‘শিক্ষকের মর্যাদা’ দেয়া না আদায়ের বিষয়
লিখেছেন লিখেছেন শফিক সোহাগ ২৫ জুন, ২০১৪, ১২:১৭:৫২ রাত
সেদিন ফিজিক্স ক্লাসে লেকচারের ফাঁকে ম্যাডাম আক্ষেপের সাথে একটা বললেছিন- ‘একজন টিচার হিসাবে ভার্সিটি সম্মানি হয়তো টিচারদের দিতে পারছে। কিন্তু স্টুডেটরা টিচারদের যথাযথ সম্মান দিচ্ছে না। জানি না, অন্য টিচাররা পান কি না তবে আমি স্টুডেনদের কাছ থেকে সেটা পাইনি। আজকাল স্টুডেটরা টিচারদের সম্মান দেয় না, শ্রদ্ধাবোধ দেখায় না......।’
ম্যাডামের এই কথা শুনার সাথে সাথে আমার ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতাটির কথা মনে পড়ল। কবিতাটি সম্পূর্ণ আমার মুখস্থ ছিল চেষ্টা করলাম কবিতাটি স্মরণ করার জন্য। নাহ, পাচ/ছয় লাইনের বেশী পারলাম না। আমার কাছে কেন জানি বারবার মনে হচ্ছিল ম্যাডামের এই আক্ষপের জবাব ওই কবিতায় আছে। বাসায় এসে কবিতাটি পড়লাম। হ্যাঁ, পেয়ে গেছি উত্তর।
কবিতার মূলকথা এমন ছিল-‘ বাদশাহ আলমগীরের ছেলেকে দিল্লির এক মৌলভী পড়াতেন। একদিন সকালে বাদশাহ দেখেন বাদশাহর ছেলে মৌলভী সাহেবের পায়ে পানি ঢালছে আর মৌলভী নিজ হাতে পায়ের ধুলা পরিষ্কার করতেছেন। শিক্ষক মৌলভী খুব ভয় পেয়ে গেলেন। বাদশাহের পুত্রকে দিয়ে পানি ঢালার অপরাধে তিনি চিন্তিত হয়ে গেলেন। অবশেষে নিজেকে নিজেই শান্তনা দিলেন এই ভেবে- “শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার।” পরদিন সকালে বাদশাহর দূত শিক্ষকে কেল্লাতে ডেকে নিয়ে গেল। বাদশাহ শিক্ষককের উদ্দশ্যে বললেন- আমার পুত্র আপনার কাছে সৌজন্য কি কিছু শিখিয়াছে? বরং শিখেছে বেয়াদবি আর গুরুজনে অবহেলা। বাদশাহ সেদিন সকালের ঘটনা উল্লেখ করে বলেন- আমার পুত্র আপনার পায়ে পানি ঢালছে আর আপনি নিজ হাতে আপনার পা পরিষ্কার করতেছেন। আমার পুত্র কেন নিজ হাত দিয়ে সযত্নে আপনার পা বুলিয়ে পরিষ্কার করে দিল না? সে শিক্ষা কেন আপনি তাকে দিলেন না?
নিজ ভুল বুঝতে পেরে শিক্ষক তখন উচ্ছ্বাস ভরে সগৌরবে উচ্চকন্ঠে বললেন-
"আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।”
একজন শিক্ষক যদি তার মর্যাদা তিনি নিজে আদায় করে না নেন তাহলে ছাত্ররা কি এমনিতে দিবে? অথবা অন্যভাবে বললে- ছাত্রদের কাছ থেকে আদায় করে না শিখানো হয় তাহলে তারা দিবে কিভাবে?
ক্লাসে যে শিক্ষক খুব বেশী কঠুর, পড়া আদায়ে যিনি কোন ছাড় দেন না। দেখবেন, সব ছাত্র উনার পড়া ঠিকই নিয়ে আসে পক্ষান্তরে যে শিক্ষক পড়া আদায়ে ছাড় দেন সেই ক্লাসে ছাত্ররা ফাঁকি দেয়। শিক্ষকদের সম্মান না করলে, শিক্ষকদের সাথে বেয়াদবী করলে যে শিক্ষক ছাত্রদের শাস্তি দেন সব ছাত্ররা ঠিকই সেই শিক্ষককে সম্মান করে, শ্রদ্ধাবোধ দেখায়।
ছোটবেলা দেখতাম ছাত্ররা এমনকি অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবকরাও শিক্ষকদের খুব ভয় পেতেন। যে ভয়টা ছিল সম্মান প্রদর্শন, আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধাবোধ প্রকাশের প্রতীক। ছোটবেলা এগুলো দেখে এটাই শিখেছি শিক্ষক মানেই সম্মানিত ব্যক্তি। উনাকে দেখলেই সালাম দিতে হবে, কথা বলতে হবে বিনয়ের সাথে, ভদ্র আচরণ করতে হবে এক কথায় যতভাবে সম্মান প্রকাশ করা যায়। কেন এটা হত জানেন শিক্ষকরা এগুলো আদায় করে নিতেন। আর আজ ঠিক উল্টো ঘটনা- শিক্ষকরা ছাত্রদের ভয় পায়।
রাজনীতির নামে বা অন্য কোন বিষয়ে যখন শিক্ষক-শিক্ষক গ্রুপিং, শিক্ষক-ছাত্র গ্রুপিং হবে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক যখন একসাথে নাচানাচি করবে। কোচিং-এর নামে যখন শিক্ষক ছাত্রদের মাঝে মার্কিং করবেন। শিক্ষকরা যখন ইভটিজিং বা অন্য কোন জঘন্য কাজে লিপ্ত হবেন। মানুষ গড়ার কারিগর না হয়ে শিক্ষকরা যখন মানুষ ধ্বংসের কারিগর হবেন। শিক্ষকদের ব্যবহার যদি শিক্ষকের মত না হয়। কথা-বার্তার ভাষা যদি কর্কশ হয় তখন ছাত্ররা কিভাবে শিক্ষকের মর্যাদা দিবে????
