হিজল তলার শীত

লিখেছেন লিখেছেন অকপটশুভ্র ১৪ জানুয়ারি, ২০১৩, ০২:৪৯:৫৭ দুপুর



শীতকালটা কি আনন্দের নাকি কষ্টের! সব কিছু গোল্লায় যাক! বার্ষিক পরীক্ষা শেষে লম্বা ছুটি, মিষ্টি-রোদ, বৃষ্টিহীন দিন আর পিঠেপুলির মনমাতানো উৎসব, সব মিলিয়ে শীতকালের দিনগুলো জীবনের সেরা সময় গুলোর মধ্যে অন্যতমই হয়ে থাকবে। এই শীতকেই মিস করছি গত পাঁচ বছর ধরে, এখন অবশ্য শীতকে বেশ ভয় লাগে। এসির বাতাসটা হালকা কড়া হলেই হাঁচির বন্যা বইয়ে দেই, ক্লাসে বসে এসির বাতাসের ঠাণ্ডায় যখন পা জমে যায় তখন পায়ের আঙ্গুলের রগে টান পড়ে, সর্বকনিষ্ঠ আঙ্গুল দুটো বেঁকে যায় এক দিকে, তখন এক হাঁটু ভাঁজে করে অন্য পায়ের পাতা রেখে তা দেই, মুরগী যেমন ডিমে তা দেয় তেমনি, এভাবেই তৎক্ষণাৎ সমস্যার সমাধান করতে হয়। মাঝে মাঝে ক্লাস থেকে বেরিয়ে মাথার চাঁদি-ফাটা রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, এক্ষেত্রে লেকচার শোনা একেবারেই গৌণ। নিজে বাঁচলে বাপের নাম টাইপের অবস্থা। কিন্তু এগুলো-তো ইদানীং কালের সমস্যা, বয়স বাড়তে বাড়তে এরকম হাজারটা স্বাস্থ্যগত সমস্যা ঝুলিতে জমা পড়বে, একদিন ঠুশ করে যাবো মরে। সোজা কথায় যাকে বলা যায় A journey headed for death. তবে সেই উচ্ছল দিনগুলোতে এই শীতের আবহ যে কি আনন্দের বারতা নিয়ে আসতো তা সবারই জানা।

বিদেশী বন্ধুদের যখন বলি আমার দেশে সবকটি ঋতুই আছে তখন ওরা চোখ কপালে তুলে ফেলে। ওরা বিশ্বাসই করতে পারে না যে “এমন দেশও আবার থাকতে পারে নাকি!” ওদের এই ভাবখানা দেখে আমার আনন্দ হয়, গর্বে বুক ফুলে ওঠে। কারণ শুধুমাত্র এই কথা শুনেই তারা স্বগতোক্তি করে “একদিন তোমাদের দেশে বেড়াতে যাবো”। আমার দেশকে নিয়ে গর্বকরারমতো যতগুলো দিক ছিলো তার সবগুলোই কর্দমাক্ত হয়েছে একেবারে যাচ্ছেতাই হালে, কিন্তু স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার বদান্যতায় তাঁর আপন হাতে যে গৌরবময় প্রাকৃতিক গৌরবের আধার গুলো আমাদের দিয়েছেন তার মধ্যে এই ষড়ঋতুর গৌরবটিই বোধ হয় এখনও রয়েছে স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল। ওদের যখন বলি আমাদের দেশের উইন্টারটা ক্যানাডা বা সাইপ্রাসের মতো বেরসিক নয় বরং উপভোগ্য তখন ওরা জাস্ট লাফিয়ে ওঠে আগ্রহ দেখায় “একবার যেতে হবে তো!” তখন আমি মনে মনে বলি “আসিস না শালা কোনদিন, ঢাকার জ্যামে একবার পড়লে দিবি তো উলটো দৌড়”।

যাইহোক শীতের কথা বলছিলাম, শীতের কিছু কিছু দিক সত্যিই খুব মিস করি। সবার মতোই সে তালিকায় শীতের বর্ণালী পিঠেপুলির কথা আসবে সর্বাজ্ঞে। আমাদের গ্রামের বাড়ীর কাচারি ঘরের পাশেই একটা বড় মাছের ঘের, শীতের শুকনো মৌসুমেও সে ঘেরে বেশ টলটলে পানি থাকতো যদিও তা বর্ষার তুলনায় অনেক কম। ঘেরের পাশেই একটা হিজল গাছ ছিলো, সাত-সকালে ঘুম থেকে উঠে ঐ গছের গোরায় রোদ পোহাতে বসতাম সবাই। পুব দিকের খোলা দিগন্ত থেকে রোদ এসে ঠিক হিজল গাছের গোরায় এসে পড়তো, হালকা কুয়াশার চাদরের ফাঁক গলে সোনালী রোদের বিচ্ছুরণ, তার উপর সকালের মিষ্টিরোদের সম্মিলনে সেকি হৃদয়-কাড়া আলোকচিত্রের অবতারণা হতো তা ফুটিয়ে তোলা আমার ক্ষুদ্র শব্দভাণ্ডারের সাধ্যির শত-ক্রোশ বাইরে ব্যপার-সেপার। তাই আমি এখানেই ক্ষান্ত দিচ্ছি। বর্ষায় হিজল ফুলের ঝুলে থাকা লম্বা লম্বা লতা থেকে খসে খসে পাপড়ি গুলো ঘেরের নিথর পানিতে বিশাল জায়গা জুড়ে বিস্তৃত হয়ে ভেসে থাকতো, সে এক অন্যরকম দৃশ্য। আমাকে যদি বলা হয় পৃথিবীর কোন দর্শনীয় স্থানের সাথে এর তুলনা চলে? আমি বলবো ঐ দৃশ্যের সাথে আমি কোন কিছুরই তুলনার সাহস রাখি না, শুধু কৃতজ্ঞতায় সেই মনিবের কাছে মাথা নত করি, যার ইশারায় সৃষ্টির পরতে পরতে সুন্দরের এতো লালিমা। সেই সকালগুলোতে ফিরে যেতে কল্পনা ও সৃতির অদৃশ্য দরজা ছাড়া অন্যকোন উপায় যদি থাকতো, আমি সারা দুনিয়াকে বাজী ধরে ফিরে যেতাম সেখানে। ফিরে যেতাম সেই সাত সকালের কুয়াশার কোলে যা প্রকৃতির ভালোবাসার চাদর হয়ে ঘিরে ধরতো আমায়, কনকনে ঠাণ্ডা তাঁর গুরুগম্ভীর শাসনে দমিয়ে রাখতো আমার দস্যিপনাকে, কোমল ও উষ্ণ সেই সোনালী রোদ মায়ের মমতার আঁচল হয়ে থাকতো জড়িয়ে, গাছের সেই প্রকাণ্ড পত্র-পল্লব নীড় হয়ে ধরা দিত আমার কাছে, উন্মুক্ত সবুজ দিগন্তটা যেন স্বপ্ন সুখের দিকে ছুটে চলা মেঠো পথ , আর বর্ষায় ঘেরের পানিতে ঝরে পরা হিজল ফুলের সুবিশাল সেই বর্ণালী বিছানাটা হতো শান্তির আলপনা। আর কী চাই জীবনে!

ঢাকা থেকে শীতের ছুটিতে গ্রামে যাওয়া হতো গোটা পরিবার একসাথে, সাত-সকালে ঘুম থেকে উঠেই হাত-মুখ ধুয়ে, অজু করে ফজর পড়ে ঘরে ফিরতে ফিরতেই দাদী, আম্মু, ও চাচীরা বসে যেতেন মুড়ি-মুড়কী তৈরির কাজে। সব কিছু রেডি হতে হতে সূর্যের উঁকি-ঝুঁকি শুরু হয়ে যেতো পুর্বদিগন্তে। থালা-বাটিতে করে মুড়ি-মুড়কী নিয়ে চলে আসতাম সেই হিজল তলায়। মুড়ি-মুড়কী বলতে কখনও নারকেল আর চিনির সাথে মুড়ি মিশিয়ে খাওয়া, কখনও পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে ঝাল মুড়ি আবার কখনও চিড়া ভাজা দিয়ে নারকেল ও গুড় মিশিয়ে খাওয়া। খেতে খেতে আমরা বাচ্চারা কত গাল-গল্প জুড়ে দিতাম তার কোন ইয়ত্তা নেই। এদিকে আমরা যখন মহোৎসবে মত্ত সে সময়ে রান্না ঘরে শুরু হয়ে যেতো আরেক উৎসব, পিঠেপুলি বানানোর জোয়ার চলতো সেখানে। ঠিক সকাল দশটার আগেই পিঠেপুলির আয়োজন সাজানো হয়ে যেতো খাবার টেবিলে। এভাবেই খাওয়া থেকে খাওয়া দিয়েই শীতের নিত্য সকালের হত শুরু। প্রায়শই আবার মেঝ চাচার হাত ধরে চলে যেতাম গ্রামের টং দোকানে, সেখানে তিনি গরম গরম পরটা কিনে খাওয়াতেন বুটের ডাল দিয়ে। এর পর গরম গরম চা, আহ! সুখ বলতে নাকি কিছুর অস্তিত্ব নেই, আমি বলি আছেরে ভাই আছে, সুখ আলবৎ আছে। সুখ আছে আমাদের ফেলে আসা অতিসাধারণ জীবন যাপনে, সুখ আছে আমাদের মাটির গন্ধে, সুখ আছে আমাদের সরলতায়, সুখ আছে আমাদের অল্পতে তৃপ্ততায়। কিন্তু আমরা তা বহু পেছনে ফেলে এসেছি, তাই বলি “পৃথিবীতে সুখ বলে কিছু নেই”। এটা মিথ্যে ডাহা মিথ্যে। এই বুকে হাত দিয়ে বলছি, আজকের KFC, ম্যাকডি আর নান্দোসের রেস্টুরেন্টে বসেও আমি সেই সুখ পাই না, যে সুখ পেয়েছি হিজল তলায়, আমার গ্রামের সেই টং দোকানে। ম্যাকডির ফ্রেঞ্জ-ফ্রাইস ঘরে তুলে রাখুন তিন মাসেও পচবে না, কিন্তু ঐ টং দোকানের ডাল তুলে রাখুন একদিনেই পচে যাবে। ম্যাকডির খাবার নিজে পচে না আমাদের পচায় আর আমার গ্রামের টং দোকানের খাবার নিজে পচে যায় তবে মানুষকে পচন থেকে বাঁচায়।

শীতে ঢাকার দৃশ্য গ্রামের চাইতে ঢের আলাদা, ইট-পাথরের দৌরাত্ম্য শীতের জেঁকে বসাটা খুব একটা না জমলেও আনন্দের কিন্তু কিছু কমতি নেই। এলাকায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভাপা পিঠা আর চিতল পিঠার ছোট ছোট দোকান বসে যায়, এর পাশাপাশি গরম গরম হালিম, চটপটি আর চায়ের কদর এই শীতে বেশ বেড়ে যায়। আমাদের তালতলা মার্কেটের পেছনে রাস্তার পাশে একটা ভাপা পিঠার দোকান বসতো (এখন বসে কিনা জানি না), ঐ লোক এক সাথে অনেক গুলো চুলো দিয়ে প্রচুর ভাপা পিঠা বানাতেন। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ লাইন দিয়ে এখান থেকে ভাপা পিঠা নিয়ে যেতো। এমন কি সমাজের ধনী শ্রেনীর লোকজনও দামী ব্রান্ডের গাড়ী হাঁকিয়ে এসে এখান থেকে ভাপা পিঠা নিয়ে যেতো। এতে যথারীতি বঞ্চিতের দলে আমরা ছাপোষা মধ্যবিত্তরাই, হাতে গোনা কয়েকটা পিঠার জন্য লাইন ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। এদিকে গাড়োয়াল বড়লোকেরা অনেক টাকার পিঠা কিনতেন বলে দোকানী তাদের অগ্রাধিকার দিতেন বেশী।

তবে শীতে আমার ঘরের চেহারাটা আমার কাছে বেশী উপভোগ্য ছিলো, মা শীতের পিঠা বানাতেন প্রায়শই। মা আমার বহুরোগে আক্রান্ত একজন গৃহিনী, শরীরে কুলাতো না তার পরেও আয়োজন করে পিঠা বানাতেন। পিঠা বানাতে গিয়ে আটা গুড়ি দিয়ে যখন প্রস্তুতি নিতেন, আমি বলতাম “আম্মা! আজকে তো তাইলে দারুণ পিঠা হবে” মা বলতেন “ আগে আগেই কথা বলিস না, আগে আগে মন্তব্য করলে নাকি পিঠা হয় না”। আমি খুব বিশ্বাস করতাম, আর কথা বলতাম না। এর পর মা যখন পিঠা বানাতে বসতেন তখন শুরু হতো আসল মজা। রান্নার সময় মায়ের পাশে বসে থাকার একটা অভ্যাস আমার ছিলো। পিঠা বানানোর সময় সেটা কমই করতাম, বার বার উকি-ঝুঁকি দিয়ে দেখে যেতাম কেমন পিঠা হচ্ছে। আম্মু যখন পিঠা বানিয়ে আলাদা পাত্রে তুলে রাখতেন আমি গিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। কিছুক্ষণ পরেই সুযোগ বুঝে টুক করে একটা পিঠা নিয়ে সোজা চলে আসতাম। মা বাধা দিতেন না, শুধু বলতেন “খাওয়ার সময় কিন্তু যে কয়টা পিঠা নিয়েছিস সেকয়টা কম পাবি তুই”। কিন্তু খাবার সময় মা সবাইকেই সমান সমান ভাগ দিতেন। সেই দিনগুলোর মধ্যে আনন্দ ও উপভোগের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিলো। এখন এগুলো খুবই মিস করি।

শীতে আম্মুর সাথে যুদ্ধ হতো গোসল করা নিয়ে, ঠাণ্ডা পানিতো দুরের কথা গরম পানি দিয়েও গোসল করতে চাইতাম না। একদিন গোসল করলে আরেকদিন করবো না এইটা নিশ্চিত। এইটা ঠেকানোর সাধ্যি কারও নাই, তবে আম্মুর বকা-ঝোঁকাও ছিলো অবধারিত। গোসল করতে গেলে বাথ-রুমে গিয়ে বালতির পানির দিকে নিবিষ্টমনে তাকিয়ে থাকতাম, আর ভাবতাম গায়ে কি পানি ঢালবো নাকি ঢালবো না। আমি আবার বালতি থেকে পানি কেটে কেটে গোসল করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। ঝর্না ছেড়ে দিয়ে গোসল করে আমার পর্তা হয় না, কেন যেন মনে হয় গা ভিজেইনি। গোসল করতে গিয়ে কতবার যে মগে পানি নিয়ে মাথার উপর তুলেও শেষ পর্যন্ত আর ঢালা হতো না তার কোন হিসেব নাই। অনেক সময় এমনও করেছি, আম্মুকে দেখিয়ে দেখিয়ে বাথ-রুমে ঢুকেছি, কয়েকবার পানি ঢালার শব্দ করে কাপড় চোপড় চেইঞ্জ করে জাস্ট মাথাটা ভিজিয়ে চলে এসেছি। মা তো ভাবতেন আমি গোসল করেছি। নামাজের আগে অজু করার সময়ও পানি ধরার আগে নানা চিন্তা-ভাবনা করতে হতো। এক্ষেত্রে আমার ষ্ট্রাটেজি ছিলো এক অজুতে যত বেশী ওয়াক্ত নামাজ পড়ে নেয়া যায় ততোই ভালো।

ফজরের সময় সমস্যা হতো বেশী, শীতের কারণে উঠতে মন চাইতো না, আম্মু বার বার এসে ডেকে যেতেন, শেষ পর্যন্ত এমনও হতো যে লেপটা টেনে নিয়ে মা ফ্যান ছেড়ে দিতেন ফুল স্পীডে। এর পরতো ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তরই থাকতো না। এভাবেই মায়ের উসিলায় নামাজটা পড়া হতো।

কিন্তু একটা বিষয়, আমি যখন শীতে আমার উপভোগ্য দিক গুলোর কথা বলছি ঠিক তখনই দেশের বাস্তুহারা ও গরীব জনমানুষ এতটুকু উষ্ণতার অভাবে ঠুকে ঠুকে মরছে। খুব কম মানুষই তাঁদের পাশে দাঁড়াচ্ছে। অথচ আমাদের প্রত্যেকেই যদি তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসি তাহলেই কেবল একটি সুন্দর সমাজের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। স্বপ্ন দেখতে যেহেতু বিশেষ কোন খরচ-পাতির দরকার হয় না সেহেতু এদেশে স্বপ্ন দেখার ও স্বপ্ন দেখানোর লোকের অভাব নাই। কিন্তু স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে যেহেতু বিপুল ত্যাগ-তিতিক্ষা ও খরচ-পাতির দরকার হয় সেহেতু সেক্ষেত্রে কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের বুঝতে হবে স্বপ্নের ঘি বা গল্পের ঘি কখনও পরিমাণে বাধা মানে না কিন্তু বাস্তবতার ঘি এতটুকু একটি কৌটাতেই আটকে যায়। এখন এই বাস্তবতার ঘি কজন ঢালতে রাজি আছেন সেটাই হল প্রশ্ন। শীত সকলের জন্যই উপভোগ্য হোক, আমার হিজল তলার শীতের মত বা তারচেয়েও বেশী।

বিষয়: বিবিধ

১৬৭৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File