বাবাকে না বলা কথা
লিখেছেন লিখেছেন দুখাই ২০ জুন, ২০১৩, ০৭:৩৫:০৫ সন্ধ্যা
জীবনটা সুখ-দুঃখের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলেও এর বাইরেও একজন মানুষের তাত্ত্বিক জগৎ তার নিজের মাঝেই বিরাজমান। বাস্তবতার রোশানলে আমাদের তাত্ত্বিক মানুষটাকে হারিয়ে ফেলছি প্রতিনিয়ত। সাথে সাথে নিজেকে হারিয়ে ফেলছি চারপাশের মানুষের মাঝে। এর ব্যাতিক্রম ঘটেনি অনু নামের ছোট্ট শিশুর জীবনেও।
অনুর বেড়ে উঠা ছোট্ট একটি ছিমছাম গ্রামে। গ্রামের বুক চিরে বয়ে গেছে আঁকা-বাঁকা সরু রাস্তা। চৌরাস্তার ঠিক তার পূর্ব পাশেই গড়ে উঠেছে বাজার, উত্তরে দিগন্ত ছোঁয়া মাঠ। তার বুকচিরে আনমনে স্বপ্ন ফলায় কৃষক, পশ্চিমে দীর্ঘ হয়েছে গ্রাম। তার ঠিক শেষ প্রান্তে আরম্ভ হয়ছে আর একটি গ্রামের মাথা। এই গ্রামটিকে ঘিরেই ছিল অনুর জীবন। এক পা দু করে অনু বেড়ে উঠতে থাকে, বিচরণ ঘটে আলিতে-গলিতে, আনাচে কানাচে। ক্রমান্বয়ে গ্রামের সব কিছুই তার নখদর্পনে চলে আসে।
অনুর ‘মা’ স্বভাব সলুভে খুবই ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ। বিশ্বের সকল ‘মা’ তার সন্তানের কাছে অনুপম রতন এবং সর্বোত্তম শ্রদ্ধার ভাগীদার। সৃষ্টিকর্তার পরেই যে মায়ের স্থান। অনুও ঠিক একই ভাবে তার মাকে আবিস্কার করেছিল। কারণ তার জীবনের আবিষ্টে তার মা কেবল বিচরন করেছিল। অবুঝ শিশু গুটি গুটি পায়ে ঘুরে ফিরতো এ আঙ্গিনা থেকে ও আঙ্গিনায়। ধুলো বালি গায়ে মুখ লুকাতো মায়ের আঁচলে। মমতাময়ী মা হাজারো কাজের ভিড়ে বুকে আগলে নিয়ে চুমু খেতো কপালে। দুষ্টু বলে আদর করে দিত, মুছিয়ে দিত গা, পরিয়ে দিত নতুন জামা। এভাবে ভালই কাটছিল অনুর জীবনকাল। সুন্দর এ পৃথিবী ঘিরে মা ছিল তার সবকিছু।
সময় চলেছে তার আপন কক্ষপাতে। তারই ধারাবাহিকতায় থেমে নেই অনুর জীবন। অনুর ধিরে ধিরে বেড়ে উঠাটা জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। বুঝতে শেখে জীবনের না জানা অনেক কিছুই। বুঝে যায় মা ছাড়াও তার জীবনে আর একটি মানুষ ছিল। যাকে সবাই বাবা বলে ডাকে। সাময়িক ধাক্কা পেলেও হয়তো সামলে নিয়েছিল নিজেকে। মা ছাড়া যার জীবনে সে অন্য কাউকে স্থান দিতে পারবে না। কি করে পারবে? একটি মানুষকে সে চেনেনা জানেনা তাকে কি করে বাবা বলে ডাকবে? কেই’বা সে মানুষ? কেমনই’বা সে দেখতে? কোথায় সে? এরকম হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে অনবরত। সে বুঝে উঠতে পারতো না কেনইবা তার বাবা থাকবে? অথবা থাকবেই যদি তাহলে কেন নেই?
সময়কাল এভাবেই গড়াতে থাকে। বাবা না থাকার শূন্যতা অনুকে একপেশে করে ফেলে। শয়নে জাগরনে সে শুধুই তার বাবাকে কল্পনা করতে থাকে। বাড়তে থাকা কৌতূহলের জবাব অন্বেষনের জন্য হন্যে হয়ে খুঁজে ফেরে তার বাবার কাছের মানুষগুলোকে যারা অনুর প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে। তার বাবাকে ঘিরে শোনা বাস্তব কাহিনী গুলো অনুর কাছে গল্পের মত মনে হতে থাকে। এ যেন এক মহামনীষীর গল্পের ছায়া তার বাবার জীবনেও প্রতিয়মান। তার প্রতি বাড়তে থাকে প্রাগঢ় শ্রদ্ধা, ভক্তি এবং ভালবাসা।
অনুর অব্যক্ত কথা,
বাবা, কেমন দেখতে আমি তা জানিনা। জানিনা কেনইবা তার এতো অভিমান। কেনইবা আমাকে ছেড়ে চলে গেলো পরপারে। খুব অভিমান হয়, মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে তুমি এতো স্বার্থপর কি করে হলে বলতো? নিষ্পাপ দুধের একটি শিশুকে রেখে শুধু নিজের কথা ভেবে চলে গেলে? ভাবলেনা তোমার ছেলে কাকে বাবা বলে ডাকবে? পারলে বাবা এভাবে এতীম করে ফেলে যেতে?
বাবা না থাকার দুর্বিষহ কষ্ট আমি প্রতি পদে পদে অনুভব করি। বাবার আদর, ভালবাসা, স্নেহ, শাসন কি জিনিস তা আজ অবধি বুঝে উঠেতে পারিনি। এসব কিছুই ধুয়াসে মনে হয় আমার জীবনে। মাঝে মাঝে আনমনে চিৎকার করে বলি বাবা বাবা একবার হলেও তোমার বুকে আমাকে আগলে ধর। জড়িয়ে ধর তোমার সন্তান কে পরম আদরে শক্ত করে যেন ছিটকে যেতে না পারি। শান্ত কর আমার অশান্ত মন, যে মন শুধু তোমার ভাবনায় কাতর। মাখিয়ে দাও বাবা নামের গন্ধ আমার সমস্ত শরীর জুড়ে। সবাইকে জানিয়ে দিই আমি এতিম নয়। আমারো বাবা আছে, সে আমার শ্রদ্ধেয় বাবা। যিনি আজো বেঁচে আছেন আমার সমস্ত স্বত্ত্বাজুড়ে।
আমার বয়স সবে ছয়-থেকে-সাত। কোন কিছু বুঝে উঠার বয়স বা বুদ্ধি কিছুই ছিলনা আমার। এমনি কোন এক সন্ধ্যা লগনে সবাইকে জানান দিয়ে ওপারে পাড়ি জমালেন আমার পরম শ্রদ্ধেয় বাবা। শুধু আমি রয়ে গেলাম অজানা এক ভুবনে, ঠিক যেন নিজের বাঁধানো কবিতায়।
সীমান্তের ওপারে দাঁড়িয়ে বাবা,আমি এই পারে।
দৃষ্টিতো ক্ষণিকের, তবু মৃদু উল্লাস ঝরে
দেখিনি তোমার বদনখানি দু’চোখ ভরিয়া।
বলেছিলে তুমি আসবে ফিরে, অলংকিত করে আঙ্গিনা।
এলে তুমি যখন,সন্ধ্যার লগন তখনি ডুবে গেলো,
কান্নার রোল আকাশে বাতাসে, হাহাকার দেখা দিলো।
ছোট বলে হায়! বুঝিনি কিছু, দেখিনি বাবার মুখ!
বলেনি কেহ, হেয়! বাবা চলে গেলো; কাঁদবিনা কিছুক্ষণ।
ওরা বুঝতে চাইনি, দেখতে দেয়নি, খোঁজেনি আমার ব্যাথা।
তুমি ঐপারে আর আমি এই পারে, হবে কি আবার দেখা?
তুমি দেখো মোরে তারাগুলো হয়ে, আমি বসে ভাবি একা।
এই বুঝি এলে দরজাটা খুলে, কষ্ট ভুলিয়ে কোলে তুলে নিলে।
বাবা তোমার জন্য আজও আমি ব্যথায় কাঁতরাই।
তবুও বুঝলোনা আমার ব্যথিত হৃদয়, এই জগতের সাঁই।
বাবা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি তোমার বদন খানি,
এখনো আছো মহিমান্বিত হয়ে সবার অন্তরে জানি।
গল্পে শুনেছি বাবা’রা ছায়াবৃক্ষের মত সন্তানের মাথার উপর ছায়া হয়ে থাকে সর্বক্ষন। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটেছিল শুধু আমার জীবনে, মাথার উপর মায়ের ছায়া ছাড়া কিছু পাইনি। এ পাওয়াতে যে চরম অতৃপ্তি আছে তা বলছিনা। কিন্তু যখন দেখতাম আমার পাশের বাড়ির ইসলাম চাচা ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরে সবার আগে তার আদরের ছোট্ট ছেলে কে কাছে টেনে আদর করত। সন্তানের পিঁছু পিঁছু হেঁটে ভাত খাওয়াতো। ঠিক বুকের মাঝখানে সন্তানের মাথা রেখে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করতো। মাঝে মাঝে পিতা-পুত্র উভয়ই ঐভাবে ঘুমিয়ে পড়তো। এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আমার কাছে আর একটিও নেই। এমন সুন্দর দৃশ্য দেখে চোখে পানি আসার কথা নয় কিন্তু আমি অনবরত কাঁদতাম। একটা হিসাব মেলাতে কষ্ট হতো, এই নিরেট ভালোবাসা থেকে কেন আমি বঞ্চিত? আসলে মানুষের না পাওয়া ভালোবাসার প্রতি দূর্বার টান থাকে, আমার মনে হয় একটু বেশীই ছিলো, আজও তেমনই করে বয়ে বেড়াচ্ছি। না পাওয়ার কষ্টে মলিন হলেও প্রায়ই আমার সব কষ্ট গুলো শীতল হয়ে যেত হিমসাগরের শান্ত ঢেউয়ের মত। ইসলাম চাচা কঠিন মনের মানুষ হলেও সন্তানদের খুব বেশি ভালোবাসতো। প্রত্যকে বাবা’ই হয়তো একই ভাবে তার সন্তানকে আগলে রাখতে চায়। তার অদ্ভুত কান্ডগুলে খুব ভাবে উপভোগ করতো তার সন্তানরা। আমিও দেখে মজা পেতাম, মনে হত আমার বাবা বেঁচে থাকলে ঠিক এমনি হত। আজীবন ভালোবাসার কাঙ্গাল হয়েও শুধু ভালোবাসাটুকুই অধরা রয়ে গেলো। বাবার বিশেষ ভালোবাসা পাবার জন্য পিয়াসী মন ব্যাকুল থেকেছে। আমৃত্যু হয়তো থাকবে। মাঝে মাঝে একলা চিত্তে ভাবি, পৃথিবীর কঠিন এবং অমোঘ নিয়মগুলো শুধুই কি আমার জন্য?
পাদটিকাঃ অনু নামটি কাল্পনিক হলেও বাস্তবে অনুদের সংখ্যা অনেক। অনুর আজঅব্ধি বলা হয়ে উঠেনি ‘মা তোমাকে খুব বেশি ভালবাসি’ তুমিই তো বাঁচতে শিখিয়েছো, শিখিয়েছো অসাধ্যকে সাধন করতে। অনুর অগ্রজ ছায়া হয়ে আছে বাবার মত, যত চাওয়া তার সবটুকুই বড় ভাই এর কাছে। অনুর তিনটি বোন যাদের ভালবাসায় অনু আজো বেঁচে আছে। স্মৃতিকাতরতায় পরাজিত না হয়ে স্বপ্ন দেখে এক উজ্জ্বল আগামীর।
পুনশ্চঃ বাবা তুমি বেঁচে থাকলে তোমাকে একটা কথা বলার সুযোগ পেতাম, বাবা তোমাকে খুব খুব খুব বেশী ভালবাসি।
বিষয়: Contest_father
৪৪৯৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন