আমাদের আত্ম পরিচয়: মুখ্য ও সার্বভৌম পরিচয় অথবা গৌণ পরিচয়
লিখেছেন লিখেছেন অকপটশুভ্র ১৪ আগস্ট, ২০১৩, ০৩:২৯:৩১ রাত
ইদানীং দুদিন পার হতে না হতেই এদেশের জাতিয় জীবনে একেকটি মুখরোচক বিষয় আমাদের কাছে আলোচ্য বিষয় হয়ে আসছে। এতে কখনও নারী নীতি, কখনও তেঁতুল, কখনও আস্তিকতা ও নাস্তিকতা আবার কখনও হিজাব এবং নিরেট বাঙ্গালিয়ানার পরিমাপক বিষয়াদি সহজেই উঠে আসছে লোকের মুখে মুখে। এসব জীবন ঘনিষ্ঠ কিন্তু নতুন নতুন বিষয়াদি হঠাৎ আলোচিত হয়ে ওঠার ব্যাপারটা নিয়ে একেকজন একেক সমীকরণ টেনে একেকটা নির্দিষ্ট পক্ষাবলম্বন করে নেবেন এটাই স্বাভাবিক। এমনকি যারা নিরপেক্ষ ভাব নিয়ে চুপসে বসে আছেন তারাও তলে তলে পছন্দের পক্ষটা আগলে বসে আছেন। আমি নিজেও কিছু পক্ষাবলম্বন করে রেখেছি, আমি এই নতুন নতুন বিষয়গুলো আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হওয়াকে সাপোর্ট করি। আমি একটা জিনিস খেয়াল করেছি, সেটা হল, কৌতুক করে হোক কিংবা গাম্ভীর্যতা নিয়ে হোক, যেভাবেই কথা গুলো আসুক না কেন এগুলো দেশ জুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসছে। যার কারণে আমি নিঃসন্দেহে বলবো এ বিষয়গুলো অত্যন্ত জীবন ঘনিষ্ঠ একেকটি বিষয় তথাপি এগুলো আমাদের শিক্ষার আওতাভুক্ত ছিল না কখনও। এটা আমাদের পাঠ্য বই ও অন্তরের বিশ্বাসের সাথে চরম বৈপরীত্যের ইঙ্গিত বহন করে।
আমাদের পাঠ্যপুস্তক আমাদের কথাগুলো বলছে না, সে বলছে অন্য কথা, সেখানে আমি কে? কেন এ জগতে এসেছি? এবং কোথায় চলে যাব? এ প্রশ্ন গুলোর কোন জবাব নেই। বরং আমাকে বার বার জানানো হচ্ছে যে কিভাবে দু পয়সা আয় করে জীবন ধারণের জন্য আমাকে কঠোর পরিশ্রমী হয়ে ক্যারিয়ার গঠন করতে হবে। সোজা কথায় আমাদের প্রত্যেকটি পাঠ্যবই যেন সমস্বরে চিৎকার করে একটা কথাই বলছে যে "একজন উৎপাদনশীল কর্মী হও, প্রকৃত মানুষ হওয়া এখানে মুখ্য নয়"। আমাদের আচার ব্যবহার, রুচি ও চরিত্র যেমনই হোকনা কেন কয়েক হাজার চাকরি প্রার্থীর সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে যাওয়াই হল জীবনের উদ্দেশ্য, অফিসের ডেস্কে বসে কাজ করে উপরের পদবীটা বাগিয়ে নেয়াই হল মুখ্য। এটাই ক্যারিয়ার, এটাই আরাধ্য। জীবনের কোমলতম সময়ের পুরোটা জুড়ে আমরা এতটুকুই শিখি এবং বাস্তবতা ও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সেই শিক্ষারই বাস্তবায়ন করি। যার কারণে জীবন ঘনিষ্ঠ এই ব্যাপারগুলো আমরা বুঝি বা না বুঝি, এগুলো শোনা মাত্রই আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে, আমরা এগুলোকে এতটা গুরুত্ব দেই। কারণ এসকল বিষয়ে আমাদের সকলেরই কিছু না কিছু বলার আছে, জানার আছে, দাবী আছে এবং অধিকার আছে। যার কারণে এ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের কৌতূহল এত বেশি। এজন্যে এ বিষয়গুলো নিয়ে যখন যত্র তত্র কথা হতে থাকে তখন আমি বিরক্ত হই না বরং শুনতে ও বুঝতে চেষ্টা করি যে সবাই কি বলছে, কি ভাবছে এবং কি করছে।
আমাদের জাতিয় জীবনে অনেক কিছুই আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে, এর মধ্যে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তার উপর আস্থা তথা ঈমান, চেতনা, দেশ প্রেম, নারী অধিকার, আস্তিকতা বনাম নাস্তিকতা, ধর্ম ও জীবন, ও আদর্শ বিষয়ক আলোচনাই ঘুরে ফিরে বার বার এসেছে। আমরা যদি আমাদের ব্যক্তি থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল সমস্যাগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখবো যে ঘুরে ফিরে সব গুলো সমস্যাই এই দিক গুলোর দিকেই ইঙ্গিত করছে। তার মানে হচ্ছে, এই বিষয়গুলোর সঠিক ধারণা আমাদের মন ও মগজে গেঁথে দিতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে আমাদের কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে জব ভ্যাকান্সির চাইতে চাকরি প্রার্থীর সংখ্যা বহুগুণে অধিক। শুধু তাই নয়, এদেশে নৈতিক মান সম্পন্ন আস্থা ভাজন মানুষের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। এর মানে হল আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা একদিকে যেমন শুধু উৎপাদনশীল কর্মীই বানিয়েছে তেমনি অন্যদিকে সৎ ও ন্যায় নিষ্ঠ এবং স্ব-শিক্ষিত মানুষ তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে চরম ভাবে। আমরা যখন সমালোচক হয়ে আমাদের অন্ধ অনুকরণ কৃত পাঠ্যবইয়ের পাতায় পাতায় ঘুরে বেড়াই তখন আমরা দেখি যে সেখানে শুধু চেতনা, দেশ প্রেম ও নারী অধিকার ছাড়া বাদ বাকি জীবন ঘনিষ্ঠ কোন কিছুই পর্যাপ্ত কলেবরে স্থান পায়নি। যেগুলো পেয়েছে সেগুলোও নির্দিষ্ট স্বার্থ বাদী কিছু মহলের তোষামোদ পুষ্ট হয়ে স্থান পেয়েছে। যার ফলে আমাদের জাতীয় ইস্যু ভিত্তিক অন্তর্কোন্দল আমাদেরই অস্তিত্বের সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একজন মানুষের ঠিক কতগুলো পরিচয় থাকতে পারে? যদি একাধিক পরিচয় থাকে তাহলে কোনটা হবে চূড়ান্ত বা সার্বভৌম পরিচয় তা মানুষের বিশ্বাসের উপর নির্ভর করবে। আমি যতদূর বুঝি তাতে আমার মনে হয় একজন মানুষের একাধিক পরিচয় থাকতে পারে। ধর্ম, ভাষা, জন্ম, পূর্বপুরুষ, বর্ণ, ভৌগলিক, সাংস্কৃতিক ও আরও বিভিন্ন দিক দিয়ে একজন মানুষের একাধিক পরিচয় থাকতে পারে। এমনকি এদের একেকটি পরিচয়ের বাহ্যিক অবয়ব অন্যান্য দিক গুলোর প্রভাবে অনেক হেরফেরও হতে পারে। কিন্তু তিনি মন ও মানসে ঠিক কি পরিচয় ধারণ করেন সেটাই আসলে বিবেচ্য। কিন্তু এটা সার্বজনীন সত্য যে একজন মুসলমানের জন্য তার ঈমানী পরিচয়টাই চূড়ান্ত বা সার্বভৌম পরিচয়। এতে কারও আপত্তি থাকলে কিছুই করার নেই। একজন মুসলমানের ঈমানী পরিচয় কে অন্য কোনও পরিচয়ই ছাপিয়ে যাবে না বা ডোমিনেট করবে না। মুসলমানের উপর ইসলামের এই বাধ্য-বাধকতা নিয়ে যদি কারও আপত্তি থেকে থাকে তাহলে সেটা নিয়ে একজন মুসলমানের কোন মাথাব্যথাই নেই। কারণ একজন মুসলমান তার মুসলমানি ত্বের পরিচয় নিয়েই অহংকার করেন। তবে ইসলাম মানুষের অন্যান্য পরিচয়কে কিছুমাত্রও অস্বীকার করে না। তাই একজন বাঙ্গালী মুসলমানের বাঙ্গালীত্ব নিয়ে ইসলামের ততক্ষণ কোন আপত্তি নেই যতক্ষণ না সেই পরিচয় তাঁর ঈমানী পরিচয়কে অবমাননা করে। সুতরাং ইসলাম মানুষের অন্যান্য পরিচয়কে ততটুকুই গ্রহণ করে যতটুকু নিতান্তই প্রয়োজন।
যিনি যে বিষয়ে কোন ধারণাই রাখেন না তিনি সে বিষয়েই সাংঘর্ষিক কথা বলছেন এটা শুধু এদেশেই আমরা লক্ষ্য করে আসছি। ইসলাম ধর্মীয় জ্ঞানে মূর্খ তানিয়া আমিরের ধর্মমত, রোকেয়া প্রাচীর কিংবা মিতা হকের আজগুবি তাত্ত্বিক মতামত এদেশের জনতার জ্ঞান ও বিশ্বাসের মধ্যকার সুবিশাল বৈপরীত্যের যে প্রদর্শনী এনে দিয়েছে তা নিশ্চিতই আমাদের মনোযোগের আওতাটা অনায়াসেই এড়িয়ে যাবে। এর পরেও এ বিষয়গুলো আমাদের চিন্তার গোচরে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হল তারা কেন তাদের অজ্ঞতা সম্পর্কে অবহিত থেকেও এসকল হাস্যকর কথা বলে চলেছেন। এর উত্তর একটাই, তারা জানেন যে আর যাই হোক "ইসলাম" নামক এই ধর্মটি দুনিয়ার বুক হতে মুছে ফেলার শক্তি কারও নাই। তবে যদি ইসলামের বিভিন্ন মূল্যবোধকে তারা নিজেদের আদর্শের ছাঁচে পরিবর্তিত করে জনতার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন তাহলেই কেবল মুসলমানদেরকে তারা তাদের ক্রীড়নক বানিয়ে রাখতে পারবে। এ লক্ষ্যেই উগ্র ধর্মনিরপেক্ষতা বাদী মৌলবাদী শক্তি ইসলামের আকীদাগত ও মূল্যবোধগত বিভিন্ন বিষয়কে তাদের নিজস্ব আদর্শের ছাঁচে সাজিয়ে প্রচার করে যাচ্ছেন। আমাদের উচিৎ "অনেক হয়েছে এইবার থামেন" এই নীতি অনুসরণ না করে বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে সবটুকু শক্তি দিয়ে সঠিক ও নির্ভুল ইসলামিক ভাবধারার প্রচার ও গন সচেতনতামুলক প্রচারণা চালিয়ে যাওয়া।
বিষয়: বিবিধ
২৩২২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন