আল্লামা শফী হুজুরের তেঁতুল থিওরিঃ কিছু দ্বিমত
লিখেছেন লিখেছেন অকপটশুভ্র ১৩ জুলাই, ২০১৩, ০১:২৫:৫৫ দুপুর
যারা হুজুরকে সকল সমালোচনার ঊর্ধ্বে মনে করেন তারা নোট টি পড়ে শুধু শুধু সময় নষ্ট না করলেই ভালো করবেন
হুজুরের তেঁতুল থিওরি শুনতে খারাপ লাগলেও ব্যাপারটা নিরেট সত্য। বরকত থিওরিও সত্য, কিন্তু হুজুর যেহেতু অর্থনৈতিক মার প্যাচ বুঝেন না সেহেতু সমস্যাটা যে "মেয়েদের চাকরি করা"তে নয় বরং "অর্থনৈতিক বৈষম্য"তে তা উনার কাছে পরিষ্কার ছিল না। না থাকাটাই স্বাভাবিক, হুজুর নিশ্চয় সমসাময়িক অর্থনীতি পড়েন নাই। এটা হুজুরের জন্য কখনই লজ্জার বিষয় নয়। হুজুর যে বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন সে বিষয়ে উনার সামনে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে দুইটা কথা বলার লোক এদেশে কমই আছে। লজ্জাটা আমরা যারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে "স্মার্ট" হয়েছি তাদের, কারণ আমরা যে বিষয়ে পড়াশোনা করেছি তার উপরে আমাদের ভালো দখল নাই। যার প্রমাণ হল আমরা আমাদের সমাজের আধুনিক সমস্যার মূল কারণ গুলো ধরতে পারিনি।
কিন্তু নারীদের চাকরি নিয়ে হুজুর বুদ্ধিদীপ্ত কথা বলেন নি। এটা চল্লিশের দশক নয়, এত সোজা কথায় যে চিড়া ভিজে না তা উনার জানা ছিল না। নতুন করে উনার তা জানার সম্ভাবনাও নাই, সময়ও নাই। এ বিষয়টা জানা ও বুঝার দায়-দায়িত্ব আমাদের মধ্যে যারা যুবক আছেন তাদের, হুজুরের নয়। তাই এব্যাপারে কিছু কথা বলা দরকার।
প্রত্যেকটা সংগঠনে সেপারেটলি একজন ম্যানেজার এবং সেই ম্যানেজারের সংগঠনকে ভালো ভাবে ম্যানেজ করার জন্য একজন ফাইন্যন্সার লাগে। ফাইন্যন্সার অর্থের যোগান দেন, বাজেট করেন, প্ল্যান করেন এবং ম্যানেজারকে দিক নির্দেশনা দেন। আর ম্যানেজার তার প্রয়োজনীয়তার আলোকে ফাইন্যন্সার কে প্রয়োজন, দাবী দাওয়া ও জরুরী বিষয়াদি সম্পর্কে জানান, মতামত দেন। এখানে ফাইন্যন্সার ও ম্যানেজার একে অপরের পরিপূরক, সমস্যা সমাধানে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে উভয়ে নিজ নিজ এক্সপার্টাইজ থেকে অভিমত প্রদান করে সকল দিক বাছ বিচার করে সিদ্ধান্তে আসেন। কারণ ফাইন্যন্সার অর্থের উৎস ও ক্যাপাবিলিটি সম্পর্কে এক্সপার্ট আর ম্যানেজার সংগঠনের আভ্যন্তরীণ খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে এক্সপার্ট। তাই দুজনের মতামতের মাধ্যমেই কেবল একটি সময় উপযোগী সিদ্ধান্তে তারা উপনীত হতে পারেন। আমাদের পরিবারগুলো প্রত্যেকটি একেকটা সংগঠন, শুধু সংগঠনই নয় এই পরিবার গুলো হল জাতির একেকটি পাওয়ার হাউজ। সাধারণত এই পরিবার গুলোতে বাবা "ফাইন্যন্সার" হিসেবে এবং মা "ম্যানেজার" হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আধুনিক সাংগঠনিক নীতিতে সংগঠনের ইফিসিয়েন্সি ও কার্যকরীতা নিশ্চিত করতে একজনের উপর সকল দায়িত্ব অর্পণ না করে স্পেশালাইজেশন করা হয়। অর্থাৎ প্রত্যেককে আলাদা আলাদা ভাবে নির্দিষ্ট দায়িত্বের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়। ইসলামিক পারিবারিক ক্ষেত্রেও এই একই প্রথা প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু হাস্যকর ব্যাপার হল আপনি যখন ম্যানেজমেন্ট পড়বেন, অর্গানাইজেশনাল বিহেভিয়ার পড়বেন অথবা হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট পড়বেন তখন এই স্পেশালাইজেশনকে আপনাকে পড়ানো হবে "সর্বাধুনিক নীতি" হিসেবে। আর সেই "সর্বাধুনিক নীতি" যখন আপনি পারিবারিক সংগঠনে প্রয়োগ করবেন তখন তাকে বলা হবে "সনাতনী" কিংবা "পশ্চাৎ পদতা"। এগুলো হল আমাদের আধুনিক সমাজের আধুনিক কৌতুক, এগুলো বুঝতে হলে আপনাকে প্রচুর পর্যবেক্ষণ ও চিন্তা ভাবনা করতে হবে। বোধকরি কৌতুক বুঝতে হলেও বেশ পরিমাণে বুদ্ধির দরকার হয়।
বর্তমান সমাজে একেবারে কোনরকম খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে হলে আপনাকে আপনার সর্বোচ্চ ইফোর্টটি দিতে হবে। এটা একটি ধ্বংস প্রাপ্ত হতে চলা সমাজ ব্যবস্থার শেষ ধাপ। এরকমটা হওয়ার কারণ মুনাফাখোকো অর্থনীতি, সুদে সয়লাব হয়ে যাওয়া অর্থায়ন ব্যবস্থাপনা, লোভ, দুর্নীতিপরায়ণ আমলাতান্ত্রিকতা ও নৈতিকতা হীনতা। এই সমাজের বাইবেলে লেখা থাকে "খরচের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে সর্বোচ্চ মুনাফা আহরণ করা" এই বাইবেলের আরেকটি সূত্র হল "নগদ যা পাও হাত পেতে লও বাকীর খাতায় শূন্য থাক" সেই সাথে এখানে আছে "প্রতিযোগিতা" যা ব্যাপারটাকে আরও বেশি ভয়ংকর করে তুলেছে। এ সমাজে যারা ব্যবসায়িক উৎপাদন করেন তারাই একমাত্র কম দামে (কাঁচামাল) কেনা কাটা করেন কিন্তু এরা আবার (পণ্য) বিক্রি করার সময় সর্বোচ্চ দাম হাঁকান। এরকম একটি সমাজে একক আয়ে সংসার চালানো অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ একটি কাজ। সুতরাং আমাদের পরিবারগুলোতে বরকত না হওয়ার পেছনে "মেয়েদের চাকরি করা" দায়ী নয় বরং আমাদেরই গড়ে তোলা এই নষ্ট সমাজ ও নষ্ট অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই দায়ী।
নারীদের চার দেয়ালের ভেতরে আটকে রাখাটাও কোন সমাধান নয়, এটা না ইসলামিক সমাধান আর না সাময়িক সমাধান। একটি পরিবারের প্রয়োজন ও অবস্থা সাপেক্ষে সে পরিবারের মা কর্মক্ষেত্রে যাবেন কি যাবেন না সেটা তাদের পারিবারিক সিদ্ধান্ত। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পিতা-মাতা হিসেবে তাদের উপর যে পারিবারিক দায়িত্ব দিয়েছেন তা পালন করে কোন মা যদি বাইরেও কোনও ভালো কাজ কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারেন তাহলে সেখানে কোন সমস্যা কুরআন হাদিসের আলোকে প্রমাণ করা সম্ভব না। অবশ্য শব্দে শব্দে কুরানের আয়াতের অর্থ করলে অনেক কিছুই সম্ভব। বুদ্ধিবৃত্তিক কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে এধরণের হালকা কথা ধোপে টিকবে না। আমাদের দেশে অবশ্য বুদ্ধিবৃত্তিক কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ কিঞ্চিতই হয়েছে।
হুজুর বলেছেন যে মেয়েদের স্বামীর হিসেব পাতি রাখার যোগ্যতা অর্জন পর্যন্ত পড়ালেখা করলেই যথেষ্ট। হুজুরের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি কথাটা ঠিক নয়। আরবিতে একটা সর্বজন সমাদৃত কথা আছে, যার অর্থ হল "সন্তানের জন্য উত্তম শিক্ষালয় হল মায়ের কোল" এই কথারই ইংরেজি ভার্সন নেপোলিয়ন বলে গেছেন "আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাকে একটি শিক্ষিত জাতি দিবো"। এই ভঙ্গুর সমাজের রাক্ষুসে নীতির কথা আগেই বলেছি। এই রাক্ষুসে সমাজ যে শুধু আর্থিক ভাবেই সর্বভুক তাই নয় বরং এটি নীতি-নৈতিকতা, চরিত্র, ধর্ম, আদর্শ, শিক্ষা-দীক্ষা ও সাংস্কৃতিক সহ সকল দিক থেকে একটি সর্বভুক একটি সমাজ। একজন মা তার কোল থেকেই যদি তার সন্তানকে আগুন পানির পার্থক্য চিনিয়ে না দেন। শয়তানের আদর্শের সমুদয় ফাঁদ গুলো চিনিয়ে না দেন, তাহলে আমাদের কোমল মতি সন্তানেরা ধ্বংসের অতলে হারিয়ে যাবে। নারীদের শিক্ষার ক্ষেত্রে হুজুরের কথার সাথে সশ্রদ্ধ কিন্তু কঠোর বিরোধিতা জ্ঞাপন করা ছাড়া আমার আর কোন গতি নাই। এ বিষয় গুলোতে টু শব্দটি করা আগে আমাদেরকে সামাজিক বিজ্ঞান বুঝতে হবে, একটা সমাজে নারীর অবদান, অবস্থান, প্রভাব ও বিস্তার এবং সমাজ গঠনে এসবের পরিণাম বুঝতে হবে।
জন্ম নিয়ন্ত্রণ নিয়েও হুজুর বেশি হালকা কথা বলে ফেলেছেন, বিষয়টা হালকা নয় বলে এর উপর হালকা আলোচনা কিছুতেই চলে না। জন্ম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিশ্ববরেণ্য আলিমদের ভুরি ভুরি গবেষণা কর্ম আছে। সেগুলো সামনে এনেই আলোচনা করা উচিৎ। জন্ম নিয়ন্ত্রণ বিষয়টা নিয়ে আলাপ করতে হলে সমসাময়িক বিশ্বের উপর ভাল রকম আপডেট থাকা চাই। তাই এখানে আর কিছু বলা চলবে না। এ নিয়ে সামনে হয়তো কিছু কথা বিশদ আকারে লিখবো।
দেশের কওমী (অবশ্যই আলীয়াও বাদ যাচ্ছে না) শিক্ষার নবায়ন ও পুনর্গঠন যে কতটা জরুরী হয়ে পড়েছে তা হুজুরের মাত্র দশ মিনিটের বক্তব্যেই পরিষ্কার ভাবে ফুটে উঠেছে। শুধু বক্তব্যের শব্দচয়ন ও বাক্য বিন্যাসের কারণে হুজুরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথাকে হালকা শুনিয়েছে। বক্তব্যের পার্সপেক্টিভ ক্লিয়ার না করে দেয়াতে অনেক যৌক্তিক কথাকে অযৌক্তিক শুনিয়েছে, বর্তমান সমাজের বাস্তবতার মূল্যায়ন না হওয়াতে অনেক কথাকে হাস্যকর মনে হয়েছে, আর বর্তমান সমাজের সামাজিক গঠন এবং পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের মানসিকতাকে মূল্যায়ন না করে কথা বলাতে অনেক কথাকেই অপ্রাসঙ্গিক ও হালকা শুনিয়েছে। বাচন ভঙ্গি ও উচ্চারণের কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথাকেই কৌতুক হিসেবে নেয়ার সুযোগ পেয়েছে। এ কারণেই শাহবাগীরা এই ভিডিও প্রচার করে আমাদেরই কিছু মুসলিম ভাই ও বোনকে গুল খাইয়ে ভুল বুঝিয়ে বিপথে চালিত করতে পেরেছে। সেজন্য এর দায় আমরা কিছুতেই এড়াতে পারি না।
রোজা রমজানের দিন বেহুদা তর্ক না করে টুদা পয়েন্ট আপত্তি করুন
বিষয়: রাজনীতি
৫৭০৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন