ঐশীদের কাছে জীবন কেন এত তুচ্ছ?
লিখেছেন লিখেছেন অকপটশুভ্র ২০ আগস্ট, ২০১৩, ০৫:৫৯:১৮ বিকাল
ঐশী তাঁর বাবা-মা কে হত্যা করেছে, এ খবরটি সবার মনেই দাগ কেটেছে। এ নিয়ে হাহুতাশের অন্ত নেই, থাকতেও নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যেটা অবধারিত সেটা হল দুদিন পরে "যাহা পূর্বং তাহাই পরং" হয়ে যাবে। কেউ শিক্ষা নেবে না, বদলাতে চাইবে না। মূলত আমাদের এই গন হাহুতাশের কোন মূল্যই নেই, দু-জন বাবা-মা তাঁদের নিজ সন্তানের হাতে খুন হয়েছেন এই ট্রাজেডিটা আমরা খুব উপভোগ করছি মাত্র। একটা সাইকো সিনেমা দেখে আমরা যেমন ঘৃণা, ভয় ও বীভৎস রসের মিশেলে একধরনের ফিলিংস পেয়ে আনন্দ উপভোগ করি, একটি হরর মুভি দেখে আমরা যেমন ভয় রসের মাধ্যমে আনন্দ উপভোগ করি তেমনি ঐশীর ঘটনায় আমরা শুধু মাত্র একটু ট্রাজেডির রসে সিক্ত হয়ে একধরনের ট্রাজেডি বিলাসিতায় মত্ত রয়েছি। এর বেশি কিছুই না।
আমাদের প্রায় প্রতিটি পরিবারেই এরকম গোল্লায় যাওয়া সন্তানের উপস্থিতি রয়েছে। এবং জানা অজানা এরকম লক্ষ লক্ষ ঘটনা ঘটছে। এরা সবাই হয়তো খুন বা আত্মহত্যা করছে না, কিন্তু তাদের আশে পাসের কাছের মানুষদেরকে অমানুষিক কষ্টে রেখে যে টর্চার করছে তার চেয়ে ঐশীর বাবা-মায়ের মত মরে যাওয়া অনেক অনেক সহজ ব্যাপার। ঐশীর বাবা-মা জানতেন যে "সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ" এর পরেও তাঁরা তাদের মেয়েকে সৎ সঙ্গী পাবে এমন প্রতিষ্ঠানে পড়তে পাঠান নি। নিঃসন্দেহে ইংলিশ মিডিয়ামে নৈতিকতা শেখানো হয় না। সেখানকার পরিবেশেও নৈতিক মানস গড়ে উঠার কোন উপাদান নেই, আমাদের বাংলা মিডিয়ামেও নেই। ধনতন্ত্রের রাজ্যে এবং ভোগ-বিলাসের এই সর্বভুক সংস্কৃতিতে নিজেকে একেকজন যোগ্য এবং সক্ষম ভোক্তা হিসেবে গড়ে তোলাই এসকল প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য। মেয়ের চোখে তাঁর বাবা-মা ছিলেন সেকেলে কিন্তু পিতা-মাতা নিজেরা আসলে সেকেলে ছিলেন না, তারা তাঁদের অজান্তেই ছিলেন একালের। তাই তাঁদের কাছে একালের আর দশটা ভোগ-বিলাসী লোভীর মতো "ক্যারিয়ারটাই" ছিল অর্জনের তালিকায় একমাত্র বিষয় বস্তু। যার কারণে সন্তানের জীবন চলার পথে স্রষ্টার পরিচয়, জীবনের উদ্দেশ্য, চরিত্র ও নৈতিকতার কোন অন্তর্ভুক্তি তারা চান নি। অনুভবও করেন নি তারা। এদেশের আধুনিক মা-বাবা রা এ কাজটি ভুলেও করেন না। তাঁদের কাছে সন্তানের ক্যারিয়ারটাই একমাত্র আরাধ্য বস্তু। রিযিকের ব্যপারে আল্লাহর উপর যাদের আস্থা ও বিশ্বাস নেই তাঁদের জন্য ক্যারিয়ার একটা বড় ফ্যাক্টর বটে। মাঝে মাঝে ভাবি "ছোট লোকের পাওয়ার চাহিদাটা সর্বদা প্রকটই থাকে" আমাদের পরিবারগুলোর কর্তারা কি সেই পর্যায়ে নেমে গেলেন সহসা?
অনলাইন নিউজ পোর্টাল গুলোর কল্যাণে ঐশীর কথিত সুসাইডাল নোটটির যতটুকু প্রকাশ পেয়েছে আমি তা পড়েছি। এ সম্পর্কে আমার একটা ক্ষীণ সন্দেহ আছে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া একজন মেয়ের বাংলা লেখা এতটা গোছালো ও সুবিন্যস্ত হওয়াটা কিছুটা সন্দেহের দাবী রাখে। তবে লেখাটা সে ইংরেজিতে লিখে থাকলে এবং পরে সেটা বাংলা করা হলে ভিন্ন কথা। মেয়েটির কথিত সুসাইডাল নোটের প্রকাশিত অংশ পড়েও মেয়েটির এই ভোগের মানসিকতা এবং তদনুযায়ী না পাওয়ার মানসিকতাটা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। সে সাথে আস্তিকতার ছাঁচ থাকলেও ঈমানী জ্ঞানের প্রতি সন্দেহ সংশয় প্রকট হয়ে ধরা পড়েছে তাঁর চিঠিতে। সে কারণে স্বভাবতই জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ওর ছিলনা নুন্যতম ধারণা। তাই যখন সে দেখেছে তার লাগাম হীন ভোগের জীবন যাপনের ক্ষেত্রে বাবা-মা বাধা এবং তাঁদের কারণে তার না পাওয়ার লিস্টটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে তখন না পাওয়ার হতাশা তাকে ক্রমশ ঘিরে ধরেছে। একসময় সে হয়ে গেছে পাষান।
ছোট একটা উদাহরণ দেই, বলা হয় "প্রেম পবিত্র, তাহলে প্রেম কেন করা যাবে না" অথবা "সংসার আমি করবো সুতরাং যাকে আমার ভালো লেগেছে তার সাথে মিশতে, তাঁকে বিয়ে করতে দোষ কি?" আর "যাকে আমি বিয়েই করব তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক হলে কি এমন সমস্যা?" প্রেম সম্পর্কিত এরকম হাজারটা প্রশ্নের সদুত্তর আমাদের কোমল মতি সন্তানদের কাছে পরিষ্কার নয়। ইয়াংষ্টারদের মনে এরকম অজানা হাজারটা প্রশ্ন লাগামহীন জীবনের ব্যাপারেও আছে, মাদকাসক্তির ব্যাপারেও আছে, ধার্মিক জীবনের ব্যাপারেও আছে। এই ছেলে মেয়ে গুলোকে এসকল প্রশ্নের যৌক্তিক জবাব না বাবা-মা দিতে পারেন আর না তাদের পাঠ্যবই তাদেরকে এগুলো শেখায়। এদিকে এসকল ব্যাপারে সদুত্তর পেতে হলে জ্ঞান ভিত্তিক পরিচ্ছন্ন ঈমান তথা বিশ্বাসের একটা বিরাট ভূমিকা আছে । যা আমাদের সমাজের কোন প্রতিষ্ঠানই সরবরাহে সক্ষম নয়। তার উপর আমাদের অভিভাবকরাও এগুলো কিছুই জানেন না, বুঝেন না। সেজন্য প্রেম করতে না পারা আমাদের সন্তানদের জন্য একটা বিরাট ব্যর্থতা বলে পরিগণিত হয়। এছাড়াও পছন্দের মানুষের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে না পারা, প্রেমের সম্পর্ক টিকাতে না পারা, মাদক সেবন করতে না পারা, লাগাম হীন জীবন যাপন করতে না পারা, ইত্যাদি জীবন ও চরিত্র বিধ্বংসী কাজ করতে না পারা এখনকার ছেলেদের জন্য এক একটা বিরাট আকারের ব্যর্থতা বলে পরিগণিত হয়। যার কারণে এগুলো না পেলে তাঁদের কাছে তাদের নিজেদের জীবনের আর কোন মূল্যই থাকে না। হতাশা ঘিরে ধরে। তারা এগুলো না পাওয়াকে বিরাট কিছু একটা মনে করে। এ কারণে এসকল চাওয়া পাওয়ার পথে যারা বাধা তাদেরকে খুন করতেও দ্বিধা বোধ করে না। এদিকে এই না পাওয়ার হতাশার থেকে "ব্যর্থ জীবনের" যে ধারণা জন্মায় তা তাদেরকে সহজেই আত্মহত্যার পর্যায়ে নিয়ে যায়।
এরা যদি জানতো এগুলো পাওয়া না পাওয়াই জীবনের শেষ কথা নয়, তাঁদের এই জীবনের জন্য আরও বড় ও মহৎ মহৎ উদ্দেশ্য আছে। যে উদ্দেশ্যে কাজ করলে হতাশারা কাছেও ভিড়তে পারে না। পাওয়া না পাওয়ার তালিকার চাইতে ত্যাগের তালিকাটা কতটা বড় হল সেটাই এই জীবনের সার্থকতা নিশ্চিত করে দেয়। ঈমান, ইবাদত, নৈতিকতা, চরিত্র, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে সুদূর প্রসারী দাওয়াতি দৃষ্টিভঙ্গিই এই জীবনের মুল উদ্দেশ্য। এগুলো ঘিরেই প্রতিটি জীবনের সৃষ্টি। এগুলো সঠিক যুক্তি বুদ্ধি সহকারে জানতে পারলে কোন সন্তান পিতামাতাকে হত্যা কিংবা কোন বন্ধু তার বন্ধুকে হত্যার চিন্তা মাথায়ও আনতে পারতো না। এমনকি কেউ কারও শত্রুকেও হত্যা করতে চাইতো না। মানুষ মানুষের অধিকার হরণের চিন্তাও করত না। সুখ ও সাচ্ছন্দপুর্ণ সমাজের জন্য এর বেশি আর কীইবা দরকার আছে?
বিষয়: বিবিধ
১৯৫৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন