স্বপ্নালোকের ইন্দ্রজালে
লিখেছেন লিখেছেন দুখাই ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৬:৫৯:১৬ সন্ধ্যা
ফারিহা ক্লান্ত মনে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাল লাগছেনা মোটেও, কি আজগুবি সব থিউরী লিখে রেখেছে– “Sociology students typically spend a great deal of time studying these different theories. Some theories have fallen out of favour, while others remain widely accepted, but all have contributed tremendously to our understanding of society and social behaviour.”
এ সবগুলোকেই অর্থহীন মনে হচ্ছে। থিউরীগুলো যে কে আবিষ্কার করেছিল! হাতের কাছে পেলে কনুই দিয়ে ইচ্ছেমত গুতাতাম। ফারিহা আনমনে দখিনা জানালার দিয়ে তাকাল। আলো আঁধারির এই শান্ত, নিবিড়, ছিমছাম শহরটি বেশ মনোমুগ্ধকর লাগছে। দীর্ঘ একখানা নিঃশ্বাস টেনে নিজেকে হালকা করার ছোট্ট একটা আনমনা চেষ্টা। কাজ, পড়াশুনা, ফ্যামিলিকে সাপোর্ট দেয়া সবকিছু মিলিয়ে আজ কেমন যেন বিষিয়ে উঠেছে ফারিহার মন। বিড়বিড় করে প্রলাপ বকছে সে। হঠাৎ ও টের পেল ওর চোখের কোনে নোনা জল জমাট বেঁধেছে– যেন চাইছে অঝর ধারায় কপলকে ভিজিয়ে দিতে। না ফারিহা এতো অল্পতেই কেঁদে ফেলার মত মেয়ে নয়। তাই নিজেকে সংযত করে আলতো করে চোখটা মুছে নিল। আবারও পড়ায় মনোনিবেশ করার মেকি চেষ্টা– কিন্তু হঠাৎ করেই তার চোখ আটকে গেলে জানালার পাশের পাথ ওয়েটাতে।
আজ সবকিছু কেমন যেন নিথর হয়ে আছে, বাহ্যিক কোন শব্দ তার কানে বাঁজছে না। হৃদকম্পনের ধুকধুক শব্দ ছাড়া সে যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। পাথ ওয়ের দু’পাশ দিয়েই সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান গাছগুলো একে ওপরকে এমনভাবে স্পর্শ করে রেখেছে যেন দূর থেকে হঠাৎ করে তাকালে ঠিক টানেলের মত মনে হয়।
হঠাৎ করেই সে আবিষ্কার করল– পাথ ওয়ের মাঝখান দিয়ে সে হাঁটছে। এক পশলা বাতাস কোথা হতে যেন এসে সবুজ রঙের ম্যাক্সিটা ছুঁয়ে গেল। কালো স্কার্ফ এর সাথে সবুজ রঙের ম্যাক্সিটাতে বেশ মানিয়েছে ওকে। কি অপরুপা সেই দেবী! মনে হচ্ছে ঠিক যেন হৈমন্তী গল্পের নায়িকা হৈমন্তীর মত। দমকা হাওয়ায় সাধারণত অজানা এক উদ্বেগ থাকে, আচমকা একটা ভাব এনে দেয়। কিন্তু ফারিহা কে দেখে যেন মনে হল সে যেন এই দমকা হাওয়ার জন্যেই এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে ছিল। সারা শরীরটাকে মৃদু হাওয়া হালকা করে ছুঁয়ে গেল। অনুভূতিতে নতুন এক মাত্রা যোগ হল। এভাবেই আনমনে হেঁটে চলছে জনমানবহীন রাস্তা ধরে এক পা দু’পা করে। হালকা শীত শীত অনুভূতি হঠাৎ করে ভালোলাগার মানুষের কথা স্মরণ করিয়ে দিল। অজান্তেই সেই মানুষটিকে কল্পনা করে নিল। এখন আর সে একা নয়। মনে হচ্ছে ঠিক পাশেই যেন তার মনের মানুষটি ভালোবাসার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। দুজনায় পথ চলছে– এ যেন প্রণয় সাগরে ক্লান্তিহীন অবিচল সাঁতার কেটে যাওয়া!
সহসাই বেরসিক বাস্তবতা কড়া নাড়ল। আচমকা থেমে গেল ফারিহার পথচলা। আহত পাখির মত কাতর চোখে পিছন ফিরে তাকালো। কোথাও কেউ নেই!
বন্ধ চোখে ফারিহার চিবুক বেয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। আশাহত মনে চোখ খুলে তাকাল ফারিহা । আরে! একি!!
ফাহাদ দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে ফারিহার দিয়ে চেয়ে আছে। ফারিহা কিছু না বলেই ফাহাদ এর দিকে এগিয়ে আসলো। তারা দুজন সামনাসামনি দাঁড়িয়ে। ভ্রুকম্পিত নীরবতা নেমে আসলো ওদের স্বপ্নের পসরায়। ফাহাদ অতিমুগ্ধ নয়নে ফারিহাকে দেখছে। চোখে চোখ পড়তেই ফারিহা লজ্জায় লাল হয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো।
তোমাকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে ঠিক যেন আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যার মত– এই বলে ফাহাদ আবারো চুপ। ফারিহা কাঁদোকাঁদো সুরে বলল– ছেড়ে যাবেনা তো কখনো আমায়?
না কখনো না, মরে গেলেও না!
ফাহাদ দুষ্টুস্বরে বলল– তোমার গালের নরম দুঃখগুলো আমি মুছে দেই?
ফারিহার মলিন মুখ যেন হাসিতে প্রস্ফুটিত হল। ঠিক যেমন প্রস্ফুটিত ফুলের উপর একফোঁটা শিশিরবিন্দু প্রভাতী আলোতে চিকচিক করে। আবারও পথচলা, খানিকটা এগুতেই ঠিক হাতের ডানপাশেই দুটো খরগোশ চোখ ধাঁধিয়ে দিল। কান দুটো খাড়া করে বিনয়ের সাথে গা ঘেঁসে সবুজ ঘাস চিবুচ্ছে। দৃশ্যটা দেখে ফাহাদকে ডেকে বলল– দেখ দেখ কত সুন্দর করে ওরা ঘাস খাচ্ছে। দেখ একজন অন্যজন কে কত যত্ন করে আগলে রেখেছে। এ যেন অনন্তকালের সম্পর্ক, কোন বিচ্ছেদ এটাকে ছিন্ন করতে পারবে না। আমাদের উপস্থিতি যেন তাদের ভীতির কোন কারণ নয়। এ নিবিড় বন্ধন যেন অটুট থাকে অনন্তকাল।
কথাগুলো শেষ করার আগেই সে পাশ ফিরে তাকিয়ে একটু অবাক হল। ফাহাদ তো এখানেই ছিল! কিন্তু কোথায় গেল সে? দৌঁড়ে গিয়ে এপাশ ওপাশ দেখল কিন্তু কোথাও ফাহাদ নেই। আবাক দৃষ্টিতে খরগোশ দুটোর দিকে আনমনে চেয়ে রইল ফারিহা । তাহলে কি ফাহাদ এখানে ছিল না? তাহলে কি সবকিছু শুধুমাত্র স্বপ্নই ছিল? বিশ্বাস হচ্ছে না ফারিহার কোনকিছুই। বুকের একপাশে কেমন যেন ব্যথা অনুভব করল সে। মনের আজান্তেই একা থাকার কষ্টটা কেমন যেন বিষিয়ে তুলতে থাকে।
আপু আপু কি করছো?
ফারিহা তখনো জানালা দিয়ে পাথ ওয়ের দিকে তাকিয়ে। ছোটবোনের ডাকে স্বপ্নের জগৎ থেকে ফিরে আসতে হল।
কি হয়েছে?
মা খেতে ডাকছে বলে ছোট বোনটি দৌড়ে চলে গেল। ফারিহা বইয়ের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলতে থাকল কি অবাস্তব সব ভাবছি আমি! তবুও মনকে বুঝাল সে– ঠিকই আমার রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে টগবগিয়ে আমাকে নিয়ে যেতে আসবে একদিন। কিন্তু সেই একদিন কবে আসবে? রাজপুত্রের জন্য পথ চেয়ে বসে থাকা আদৌ শেষ হবে কি ফারিহা নামের রাজকন্যার?
বিষয়: সাহিত্য
১৩৫৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন