তাসাওউফ ও রাজনৈতিক ইসলামঃ এবং আমাদের খাজকাটা কুমিরের রচনা
লিখেছেন লিখেছেন অকপটশুভ্র ১২ মে, ২০১৪, ০৮:৪০:১২ রাত
তাসাউফ নিয়ে কোনও এলার্জির অবকাশ আছে কি? সোজা কথায় এলার্জির অবকাশ নেই। আবার এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে তাসাউফের গ্রেটার অংশটা চরম ভাবে বিষাক্ত হয়ে গেছে। প্রমাণ হিসেবে আপনার আশে-পাশের পীর মুরশিদ ও খানকাগুলো ভিজিট করে আসতে পারেন। অধিকাংশেই পাবেন শিরকের নগ্ন ছড়া-ছড়ি। এর মানে হল পৃথিবীর আনাচে কানাচে এখনও তাসাউফের পরিশীলিত রূপ থাকলেও থাকতে পারে। এরকম পরিশুদ্ধ কোনো সূফীর কথা আপনার জানা থাকলে সেটার প্রচার করতে পারেন। কিন্তু আপনার পছন্দের সূফীর চিন্তা-ধারা প্রকাশ করতে গিয়ে গরুর রচনা লিখতে গিয়ে গরুকে পানিতে নামিয়ে কুমিরের রচনা লেইখা ফেইলেন না। এই খাজকাটা খাজকাটা টাইপের ফালতু গান গেয়ে কজনকে বিভ্রান্ত করবেন? আপনাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দীনতা দেখলে বড় দুঃখ হয়।
পশ্চিমাদের অর্থায়নে এবং সেক্যুলারদের বায়াসড গবেষণা উপর ভিত্তি করে মিডিয়ার সহযোগীতায় বিশ্ব ব্যাপী তাসাওউফ ও শারিয়া ইসলামকে (যেটাকে আপনারা পলিটিক্যাল ইসলাম বলে ঘৃণা করতে শিখেছেন) মুখোমুখি দাড় করিয়ে দেয়া হয়েছে অনেক আগেই। নিজেদেরকে পরিচ্ছন্ন ইমানদার হিসেবে প্রমাণ করার লোভে এবং সে সুযোগে অন্যদেরকে ভ্রষ্ট জ্ঞান করে তাদেরকে আস্তা-কুড়ে নিক্ষেপ করার পরম আত্মতুষ্টির লোভে পড়ে অনেক তাসাউফ পন্থি সেগুলোকে আহার্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন। নিজেদের কোনও চিন্তা গবেষণার মুরদ না থাকায় স্বমতের অস্তিত্বের লড়াইয়ে ঐসকল ম্যানিপুলেটেড গবেষণা থেকে অনেক কপি-পেস্ট মারতে হয়েছে। This is called the lazy scholarship. গবেষণা ও জ্ঞানের জগতে এই অলসতার কারণে তাসাউফকে এখন কিছু কমন অতিমানবীয় কেচ্ছা-কাহিনীর আঁচল ধরে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। যার অনেক কেচ্ছা-কাহিনীই হাস্যকর ও রেফারেন্সহীন। এমনকি এমন অনেক কাহিনী আছে যার মধ্যে শিরকের ব্যাপারগুলো দিবালোকের মতো স্পষ্ট। অথচ তাসাউফ পন্থি অনেক তরিকাই শারিয়া ইসলাম নিয়ে প্রকাশ্যে কাজ করছেন। রাজনীতিও করছেন।
পলিটিক্স ক্যালকুলেটর নয় যে সব সময়েই দুই যোগ দুই সমান চার দেখাবে। সেজন্য কখনই রাজনীতিতে আপনি যেকোনো প্রিন্সিপ্যালের ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট প্রয়োগ দেখেন না। কারণটা খুব সোজা, ব্যক্তি জীবনের পরিধি সংকুচিত সেজন্য আপনার আমার ক্ষেত্রে অনেক কিছুই খাপে খাপে মিলে যায় আবার অনেক কিছু মিলেও না। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিধি ব্যাপক সেখানে চলে অপারচ্যুনিটি কষ্ট নিয়ে চিন্তা ভাবনা। সিধ্যান্ত সেখান থেকেই আসে। যার কারণে আপনি যেটাকে সঠিক মনে করেন সেটা অন্যের কাছে সঠিক মনে হয় না। সুফিইজম আত্মা নিয়ে কাজ করে, সেজন্য সেখানে স্রষ্টার সাথে বান্দার সম্পর্কের লেভেল উন্নত করার প্রচেষ্টা চলে। এইখানে ব্যাপারটা ওয়ান বাই ওয়ান। বান্দা ও স্রষ্টা। সেজন্য সুফিইজমে বৈরাগ্য বাদের যত্রতত্র আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়। কারণ সে আল্লাহ ও বান্দার বাইরে চিন্তা করতে নারাজ। কিন্তু রাজনীতি কাজ করে রিলেটিভ এবং কম্প্যারেটিভ ফ্যাক্ট নিয়ে। এখানে নেগোসিয়েশন আছে, এখানে পলিসি মেকিং আছে, এখানে ডিসট্রিবিউশন আছে এবং রাজনীতির প্রত্যেকটি ডাইমেনশনের সাথে ব্যক্তি শুধু নয় বরং বিভিন্ন ধরণের সমমনা ও বিপরীত মনা গোষ্ঠী জড়িয়ে থাকে। সেজন্য এখানে Greater loss বনাম Lesser loss এর হিসাব কষতে হয়। যার কারণেই শারিয়া যারা পড়েন তারা মাক্বাসিদ আশ-শারিয়াও পড়েন। মূলত রাজনীতির জায়গাটা শক্ত নার্ভ সম্পন্ন ক্ষুরধার মেধাবীদের স্থান। সোজা বাংলায় ইসলামি রাজনীতির হাকিকত বুঝতে হলে মাথায় সত্যিকারের মগজ থাকতে হয়।
সুফিইজমের মানবিক ও আধ্যাত্মিক কনসেপ্টকে ভিত্তি করে এবং বিভিন্ন সময়ের মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনকে উপজীব্য করে মানবিক আবেগ জড়িয়ে একধরণের সেক্যুলার ও ওরিয়েন্টালিষ্ট গবেষক ইসলাম ও মুসলমানদেরকে দুই ভাগে সংজ্ঞায়িত করেছেন। একভাগের নাম দিয়েছেন সুফি ইসলাম আর অন্যভাগের নাম দিয়েছেন পলিটিক্যাল ইসলাম। ইসলামের জ্ঞান ও গবেষণায় উদাসীন থাকায় উভয় পক্ষেরই অনেক লোক পরস্পর বিরোধী অবস্থানে নেমে পড়েন। যা আজও বিদ্যমান দেখতে পাচ্ছি। অবশ্য রাজনীতির ব্যাপারে সুফিদের উদাসীনতা বাংলার ইতিহাসে নতুন নয়। তাদের উদাসীনতা লক্ষ্য করেই শাহ ওয়ালি উল্লাহ দিহলাওয়ী (র) কলম হাতে তুলে নেন এবং তিনি সে সময়ে তাসাওউফের সংস্কার নিয়ে ব্যাপক কাজ করেন। ১৭৪০ থেকে তৎ পরবর্তী সময়ে শাহ ওয়ালি উল্লাহ দিহলাওয়ী (র) রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ নীতি নিয়ে যে সকল গবেষণা কর্ম রেখে গেছেন তা কল্পনাতীত। উল্লেখ্য শাহ ওয়ালি উল্লাহ দিহলাওয়ী (র) ছিলেন হযরত ওমর (রা) এর বংশধর। শাহ ওয়ালি উল্লাহ দিহলাওয়ী (র) এর পরে তার সুযোগ্য সন্তান শাহ আব্দুল আযীয দিহলাওয়ী (রহ) তার বাবার নলেজ মুভমেন্ট কে আরও অগ্রসর করে নিয়ে যান। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রথম পুরো ভারত কে "দারুল হারব" হিসেবে ঘোষণা করেন। এর পরে আসেন সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ), তাঁর আন্দোলনকে ইতিহাসে ওহাবী আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অনেক ইতিহাসবিদ এটিকে ওহাবী আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত করার পক্ষপাতী নন, তারা মনে করেন যে ওহাবী আন্দোলন বলে এটিকে একটি বায়াসড ধারণা দেয়ার চেষ্টা হয় মাত্র, মূলত এটি ছিল একাধারে ইসলামী ও আযাদি আন্দোলন । সূফী নুর মুহাম্মদ নিযামপুরী, যিনি পশ্চিম বংগের বিখ্যাত পীর শাহ সূফী ফতেহ আলীর তাসাওঊফের শিক্ষক ছিলেন। সূফী নুর মুহাম্মদ নিযামপুরীও সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ) এর সাথে ইসলামী ও আযাদি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। (সুত্রঃ বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস)
এভাবে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে এদেশের ও ভারতীয় উপমহাদেশের মাটিতে ইসলামের প্রাণ পুরুষরা যেমন তাসাওঊফের নামে সবাই খানকা কেন্দ্রিক হয়ে থাকেন নি তেমনি তথাকথিত পলিটিক্যাল ইসলামের নামে কেউ তাসাওউফকে বর্জন করেন নি। কিন্তু ইতিহাস জ্ঞান হীন এই প্রজন্মের মধ্যে একটা চরমতম কূপমণ্ডূক টেন্ডেন্সি দেখা যায় যে কিভাবে পশ্চিমা ও ওরিয়েন্টালিষ্টদের চাপিয়ে দেয়া বিকৃত গবেষণার উপর ভিত্তি করে ইসলামি শারিয়া কে পলিটিক্যাল ইসলাম নামে আখ্যায়িত করে পদে পদে বিষোদগার ছড়ানো যায়। সুফিইজমের গুণগান গাওয়ার জন্য গরুর রচনা লিখতে গিয়ে গরুকে পানিতে নামিয়ে কুমিরের রচনা লিখে ফেলা নিতান্তই অজ্ঞতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক দীনতার বহিঃপ্রকাশ। তবে আমি আশাকরি এগুলো বন্ধ হবে এবং এও আশাকরি যে আমাদের মধ্যে নুন্যতম জ্ঞান চর্চা ও চিন্তার প্রতিফলন ঘটবে।
বিষয়: বিবিধ
১৬৮৬ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যাতে সবাই প্রকৃত ইসলাম ভুলে যাই।
আমাদের মুখে ফিডার দিয়ে রাখা হচ্ছে।
প্রকৃত ইসলামকে পলিটিক্যাল ইসলাম বলে
প্রপাগান্ডা চালিয়ে যা্চ্ছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন