আমার নীড় বদলের অশনি সংকেত
লিখেছেন লিখেছেন অকপটশুভ্র ২৯ এপ্রিল, ২০১৪, ১১:৪৪:১৪ রাত
সেই ছোট বেলায় একটা ছড়া শিখেছিলাম। বাবুই পাখি আর চড়ুই পাখির স্ব স্ব নীড় নিয়ে বিতর্ক। শেষ অবধি সেই বিতর্কে বাবুই পাখির খড়কুটোর নীড়টাই জিতে নিয়েছিলো বিজয়ের নিশান। একই সময়ে চাচাদের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় চাচা, মেঝ চাচা “অ-নে-ক” টাকা রোজগারের জন্য মালয়েশিয়া চলে আসেন। মালয়েশিয়া থেকে তিনি ফিরে আসতে আসতে আমি অনেক বড় হয়ে যাই। আমি তখন মেট্রিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। মালয়েশিয়া থেকে এসে চাচা বলেছিলেন সে দেশের রাস্তা এতো পরিচ্ছন্ন যে ভাত রেখে খাওয়া যাবে। সে দেশের উন্নতির কথা হা হয়ে শুনতাম। মেঝ চাচা চলে যাবার কিছুদিন পরে ছোট চাচা পাড়ি জমান সৌদি আরবে। সেখানেও নাকি উন্নতির জয়জয়কার। দাদু ও আব্বু হজ্ব করে এসে বলতেন সে কথা। ছোট চাচা ছুটিতে বাড়ি এলে শোনাতেন উন্নত বিশ্বের গল্প। তাছাড়া তদ্দিনে আমি খবরের কাগজের পোকা বনে গেছি, বাসার পত্রিকাটা পড়ে অনেক দূর চলে যেতাম দেয়ালে সাঁটা পত্রিকা পড়তে। পত্রিকা থেকে জানতাম উন্নত বিশ্বের কথা।
উন্নত বিশ্বের সেই দেশগুলোর তুলনায় আমার দেশ খড়কুটোর দেশই বটে। তবুও বাবুই পাখির মতো আমার খড়কুটোর দেশটা ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করতো না। কল্পনাতেও চিন্তা করতাম না যে আমি বিদেশে কখনও লম্বা সময়ের জন্য থাকবো। তাছাড়া ক্লাস ফাইভ থেকে হোস্টেলে থাকতে থাকতে ঘরে ফেরার তীব্রতা আমাকে কাবু করে ফেলেছিল। মেট্রিক শেষ করে ভর্তি হলাম বাসার কাছেই এক কলেজে। শুরু হল বাসায় থাকা, আমার ঘরে ফেরা হল। সাত বছর পর। কলেজ পাশ করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য যখন ঘুরছি তখন আব্বুর কঠিন সিধ্যান্ত এলো। মালয়েশিয়ায় কি একটা ইউনিভার্সিটি আছে, সেটাতে এপ্লাই করতে হবে। এপ্লাই করা নিয়ে আমার কোনও মাথা ব্যথা ছিল না। কারণ আমার “আত্মবিশ্বাস” ছিল যে বিদেশের কোনও ইউনিভার্সিটিতে আমি টিকবো না। তাই বেশি উচ্চবাচ্য না করে আব্বুর কথামত এপ্লাই করে দিলাম। কিন্তু কিভাবে যেন অফার লেটার চলে এলো, সাথে স্টুডেন্ট পাস। এই দুটো পত্র দেখে আমার কলিজায় মোচড় দিয়ে উঠলো। ভাবতেই কষ্ট লাগছিলো যে এদেশটা ছেড়ে চলে আসবো। ইনিয়ে-বিনিয়ে আব্বু আম্মুকে অনেক করে বুঝাতে চাইলাম বুঝল না কেউ। সরা সরি যুক্তি দিয়ে কতো করে চেষ্টা করলাম, কাজ হল না।
যেদিন বাসা থেকে এয়ারপোর্টের উদ্দেশে রওনা হই সেদিন আমার কান্না দেখে আব্বু বলেছিলেন “মালয়েশিয়া হল এখন ঢাকা-চিটাগাং আসা যাওয়ার মতো সোজা, এতো কান্না-কাটির কি আছে? বছর বছর এসে ঘুরে যাবি। আর তুই কি একেবারে চলে যাচ্ছিস? মাত্রতো চার-পাঁচটা বছর, এর পরেতো চলেই আসবি”
আজ পাঁচ বছর নয়, সাত বছর হয়ে গেলো। অনার্স শেষ, মাস্টার্সও শেষ। দেশে ফেরার মোক্ষম সময়। কিন্তু আব্বু ফোন করে বার বার একটা কথাই বলেন “দেশে আসার নামও নিবি না, ওখানেই পিএইচডি করার চিন্তা কর। দেশের যা অবস্থা কোথাও চাকরি দিবে না ওরা। সুযোগ পেলেই জেলে পুরে রাখবে। অহরহ গুম খুন হচ্ছে দেশে... এইভাবে দেশে না ফেরার পক্ষে আব্বুর যুক্তি চলতেই থাকে। গতকাল এক ফ্রেন্ড জানালো, দোস্ত দেশে আসিস না ভুলেও, ওখানেই কিছু একটা করতে চেষ্টা কর। আমি বললাম কেন? ও বলল সার্টিফিকেটে মাদ্রাসার নাম থাকলেই হল কোনও চাকরি পাবি না। এ পর্যন্ত বহুত কেইস দেখেছি... একই কাহিনী। সেদিন আব্বুও কথা প্রসঙ্গে বললেন জামায়াত-শিবিরের সাথে কোনও রকম সম্পর্ক টের পেলেই হয়েছে, চাকরি তো দুরের কথা! রক্ত চুষে খাবে।
একসময় ভাবতাম কিভাবে মানুষ দেশ ছেড়ে বহু বছর বিদেশে পড়ে থাকে। কিন্তু যখন আমাকেই থাকতে হল তখন এটাকে স্বাভাবিকই মনে হল। তার পরে ভাবতাম মানুষ কেন নিজের দেশের নাগরিকত্ব বদলে অন্যদেশের নাগরিকত্ব নিতে চায়। আজ মনে হচ্ছে খুব স্বাভাবিক, হয়তো আমিও বাধ্য হবো পাসপোর্ট টা চেঞ্জ করে ফেলতে। কিন্তু স্থায়ীভাবে বিদেশে সেটেল হয়ে যাওয়াকে সেই প্রথম থেকেই অসম্ভব মনে হতো, এখনও মনে হয়। ভাবতেই পারিনা এটা। কিন্তু কি আর করা, বাংলাদেশ তো আর এখন আমার দেশ না, এটা থাবা বাবার দেশ, ইমরান সরকারের দেশ, মুজিব সৈনিকদের দেশ। আমাকে হয়তো অন্যকোনও নাগরিকত্বই খুঁজতে হবে। মানসিক ভাবে বিশ্বাস করতে চেষ্টা করতে হবে “আমি বাংলাদেশি নই, সেখানে আমার কোণও অধিকার নেই, বাংলাদেশ আমার নয়... এভাবে আস্তে আস্তে একদিন হয়তো সব সয়ে যাবে। আল্লাহ না করুন, যদি সত্যিই এমন হয়েই যায় তাহলেও কামনা থাকবে বাংলাদেশ সুখে থাকুক। সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক।
বাইদ্যাওয়েঃ অনেক লম্বা সময় পরে ব্লগে এলাম। নতুন কাউকেই হয়তো চিনবোনা, পুরোনো অনেকেই হয়তো নেই। তবুও কেমন আছেন সবাই ?
বিষয়: বিবিধ
১৫৩৭ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পূরণো সে দিনের কথা- [এসবিব্লগে/বার্তায়]
সে কি ভোলা যায়...... :D/
আজ দেখা যদি হলো সখা
প্রাণের মাঝে আয়...
আপনি কোন কনফারেন্সে যাবেন, তিন মাস আগে থেকে ভিসার জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। ভালো জব খুঁজবেন, স্পনসরশিপ নিয়ে টানাটানি করতে হবে, স্যালারি নেগোশিয়েশনের চান্স কমে যাবে। বহুৎ ফ্যাকড়া।
নেক্সট কোথায় যাচ্ছেন?
মন্তব্য করতে লগইন করুন