো করা হয় তা নিবর্তনমূলক ও সুন্নাহবিরোধী।

নারী জাগরণের এই যুগে প্রাচ্য অবদমন ও পাশ্চাত্য ভোগবাদীতার মধ্যবর্তী ইসলামী ধারা কায়েমের মাধ্যমে সমাজের সকল নারীকে আদর্শবাদের আওতায় স্বীকৃতি দেয়াটা ভীষণ জরুরী। কিছু সংখ্যক নারীকে আদর্শের ছাঁচে যথাসম্ভব খাঁটী করে গড়ে তোলার বর্তমান নীতির পরিবর্তে সাধারন নারীদের মধ্যে অধিক সংখ্যায় আদর্শগত তথা ঈমানী চেতনাকে ছড়িয়ে দেয়ার কর্মপন্থা গ্রহন করা যেতে পারে।

জামায়াতের নারীনীতিকে উদার করার জন্য সর্বাগ্রে মুখমন্ডলের অর্ধাংশ ঢেকে রাখার যে ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে তা তুলে দিতে হবে। পুরুষদের দাঁড়ি রাখা, পাজামা-পাঞ্জাবী ও টুপি পরার মত যারা চাইবে তাঁরা নেক্বাব পড়তে পারবেন। কিন্তু শপথের কর্মী হওয়ার অন্যতম শর্ত হিসাবে এটিকে প্রয়োগ করা যাবেনা।

মসজিদে নারীদের নামাজ আদায়সহ সকল সামাজিক কাজে অংশগ্রহন নিশ্চিত করতে হবে। মসজিদে নারীদের নামাজ আদায়ের মাত্রা ও ধারাকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর সময়কার মতো অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ঈমানদার নারীদেরকে উদ্বু্দ্ধ করতে হবে।

পুরুষ কর্মীদের থেকে আলাদাভাবে পর্দানশীন নারীদের রাজনৈতিক বিক্ষোভ ও প্রতিবাদে নিয়মিত অংশগ্রহন দৃশ্যমান থাকতে হবে।

কর্মজীবি নারীদের মধ্যে কলোনী ও ফ্যক্টরীভিত্তিক যোগাযোগ ও তাঁদের নানাবিধ সামাজিক সেবাপ্রদানকে একটা সাংগঠনিক ট্রেন্ডে পরিণত করতে হবে।

সমাজসেবামূলক কার্যক্রমঃ সমাজ বিপ্লব ও আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের বিষয়ে সমাজসেবমূলক কার্যক্রমের অপরিহার্য্যতা ও ব্যাপকতা সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার দরকার নাই। কথা হলো, জামায়াত কি জনসেবামূলক একটি প্রতিষ্ঠান? নিরপেক্ষ জরিপে অত্যন্ত স্বাভাবিক এই প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক হওয়ার সম্ভাবণা কম। গণ মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসন, খাদ্য, চিকিৎসাসহ সব মৌলিক মানবাধিকার কি কেবল (ইসলামী) রাষ্ট্র কায়েমের পরবর্তী ব্যাপার? যদি তা না হয়, গণবিপ্লব সংঘটন প্রত্যাশী একটি ইসলামী দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামীকে ব্যানার টাংগিয়ে ছবি তোলা ও প্রেস রিলিজ দেয়ার অভ্যেসকে বাদ দিয়ে গণমানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ধনাঢ্য ব্যক্তিদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সমাজসেবামূলক কাজে অর্থ ব্যয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। জামায়াত কর্মীদের মতো যোগ্য ও বিশ্বস্ত লোকদেরকে তাঁরা খুঁজছে। সবকিছুতে উর্ধতন দায়িত্বশীলদের ও সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের জন্য চেয়ে থাকার বিদ্যমান ট্রেন্ডকে ভেংগে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সাধারন মানুষের জন্য রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনার উর্ধে উঠে কাজ করতে হবে। এ ধরনের অরাজনৈতিক কাজের মাধ্যমে গড়ে উঠা রাজনৈতিক প্রাপ্তি প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কার্যক্রমের চেয়ে অনেক বেশী ফলপ্রশ্রু।

প্রযুক্তি, গণমাধ্যম ও সংগঠন-কাঠামোঃ শাহবাগ আন্দোলন এ দেশের প্রচলিত ইসলামী শক্তিসমূহের মধ্যে প্রযুক্তি ও গণমাধ্যম ব্যবহারের যে জোয়ার সৃষ্টি করেছে তা আরও ব্যাপক রূপ লাভ করবে, আশা করি।

বস্তুত পক্ষে, (ইসলামী) আন্দোলন এমন হতে হবে যাতে করে এর প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মধারাকে আন্দোলনের মূলধারা হিসাবে প্রতীয়মান হবে। দ্বীনি তথা ধর্মীয় দিক হতে মনে হবে এটি মূলতঃ একটা দ্বীনি সংগঠন যাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক কিছু কর্মকান্ড আছে। সামাজিক সহায়তামূলক কর্মকান্ডের দিক হতে দেখলে মনে হতে হবে যে, এটি মূলতঃ একটা সামাজিক সংগঠন যাদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কিছু বক্তব্য (আসপেক্ট) আছে। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড এত ব্যাপক হতে হবে যেন বামধারার মতো, এক দৃষ্টিতে, এটিই পুরো আন্দোলনের মূলধারা।

একক সংগঠন-কাঠামোর বর্তমান অবস্থায় এসব ক্ষেত্র ও ব্যক্তি বিশেষে বিপরীতমুখী ধারাগুলোর সমন্বয় সম্ভব নয়। এ জন্য জনশক্তিকে আগ্রহ ও যোগ্যতা অনুসারে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সংগঠন-কাঠামোয় ভাগ করে দিতে হবে। যিনি আভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ সমাবেশে বক্তৃতা দিবেন, সংগঠনের আমীর বা সভাপতি হওয়ার কারনে রাজনৈতিক ময়দানেও তিনি প্রধান অতিথি বা সভাপতির বক্তৃতা দিবেন - বিদ্যমান এই এককেন্দ্রিক সাংগঠনিকতাকে পরিহার করতে হবে। বহুমুখী যোগ্যতাসম্পন্ন মেধাবীদেরকে ব্যতিক্রম হিসাবে দেখতে হবে।

বিনোদন সংস্কৃতিঃ মনে পড়ে, এত টিভি চ্যানেল যখন ছিলনা, তখন মুখঢাকা ইসলামী কর্মীরা ক্যাম্পাসের বাসাগুলোতে বিটিভিতে নিয়মিত সাপ্তাহিক নাটক দেখতো। এলাকার নেক্বাব পরিহিতা ছোট বোন, ছাত্রী, ভাবী/চাচী সবাই এই ‘আমলটি’ করতেন। অমুক নেতার মেয়ে, তমুক দায়িত্বশীলের স্ত্রী – নির্ভরযোগ্য সূত্রেই শুনেছি, কানে হেডফোন লাগিয়ে সুযোগ পেলেই ‘ব্যান্ডের’ গান শুনতেন! একসময়ে ‘আলগা’ নারী/পুরুষ কন্ঠে গান বাজানোর কারনে রেডিও কেনা, রাখা ও শোনা নিষিদ্ধ ছিল। বিবিসি ইত্যাদি খবর শোনার অজুহাতে টিভি রাখাকে একপর্যায়ে জায়েয করা হলো। এখন তো .....

আমি এসব বাসি কথা বললাম এ জন্য যে, ‘লাহওয়াল হাদীস’ (বাজে কথাবার্তা) –এর অজুহাতে এদেশের ইসলামপন্থীরা বিনোদন সংস্কৃতিকে যথাসম্ভব অস্বীকার করার চেষ্টা করেছে। যা মানুষের মানবীয় প্রবণতার পরিপন্থী। বিনোদন সংস্কৃতির পক্ষে যে সব রেফারেন্স হাদীসে আছে সেগুলোর ইপ্লিকেশনকে বিভিন্ন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে অকার্যকর করে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছে।

এখন সময় এসেছে বিনোদন সংস্কৃতি বিষয়ে একেবারে প্রাকটিক্যাল কথা বলা। মনে রাখতে হবে, ভেন্টিল্যাশান প্রিভেন্টস এক্সপ্লোশান। মানুষকে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ দিতে হবে। রিগোরিজম অর্থাৎ কঠোরতা আরোপের প্রতি ঝোঁক হলো ঐতিহাসিকভাবে একটা ধর্মীয় প্রবণতা ইসলাম যার বিরোধিতা করেছে।

যেকোন পরিবর্তনের মতোই এসব বিষয়ে রাতারাতি কিছু করে ফেলার হঠকারীতার পরিবর্তে জামায়াত বা যে কোন ইসলামপন্থী সংগঠন নেতৃবৃন্দের উচিত হবে এসব বিষয়ে নিজেদের মাইন্ড সেটের আমূল পরিবর্তন সাধন করা। মন-মানসিকতায় বাঞ্চিত পরিবর্তন ঘটলে পরিবেশ পরিস্থিতিই বলে দেবে, কখন কি করতে হবে।

বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতাঃ বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে ইসলামপন্থীরা এক অদ্ভূত ধোঁয়াচালে ভোগেন। তাঁরা দাবী করেন, ইসলাম যুগের অগ্রগামী ও বুদ্ধিবৃত্তিক মতাদর্শ। কিন্তু যখনি কোন বিষয়ে কেউ প্রশ্ন তুলেন বা দূরে বসে বুঝে হোক না বুঝে হোক, চ্যালেঞ্জ করে বসেন, তখনি ইনারা বুদ্ধির দাবীকে ‘ঐশী বাণী’ দিয়ে নাকচ করার জেহাদে ঝাপিয়ে পড়েন! যেখানে ওহী আছে, সেখানে নাকি আক্বল তথা বুদ্ধির কোন করণীয় নাই। কথাটা একপেশে বা আংশিক সত্য।

বিঅন্ডের কোন ম্যাটাফিজিক্যাল বিষয়ে বিঅন্ডে যে মহাসত্ত্বা আছেন তাঁর কথা বা ওহীকে মেনে নেয়াইতো যুক্তি-বুদ্ধির দাবী। নয় কি? ব্যাপার যুক্তির স্তর-বিন্যাসের বিষয়, যুক্তিহীনতার বিষয় নয়। যেখানে যুক্তি চলবেনা সেখানেও যুক্তি দিয়েই বলতে হবে, কেন সেখানে যুক্তি চলবে না। তাই না?

ইসলাম পন্থীরা ব্যতিক্রম বাদে সাধারণত ধর্মের বিষয়ে খুবই অসহিষনু। যুক্তিকে যদি যুক্তি দিয়ে মোকাবিলা করা না হয় তাহলে মানুষ কেন সেটি মানবে? আপনারা নিশ্চয় ই জানেন যে, তৎকালীন দার্শনিকদের মতবাদ দার্শনিক যুক্তি দিয়ে মোকাবিলা করেছিলেন বলেই আবু হামিদ আল গাযালী সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিক হিসাবে পরিগণিত হয়েছেন।

জামায়াতের গঠনতন্ত্রে দ্বিমতের বিষয়াদি আভ্যন্তরীণ দলীয় ফোরামের বাহিরে প্রকাশের বিষয়ে যে নিষেধাজ্ঞা আছে তা স্পষ্টতঃই সুন্নাহ বিরোধী। অপ্রিয় সত্য কথা বলা অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাওয়াবের কাজ নয় কি? থিংক ট্যাংক সিস্টেম না থাকা বা কার্যকর না থাকাকে জামায়াতের নেতারা কিভাবে ব্যাখ্যা ও সমর্থন করবেন, জানি না। বেসিক্যালি আধ্যত্মিক চেতনার বিষয় বা ‘নেক আমল’ হিসাবে, সর্বরোগ-বটিকা হিসাবে ইসলামকে ম্যাক্রো-লেভেলে প্রচার, প্রস্তাব ও (বলপূর্বক) প্রয়োগের পরিবর্তে বাস্তব সমাজে বাস্তবায়নযোগ্য ও যে কোনটির তুলনায় অধিকতর কল্যানজনক হিসাবে ইসলামকে প্রপাগেড করতে হবে। ইসলামের জাগতিক যোগ্যতা বাস্তব কাজের মাধ্যমেই প্রমান করতে হবে।

মনে রাখতে হবে, আমাদের ঐতিহ্যগত ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শরীয়াহ’র প্রয়োগের ক্রমধারাকে গ্রহন করা হয়নি। এই ডিডাকটিভ ইসলামিক স্টাবলিশমেন্ট বা স্ট্রাকচারকে ইনডাকটিভ কাঠামোতে রূপান্তর করতে হলে নিজেদের মধ্যে ও অন্যান্যদের মধ্যে এসব বিষয়ে ওপেন ডিসকোর্স চালু করতে হবে।

বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস চর্চায় জামায়াতের বিষ্ময়কর অনীহা- জামায়াত কেন জানি সাংগঠনিকতার নামে একধরনের গোপনীয়তার নীতিতে বিশ্বাস করে। পারষ্পরিক আস্থা ও সাওয়াবের নিয়তে আনুগত্যের প্রাবল্যের জোয়ারে আনওয়ানটেড ফ্যাক্টস কনসিল করা জামায়াতের একটা কমন প্রাকটিস। ১৯৭১ সালে কে কোথায় কী করছিলেন, কেন করছিলেন, অন্যরা কী করছিলেন – ইত্যকার ইতিহাসকে তাঁরা অজ্ঞাত কারনে সব সময়ে চেপে যেতে চেয়েছে।

ইসলামের আধ্যাত্মিকতার প্রবল আবেগ সৃষ্টি করে অনাকাংখিত সত্যকে যথাসম্ভব অনস্তিত্বশীল প্রমাণের চেষ্টা করেছে। ১৯৭৮ সালে মাওলানা আবদুর রহীম সাহেবের সাথে কী হয়েছে, ১৯৮২ সালে যুব শিবিরের ঘটনাটা কী ছিল – এসব সঠিকভাবে জানা, কোন আগ্রহী ব্যক্তি বা গবেষকের জন্য এখন অসম্ভব-প্রায়। ফ্রম নাউ অনওয়ার্ড, এই অভ্যাস ত্যাগ করে বড় কোন ঘটনার বিষয়ে, তা সাংগঠনিক হোক, জাতীয় হোক, সঠিক তথ্য সম্বলিত শ্বেতপত্র টাইপের বক্তব্য দিতে হবে। স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহনের সুযোগের অভাবে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহন বাধাগ্রস্থ হয়।

রাজনৈতিক কর্মকান্ডঃ জামায়াতের পক্ষে অরাজনৈতিক আমব্রেলা সংগঠন হিসাবে ভূমিকা পালনের বিষয়টি এ পর্যায়ে এসে আর সম্ভব নয় বিধায় জামায়াতের উচিত হবে জামায়াতের আদর্শ নিয়ে অনেকগুলো আলাদা প্লাটফর্ম গড়ে তোলা। এই জামায়াত অফ-শুটগুলোর কোন একটা বা কয়েকটা স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক কর্মকান্ডও চালাতে পারে। স্বতন্ত্র এসব দল, সংগঠন ও সংস্থা কমন ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে।

মনে রাখতে হবে, প্রশাসনিক তথা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা এবং নামাজ ও হজ্বের মতো নিতান্ত ধর্মীয় বিষয়াদির ক্ষেত্রে এক কেন্দ্রিক নেতৃত্ব থাকাটা আবশ্যিক। এই এককেন্দ্রিক কর্তৃত্বের ব্যবস্থা এর বাহিরে ইসলাম কায়েমের ও প্রতিষ্ঠিত ইসলামী কর্তৃপক্ষের গাইডেন্সের জন্য কর্মরত দলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

ইসলাম কায়েমের চেষ্টা বিভিন্ন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন পথ, পদ্ধতি ও সাংগঠনিক কাঠামোয় করতে পারে। এ ধরনের পলিটিক্যাল প্লুরালিজমকে গ্রহন বা ধারন করার লক্ষ্যে অর্গানাইজেশনাল টোটালিটারিয়ানিজম ও রেজিমেন্টেশান হতে জামায়াতের রিজিড সংগঠন কাঠামোকে ফ্লেক্সিবল হিসাবে রূপান্তর ঘটাতে হবে। অন্ততঃপক্ষে এ ধরনের মুভ-কে একোমোডেইট করা, একনলেজ করার মন-মানসিকতা বিচার-পরবর্তী জামায়াত নেতৃত্বের থাকতে হবে।

সংগঠন কাঠামোর পূণঃর্বিন্যাস -

ক্যডার সিস্টেম- গণমানুষের কথা বলতে হলে, গণবিপ্লব করতে হলে নির্বাচনমুখী গণতন্ত্র নির্ভরতাকে পরিহার করে সত্যিকারভাবেই গণমুখী চরিত্রের হতে হবে। ক্যডার সিস্টেমের কারনে গণমানুষের যারা নেতা তাঁরা সাধারনত সংগঠন-মুখী হয়না। অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট সমাজিক মানদন্ডে কম যোগ্যতার কোন ক্যডার বা সাংগঠনিক পদাধিকারী, সংগঠনের নেতা হওয়ার সুবাদে সমাজেরও নেতা হয়ে বসেন যা ক্ষেত্র বিশেষে অনাকাংখিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। নিছক সাংগঠনিক (রুকন) ভোটাধিকারের বলে একজন কর্মচারী ভাইয়ের উপর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এমারত এসে যেতে পারে। তিনি কিভাবে ‘স্যার’দের নেতৃত্ব দিবেন?

ক্যডার সিস্টেমকে একেবারে বাদ না দিয়ে একে যথেষ্ট পরিমানে নমনীয় তথা ফ্লেক্সিবল হিসাবে রি-সেট করতে হবে।

রিপোর্টিং সিস্টেম- বর্তমান কাঠামোর ব্যক্তিগত রিপোর্টিং সিস্টেমকে বাদ দিয়ে ‘তাওয়াছাও বিল হক্ব’ বা হক্ব-এর বিষয়ে পরামর্শ প্রদান সংক্রান্ত গাইডেন্সের আলোকে ব্যক্তিগত মান সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কেউ চাইলে ছাপানো বইয়ে লিখতে পারবে, কেউ চাইলে ডায়রীতে লিখবে, কারে যদি মনে থাকে তিনি স্মরণ করে বলবেন – এমনটি হতে হবে। মুমিন মুমিনের আয়না – এই হাদীসের ভিত্তিতে ভাল কাজে একজন অপরজনকে ব্যক্তিগত মানোন্নয়নে সহযোগিতা করবেন।

সিলেবাস- জামায়াত-শিবিরের মানোন্নয়ন সংক্রান্ত যে পাঠ্যসূচী হাতে নিয়ে কারো পক্ষে এটিকে ‘মাওলানা মাওদূদী লিমিটেড কোম্পানী’ বলাটা একেবারে অযৌক্তিক নয়। বিশ্বে জামায়াতই একমাত্র ইসলামী আন্দোলন নয়। যারা জামায়াতের বাহিরে বিভিন্ন দেশে ইসলামী আন্দোলন করছেন, সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়ও গিয়েছেন, ‘সাফল্যের শর্তাবলী’, ‘নৈতিক ভিত্তি’ কিম্বা ‘হাকীকত সিরিজি’ ছাড়াইতো তাঁরা কাজ করছেন। তাই না? ইসলামী আন্দোলন বুঝার জন্য ‘তাফহীমুল কোরআন’ ছাড়া গত্যন্তর নাই বলে যারা মনে করছেন তাঁরা একটা নির্দোষ ভুল করছেন। জামায়াত শিবিরের লোকজন মাওলানা মওদূদীর ইসলামী সাহিত্য পড়ে ইসলামকে একটা পূর্ণাঙ্গ ও গতিশীল মতাদর্শ হিসাবে বুঝেছেন, জেনেছেন। একবিংশ শতাব্দিতে ইসলামকে সঠিকভাবে জানার জন্য বুঝার জন্য মাওলানা মওদূদীর সাহিত্যের বাহিরে আর কোন উপযোগী বই-কিতাব নাই কিম্বা হতে পারেনা – এমন কি?

সাংগঠনিক পাঠ্যসূচীতে দলীয় নেতাদের নোট টাইপের পুস্তিকা, একচেটিয়া মাওলানা মওদূদীর বই ইত্যাদির পরিবর্তে প্রাচীন ও সমকালীন নামকরা ইসলামী গবেষকবৃন্দের বই-পুস্তক টেক্সট ও রেফারেন্স হিসাবে রাখতে হবে যেখানে মাওলানা মওদূদীরও কয়েকটা বই থাকতে পারে।

সংগঠন কাঠামো ও প্লুরালিজম- জামায়াতের বর্তমান সংগঠন কাঠামো জায়ান্ট ট্রি মডেলের। একটি বটবৃক্ষের মূল, প্রধান কান্ড, শাখা-প্রশাখা ও ফুল-পাতার মতো মাওলানা মওদূদীর সাহিত্য হলো জামায়াতের শেকড়, কেন্দ্রিয় সেটআপ হলো এর প্রধান কান্ড, শিবির, ছাত্রী সংস্থা ইত্যাদি হলো এর শাখা, ফুলকুঁড়ি, চাষী কল্যাণ সংস্থা, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশান ইত্যাদি এর প্রশাখা।

জায়ান্ট ট্রি বা বটবৃক্ষের আদলে গড়ে তোলার সংগঠন কাঠামো সম্প্রতি সবচেয়ে মারাত্মকভাবে সংগঠন ও আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে কতিপয় শীর্ষ জামায়াত নেতাকে আটক করার ফলে পুরো সংগঠন, এর সকল শাখা-প্রশাখা নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সার্বক্ষণিকভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

এর পরিবর্তে পেশা ও শ্রেণীগতভাবে সংগঠনের কলাম গুলো যদি সত্যিকারভাবেই স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে গুচ্ছবদ্ধ থাকতো, তাহলে একটি কলামের কোন লোকাল প্রবলেম বা ইস্যুতে অন্যগুলো একসাথে ভেংগে পড়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। আলাদা কিন্তু পাশাপাশি বানানো কোন দালানের অংশবিশেষ বোমার আঘাতে ভেংগে পড়া সত্বেও এর অন্য অংশ ঠাই দাঁড়িয়ে থাকা হলো এর উদাহরণ।

রাজনৈতিক ইসলাম বা ইসলামের রাজনৈতিকতার এই গণজোয়ারকে ধরে রাখতে হলে, কাজে লাগাতে হলে, এ দেশে ইসলামের জন্য কাজের নেতৃত্ব দিতে হলে বিদ্যমান ‘জায়ান্ট ট্রি মডেলে’র পরিবর্তে ‘ওয়াইড গার্ডেন মডেলে’ সংগঠন কাঠামো গড়ে তোলা আশু কর্তব্য। এতে স্বাতন্ত্র্যপ্রিয়তার কল্যাণে মানুষের মধ্যে সৃষ্টিশীলতার উদ্ভব ঘটবে।

গণ বিপ্লব সৃষ্টি, তাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো, টিকে থাকা ইত্যকার জাগতিক সফলতার অন্যতম শর্ত হলো আদর্শের পক্ষে ‘আইকন’ তৈরী হওয়া। টাওয়ারিং ফিগার তৈরী হওয়া। সেলফ ব্রান্ডিংকে স্বীকার না করলে, সুযোগ না দিলে ক্যারিজমেটিক লিডারশীপ তৈরী হতে পারে না। এবং ক্যারিজমেটিক লিডার ছাড়া যৌথ নেতৃত্বে, সাংগঠনিকভাবে বিপ্লব সংঘটনের কোন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নাই, হতে পারে না।

জামায়াত আত্মার বিকাশে গুরুত্ব আরোপ করে, আত্মপ্রকাশ বা আত্মবিকাশকে নিরুৎসাহিত করে, খারাপ ও ক্ষতিকর মনে করে। যার কারনে জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে মাওলানা মওদূদীর পরে আর কোন আইকন তৈরী হয় নাই। আইকন না থাকায় জামায়াত জাতীয় জীবনে প্রভাবকের সহায়ক ভূমিকার বাহিরে আজ পর্যন্ত এককভাবে কিম্বা তেমন মৌলিক কিছু করতে পারে নাই। মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীকে নিয়ে জামায়াত আগাতে পারতো।

জামায়াত আনুগত্যকে যতটা জোর দিয়েছে, আনুগত্যের পরিমন্ডলকে যতটা বিস্তৃত করেছে, পরামর্শ-প্রক্রিয়াকে ততটা গুরুত্ব দেয় নাই, বরং ক্ষুদ্রতর, ক্ষেত্র বিশেষে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্নদের সমন্বয়ে গঠিত একপেশে দলীয় ফোরামের মধ্যে ‘আলোচনা-পর্যালোচনা ও পরামর্শ-প্রক্রিয়াকে যথাসম্ভব সীমিত করেছে।

নেতৃত্ব ও আনুগত্যের ভারসাম্য দাবী এক অর্থে অর্থহীন বটে। কারন, আনুগত্য থাকলেই নেতৃত্ব থাকবে, নেতৃত্ব থাকলে আনুগত্যও থাকবে। ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার বিষয় হলো নেতৃত্ব ও পরামর্শের মধ্যে। কারন নেতৃত্ব ও পরামর্শের মধ্যকার সম্পর্ক অনিবার্য্ নয়, আপতিক। একটি থাকলে অপরটি না-ও থাকতে বা কমও থাকতে পারে। সুতরাং নেতৃত্ব ও পরামর্শের মধ্যকার ভারসাম্য ই কায়েম করার ব্যাপার। নেতৃত্ব ও আনুগত্যের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলা, এই অর্থে জামায়াতের অন্যতম তাত্ত্বিক ভ্রান্তি।

ইসলামী ঐক্যপ্রচেষ্টা- মাজারপূঁজারী ছাড়া সকল ইসলামী শক্তির সাথে কার্যকর সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে। আমরাই সেরা – এমন অহমিকা নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। জামায়াতের বাহিরে দেশে ইসলামের কাজ কারা কারা করছে এমন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে জামায়াতের উচ্চ শিক্ষিত লোকেরাও তেমন কিছু বলতে পারে না। অন্যদেরকে সম্মান করতে না পারলে, সেক্রিফাইস করতে না পারলে, নিজেদেরকে সো-ল এজেন্ট হিসাবে জাহিরে ব্যস্ত থাকলে আত্মপ্রচারমূখী বাঙলীরা কেন আপনাদের সাথে কাজ করবে? যদিও সেটি ইসলাম-এর জন্যও হয়? ঐক্য যদি চান, তাহলে সময়ে সময়ে পেছনে গিয়ে বসার মন-মানসিকতাও থাকতে হবে।

জামায়াত কি পারবে? জামায়াত কি এসব বিষয়কে গ্রহন করতে, অন্ততঃ সিরিয়াসলি ডিসকাস করতে পারবে? সুদিনে তাঁরা নিয়োগ ও সুবিধা বন্টনে ব্যস্ত থাকেন। দূর্দিনে মোকাবিলায়। প্রকৃতপক্ষে উচ্চ শিক্ষিত জনশক্তির এক বিরাট অংশ মাঝে মধ্যে অনানুষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত পরিমন্ডলে সংবাদ পর্যালোচনা ব্যতিরেকে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, কর্মপন্থা নির্ধারণ, পরামর্শ ও কৌশলগত সহযোগিতা প্রদান, জনমত গঠন ও প্রয়োজনে মোকাবিলার মতো ‘অসুবিধাজনক পথে’ অগ্রসর হয় নাই। ভাবাদর্শগত বিজয় সত্বেও দলীয়ভাবে জামায়াতের পরাজয়ের শংকা এখানেই। কারন, বাংলাদেশে ‘জামায়াত’ - এই নামে, সাধারনের মাঝে একতরফা প্রচারণার পরিণতিতে ক্ষেত্রবিশেষে বিতর্কিত এসব পরিচিত নেতাদেরকে দিয়ে একটি গণমুখী দল পরিচালনা দুরূহ ব্যাপার। বিপ্লবের সম্ভাবণার নিরিখে বিবেচনা করলে তাই এই পুরনো দলটির নাম ও নেতৃত্ব সহকারে যে পরিচিতি, তার পরিবর্তনই কাম্য।

জামায়াত তার ঐতিহ্যবাহী নাম আর কাঠামোকেই গুরুত্ব দিবে, না স্বীয় মতাদর্শকে আপহোল্ড করবে – সেটি তাঁদের এখন সিরিয়াসলি ভেবে দেখার ও সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়। যুগ ও সময়ের চাহিদা অনুসারে নিজেকে পূণঃনির্মাণ করতে না পারলে জামায়াত বড় ধরনের ভুল করবে। যদি জামায়াত রি-স্ট্রাকচারড হয়ে, নিজেকে রি-ব্র্যান্ড করে ময়দানে উঠে আসতে পারে তাহলে এ পর্যন্ত জামায়াতের যত ভুল হয়েছে, যত ক্ষতি হয়েছে সব পুষিয়ে যাবে। এমনকি বিশাল লাভের বোঝা বইতে গিয়ে তাকে হয়তোবা হিমশিম খেতে হবে! প্রস্তুতি না থাকলে পরাজয়ের ঢেউয়ের আঘাতের চেয়ে বিজয়ের স্রোতের তীব্রতা সামাল দেয়া কঠিনতর হয়ে পড়ে।

আমি আশাবাদী, জামায়াতের নবীণ নেতৃত্ব নতুন ভাবে সংগঠন ও আন্দোলনকে গড়ে তুলবে। হতে পারে, মানুষ অধিকতর রক্ষণশীল হেফাজতে ইসলামের পরিবর্তে আধুনিক ও মধ্যপন্থী জামায়াতপন্থীদেরকেই শ্রেয়তর মনে করবে ও নেতৃত্বের জন্য বেছে নেবে। তেমন পরিস্থিতিতেও নতুন ধারার ইসলামপন্থী আন্দোলনকে অপরাপর ইসলামী ও ইসলাম-বহির্ভূত সবাইকে নিয়ে থাকতে হবে, চলতে হবে, দেশ গড়ার কাজে নিয়োজিত হতে হবে।

বিষয়: বিবিধ

২৮৭০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File