পরিশেষে- বাদশাহ আলমগীরের মত অভিভাবক আর দিল্লীর মৌলভীর মত শিক্ষক হতে না পারলে শিক্ষকের মর্যাদা কেউ ঠিক মত বুঝেবে বলে মনে হয় না। কেউ আদায় করে নেবে কিংবা শিক্ষককের মর্যাদা দেবে বলে মনে হয় না।
‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতাটি নিচে দেয়া হল-
বাদশাহ আলমগীর
কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর ;
একদা প্রভাতে গিয়া,
দেখেন বাদশাহ-শাহাজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া;
ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে;
পুলকিত হৃদয় আনত-নয়নে ।।
শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া নিজেরি পায়ের ধুলি
ধুয়ে মুছে সব করিছেন সাফ্ সঞ্চারি অঙ্গুলি।
.
শিক্ষক মৌলভী
ভাবিলেন আজি নিস্তার নাহি, যায় বুঝি তার সবি।
দিল্লীপতির পুত্রের করে
লইয়াছে পানি চরণের পরে,
স্পর্ধার কাজ হেন অপরাধ কে করেছে কোন্ কালে!
ভাবিতে ভাবিতে চিন্তার রেখা দেখা দিল তার ভালে।
হঠাৎ কি ভাবি উঠি
কহিলেন, আমি ভয় করি না'ক, যায় যাবে শির টুটি,
শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার
দিল্লীর পতি সে তো কোন্ ছার,
ভয় করি না'ক, ধারি না'ক ধার, মনে আছে মোর বল,
বাদশাহ্ শুধালে শাস্ত্রের কথা শুনাব অনর্গল।
যায় যাবে প্রাণ তাহে,
প্রাণের চেয়েও মান বড়, আমি বোঝাব শাহানশাহে।
তার পরদিন প্রাতে
বাদশাহর দূত শিক্ষকে ডেকে নিয়ে গেল কেল্লাতে।
খাস কামরাতে যবে
শিক্ষকে ডাকি বাদশা কহেন, ''শুনুন জনাব তবে,
পুত্র আমার আপনার কাছে সৌজন্য কি কিছু শিখিয়াছে?
বরং শিখেছে বেয়াদবি আর গুরুজনে অবহেলা,
নহিলে সেদিন দেখিলাম যাহা স্বয়ং সকাল বেলা''
শিক্ষক কন-''জাহপানা, আমি বুঝিতে পারিনি হায়,
কি কথা বলিতে আজিকে আমায় ডেকেছেন নিরালায়?''
বাদশাহ্ কহেন, ''সেদিন প্রভাতে দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে
নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন,
পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ।
নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে
ধুয়ে দিল না'ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।''
.
উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে
কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে-
"আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর" । ।
বিষয়: বিবিধ
৩৭৪০ বার পঠিত, ২৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমার ব্লগ বাড়ীতে আবার আসবেন
ভাল লাগলো জেনে আমারও ভালো লাগলো
ধন্যবাদ।
সত্যিই সুন্দরলেখা।
বর্তমান সময়ের ছাত্রদের পড়ানো হলেও সেটা মান তারা বুঝবে না, কেননা যে শিক্ষক এই কবিতা পড়াবে সেও জানেনা এই কবিতার মর্ম কি? কেননা সেও এই কবিতা পড়ে শিক্ষিত হয় নাই। সে কারণে সভ্যতা একরার বিলুপ্ত হলে সেটা অন্তত সে স্থানে আর উদ্ধার হয় না। অনেক ধন্যবাদ
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।।
হা আমার স্যারদের কাছে এখনও গেলে কত যে আদর করেন। আলহামদুলিল্লাহ।
আর এমনও হয় এখন স্যার যখন রাস্তায় হাটেন আমরা দেখি সম্মানে এখনও রাস্তায় খুব নিরবতা অবলম্বন করি।
ধন্যবাদ আপনাকে।
যে স্যাররা ছিলেন মানুষ গড়ার সত্যিকারের কারিগর তাদের নাম আজও স্মরণ হয় শ্রদ্ধাবোধের সাথে।
ধন্যবাদ আপনাকে।
ভাল লিখেছেন। ধন্যবাদ আপনাকে
অনেক ধন্যবাদ আমার ব্লগ বাড়ীতে আসার জন্য
মন্তব্য করতে লগইন করুন