ব্যতিক্রমী শাস্তি
লিখেছেন লিখেছেন শফিক সোহাগ ২৯ মে, ২০১৩, ০৮:১৫:৫০ রাত
ক্লাসে আমরা সবাই মাথা নিচু করেই বসে আছি আর অপরাধীরা সবাই দাড়িয়ে আছে। তাদের অপরাধটা হল বাড়ির কাজ না আনা। এদিকে স্যার তাঁর “হেদায়াতী নসিহত” দিচ্ছেন। হেদায়াতী নসিহত মানে হল সংশোধন বা পথ প্রদর্শনের উপদেশ। এটা বলার অবশ্যই কারণ আছে একদিন স্যার তাঁর “হেদায়াতী নসিহত” দেয়ার মাঝে এই শব্দটি উল্লেখ করেছিলেন। তখন থেকে স্যারের এ ধরনের কথাকে আমরা হেদায়াতী নসিহত বলে থাকি। স্যারের কথাগুলো শুনে খুব খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছিল স্যার ধনুক থেকে এক একটি তীর ছোঁড়ছিলেন আর তা আমাদেরকে বিঁধ করছে। অবশ্যই সবাইকে না আমার মত যারা স্যারের বকাবকি-ধমক খেতে চান না তাদেরকে। ক্লাসে মাত্র ক’টা ছাত্রের জন্য পুরো ক্লাসে সবাইকে বকা খেতে হচ্ছে। খুব রাগ হচ্ছিল তাদের উপর। ক্লাস নাইনে থাকতেও এই রকম ছাত্র ক’টার জন্য কত বকা খেতে হয়েছে তাঁর হিসাব নেই। ক্লাস টেনে উঠেও সেই একই অবস্থা। কতদিনে যে তাদের বোধদয় হবে আল্লাহ ভাল জানেন।
এই স্যার খুব আমাদের সবার প্রিয় কারণ খুব ভাল পড়ান, সহজে বুঝান, ক্লাসে অনেক মজার মজার উদাহরণ/গল্প বলে পড়া বুঝান, ক্লাসের মজার মজার অনেক কিছু করেন তবে স্যার খুব কড়া, অপরাধ করলে ছাড় নেই। ভয় হচ্ছে কি না কি করেন (?) কান ধরে কিংবা বকের মত এক পা তুলে স্কুলের মাঠ ঘুরানো, রোদের মধ্যে দাড় করানো অথবা লাঠি হাতে পিটানো স্যার কাছে খুব স্বাভাবিক শাস্তি। ভাবছি, আজ কি শাস্তি দেন (?) কান ধরে কিংবা বকের মত এক পা তুলে স্কুলের মাঠ ঘুরানো; ছি কি লজ্জার কথা !! যদিও এখানে কলেজের ছাত্র আছে কিন্তু স্কুল লেভেলে তো আমরা সর্বোচ্চ ক্লাস। এখন যদি কান ধরে বা বকের মত পা তুলে স্কুল মাঠে ঘুরতে হয় তাহলে বাঁচা মরা তো সমান কথা। তাহলে কি কান ধরে উঠ-বস করা.... (?)। অ্যাঁ...!! এই সব ভাবতে ভাবতে স্যারের হেদায়াতী নসিহত মনযোগ দিয়া শুনা হয়নি। হুম...! স্যারের রাগী সুর নরম হয়ে আসছে, হেদায়াতী নসিহতে ভাঁটা পড়ছে মনে হয়। ঘড়ির দিকে থাকালাম।
অ্যাঁও...!! পাকা ৯ মিনিট হেদায়াতী নসিহত। এতক্ষন মাথা নিচু করেই ছিলাম মাথা একটু তুলে আড় চোখে থাকালাম স্যারের দিকে। স্যার চেহারা দেখ মনে হল চেহারাটা আমাকে বারবার বলছে তোমার স্যার যা বলছেন সব তোমাদের ভালর জন্যই। এই কথাগুলো গ্রহণ কর জীবনের চলার পথে পাথেয় হয়ে থাকবে আর যদি গ্রহণ না কর তবে এক সময় ঠিকই তমাদের ভুল বুঝতে পারবে তখন আপসোস করা ছাড়া রা কিছুই থাকবে না। স্যার হেদায়াতী নসিহত উপসংহার টনাছেন মনে হচ্ছে। স্যারের শেষ কথা হল- “এত কিছু বললাম। জানি না কাজে লাগবে কি না। তবে তোমাদের ভালর জন্যই বলছি। কিন্তু বলে আর কি হবে তোমাদের এক কান দিয়া যায় আর আরেক কান দিয়া বের হয়। মনে হয় তোমাদের মাথায় ব্রেইন নাই। ব্রেইন যদি থাকত তাহলে সরাসরি বের হতনা একটু হলেও আটকা পরত। যা বললাম তা যদি গ্রহণ করতে পার তবে তোমাদেরই ভাল হবে আর যদি গ্রহণ না কর তবে এক সময় এর জন্য আপসোস করতে হবে। এখনও সময় আছে, তোমরাও বড় হয়েছে। ভাল মন্দ বুঝার বয়স হয়েছে।
যাই হোক, আপরাধীদের তো শাস্তি দিতে হবে। আগাছা না কাটলে যেমন বড় হয় তেমনি অপরাধীদের শাস্তি না দিলে অপরাধ করতেই থাকবে। (শাস্তি কথা শুনে কি ভয় লাগছে, আমি অপরাধী না তারপরও ভয় করছে। অপরাধীদের তো পা কাঁপা শুরু হয়ে গেছে।) কি শাস্তি দেওয়া যায় তোমাদের?? বুড়া হয়ে গেছ তোমরা; এখন যদি কান ধরে বা পা তুলে স্কুল মাঠ ঘুরতে তাহলে তোমাদের লজ্জা না লাগলেও আমার লাগবে।
স্যার একটু থামলেন। মনে হচ্ছে কিছু চিন্তা করছেন। হুম, ৪৫ সেকেন্ডের মত হবে চিন্তা করলে তারপর বললেন- “আজ তো নতুন ক্লাসে প্রথম শাস্তি তাই আজ তোমাদের শাস্তি দিব ঠিকই তবে একটু ব্যতিক্রম।” তারপর দুই পৃষ্ঠা কাগজ নিয়ে কয়েক টুকরো করলেন। তারপর কাগজের মধ্যে কি যেন লিখলেন। আমরা তো অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। ভাবছি, আবার নতুন কোন শাস্তির আবিষ্কার করেন। স্যার অপরাধী সবাইকে সামনে নিয়ে দুই লাইনে দাড় করালেন। অ্যাঁ......!! এক, দুই.... তিন... বারো জন। হুম, স্যার রাগ করবে না তো আদর করবে নাকি। একটি ক্লাসে যদি বারোজন বাড়ির কাজ না করে তাহলে তো রাগ করারই কথা।
শস্তির পর্ব শুরু। নিয়মাবলী ঘোষণা করছেন স্যার। টেবিলে কাগজ রাখা আছে সবাই একটা করে কাগজ তুলতে হবে। যার ভাগ্যে যা পরবে তাকে তা করতে হবে। আর যদি কাগজে যা লিখা তা করতে না পার তবে কিন্তু কান ধরে স্কুল মাঠে ঘুরতে হবে। চেয়ার-টেবিল একটু ডান পাশে সরিয়ে বিচারকের মত বসলেন স্যার।
প্রথম জনের ডাক পরল। নাম তার মামুন; খুব ভাল ক্রিকেট খেলতে পারে। কাঁপা হাতে একটা কাগজ তুলল সে। কাগজের বাজ খুলতেই স্যার জিজ্ঞাস করলেন- কি লেখা? সে বলল বলল- একটা কবিতা বলা। স্যার বললেন- তাহলে শুরু কর। চেয়ার দেখে মনে হচ্ছে চিন্তার সাগরে ডুবে গেছে সে। বুঝা যাচ্ছে না কি চিন্তা করছে। একটাও পারে না নাকি অনেক কবিতা পারে কোনটা রেখে কোনটা বলবে। শুরু করল সে-
সংকল্প
কাজী নজরুল ইসলাম
থাকব না’ক বদ্ধ ঘরে
দেখব এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।
দেশ হতে দেশ দেশান্তরে
ছুটছে তারা কেমন করে,
কিসের নেশায় কেমন করে
মরছে যে বীর লাখে লাখে।
আট লাইন বলেই শেষ করল সে। স্যার বললেন- কবিতা তো আর লম্বা বাকিটুকু বল। সে বলল- পারি না স্যার। স্যার বলল- জানি পারবেনা, আমরা কবিতা শিখি পরীক্ষায় লিখার জন্য। এজন্য ৮ লাইনের বেশী বেশীর ভাগ ছাত্ররাই পারবে না। অথচ শিক্ষামূলক, উৎসাহমূলক কবিতাগুলো সবাই শিখে রাখা উচিত।
দ্বিতীয় জনের ডাক পরল। একটা কাগজ তুলল সে। কাগজের বাজ খুলতেই স্যার জিজ্ঞাস করলেন- কি লেখা? সে বলল- একটা দেশের গান গাইতে হবে। চিন্তায় পরে গেল সে। গান তো অনেক পারি, হিন্দি-বাংলা-ইংলিশ আরও অনেক কিছু কিন্তু দেশের গান (!!) নাহ...! একটাও মনে পরছে না। কাঁপা কন্ঠে সে বলল পারি না স্যার। স্যার বললেন- সারাদিন তো কানে হেয়ারফোন লাগানো থাকে.........! দেশের গান না পারলে অন্তত জাতীয় সঙ্গীতটা গাও। জাতীয় সঙ্গীতের কথা শুনে কিছুটা সস্থি পেল মনে হয়। শুরু করল ভাঙ্গা গলায়- “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি, চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস আমার প্রানে ওমা আমার প্রানে বাজায় বাঁশী. ওমা ফাগুনে..................। শেষ...! গানের গাড়ি এতটুকুতেই থেমে যায়। আমাদের দেশপ্রমিক (!) ছাত্ররা দেশের জাতীয় সঙ্গীতটা জানে কিন্তু অনেক অনেক হিন্দি-ইংলিশ গান পারে।
এবার ডাক পরল তৃতীয় চতুর্থ জনের। তার নাম ফাহাদ; ক্লাসে মধ্যে যে কয়জন ফাঁকিবাজ ছাত্র আছে তার মধ্যে সে সবার উপরে। একটা কাগজ তুলল সে। কাগজের বাজ খুলতেই স্যার জিজ্ঞাস করলেন- কি লেখা? সে বলল বলল- নামতা বলা। হু.. হ... করে হেসে উঠল সবাই। স্যার বললেন- বল ১৩ এর নামতা। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে শুরু করল সে- তের একে তের, দুই তেরো ছাব্বিশ, তিন তের ঊনচল্লিশ, চার তের আটচল্লিশ...। হু...... হু...... করে হেসে উঠল সবাই। আসলে হয়েছে কি আমরা প্রযুক্তির উপর এত নির্ভর হয়ে গেছি যে ছোটবেলায় শিখা নামতাগুলো আর মনে নাই। সামান্য যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করতে আমরা ক্যালকুলেটর ব্যবহার করে থাকি। হঠাৎ কাউকে যদি নামতা জিজ্ঞাস করা হয় তাহলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশী হউক না সে মেডিকেল বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কেউ যদি বলতেও পারে তবে সে সময় নিয়ে বলতে পারবে। ছোটবেলা যেভাবে শিখেছিলাম ঠিক সেইভাবে তাড়াতাড়ি বলতে পারবে এমন ছাত্রের সংখ্যা খুবই কম- নেই বললেই চলে।
এবার চতুর্থ জনের পালা। কাগজ তুলে দেখল তার ভাগ্যে পড়েছে বিশ থেকে এক পর্যন্ত উল্টো গণনা করা। তাকে দেখে মনে হল তার ভাগ্যে খুব সহজটা পড়েছে। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসের সাথে খুব দ্রুত গণনা শুরু করল সে- বিশ, উনিশ, আটারো, সতেরো, ষোল, পনের, চৌদ্দ, তের, বারো, এগারো, বারো...... হা...হা...হা... আওয়াজ পুরো ক্লাসরুমে। সবই ঠিক মত হচ্ছিল কিন্তু এগারোতে আসার পর আবার উল্টো হয়ে গেল।
এবার পঞ্চম জনের ডাক পড়ল। সে একটা কাগজ তুলল। তার ভাগে পড়েছে ব্যঞ্জনবর্ণ বলা। এটা বলার সাথে সাথে মাঝারি একটা হাসির রোল পড়ে গেল সবার মাঝে। কিন্তু যার ভাগে ব্যঞ্জনবর্ণ বলা পড়েছে তার হার্টবিট হতো সেকন্ডে দশবার উঠা-নামা করছে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে অ... আ... ই... ঈ.... এগুলোকে না ক... খ... গ... এগুলোকে ব্যঞ্জনবর্ণ বলে তা ভুলে গেছে। যাইহোক শেষ পর্যন্ত ঠিক মতই শুরু করেছে। ক... খ... গ... ঘ... ঙ... চ... ছ... জ... ঝ... ঞ... ট... ঠ... ড... (মাথা নিচু করে) স্যার আর পারি না। হা...হা...হা... করে স্যারসহ সবাই হেসে উঠল। স্যার বললেন- আমি জানতাম ভুল করবে। শুধু তুমি না ক্লাসের সবাইকে একজন একজন করে যদি আমি জিজ্ঞাস করি তাহলে অর্ধেকের বেশী ছাত্র ভুল করবে। কিন্তু আমি যদি তোমাদের বলি ইংরেজির alphabet গুলো বল তাহলে তোমরা সবাই এক শ্বাসে সব বলতে পারবা। এই হল আমাদের বাংলা আর ইংরেজী শিখার পার্থক্য।
যাইহোক, সেদিন এরকম ছোট ছোট অনেক মজার মজার বিষয় দিয়ে অদ্ভুদ এক ব্যতিক্রমী শাস্তি স্যার আমাদেরকে দিয়েছিলেন। শাস্তি হলেও আমরা সবাই খুব বিনোদন পেয়েছিলাম। অবশ্য যারা শাস্তি পেয়েছিল তাদের অবস্থা ছিল দেখার মত। ঘেমে একটার অবস্থা খারাপ।
জানিনা, স্যার সেদিন এই ব্যতিক্রমী শাস্তির মাধ্যমে আমাদেরকে কি মেসেজ দিতে চেয়েছেন। শাস্তির ভয় নাকি আমাদের ছোট ছোট কমন দূর্বলতাগুলো তুলে ধরা (?)। স্যার সেদিন যেকারণেই শাস্তি দেন না কেন আমার কাছে মনে হয়েছে স্যার আমাদের ছোট ছোট কিছু ভূল তুলে ধরেছেন যেগুলো আমাদের এড়িয়ে চলা উচিত এবং ছোট ছোট কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন যেগুলো পাড়া বা যেগুলো সম্পর্কে জানা আমাদের উচিত ছিল। জানি না, ভুলগুলো জন্য আমরা ছাত্ররা দায়ী নাকি অন্যকেউ। জানি না, এটা কার ব্যর্থতা।
বিষয়: বিবিধ
৩২৯৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন