মিশরঃ স্বার্থের বলী একটি দেশ

লিখেছেন লিখেছেন অকপটশুভ্র ০৫ জুলাই, ২০১৩, ০৫:১৬:৪০ বিকাল

এটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে, যেকোনো কিছুর বিনিময়ে মিশরে একটি সামরিক ক্যু আনার বহুমুখী প্রচেষ্টা অনেক দিন ধরেই চলছিলো। সম্ভবত সে দেশের জাতিয় নির্বাচনে ইসলাম পন্থিদের বিজয়ের পর থেকেই এই প্রচেষ্টার শুরু হয়েছিলো। এটি স্পষ্ট যে ২০১১ সালে মিশরের গণজাগরণের ব্যাপারে ইসলাম পন্থিদের অবস্থান প্রথম দিকে বেশ নিষ্ক্রিয় ছিল, তাদের তৎকালীন হাব-ভাবই বলে দেয় যে তারা নিজেরাও গণজাগরণের ব্যপারে অনেকটা দ্বিধা দ্বন্দ্বে ছিলেন যে ঠিক কি সিদ্ধান্ত নিবেন। একটা সময় পরে ইখওয়ান সরাসরি গণজাগরণের সাথে একত্বতা ঘোষণা করলে সে আন্দোলনে একটা কার্যকর গতির সঞ্চার হয়। নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী প্রদানের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার পরিলক্ষিত হয়েছিলো। এর পর পৃথিবীর বুকে এক অনন্য উদাহরণের মাধ্যমে সেও দেশে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে সফল ভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে যায় একটি গণআন্দোলনের। প্রকৃত অর্থেই সেখানে গণতন্ত্র ফিরে আসে।

২০১৩ তে এসে যখন দেখা গেলো যে, যেসকল মানুষ ঠিক দু বছর আগে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত ছিল সে সকল মানুষেরই একটা অংশ দু বছর যেতে না যেতেই গণতন্ত্রকে হত্যাকারী সামরিক অভ্যুত্থানকে করতালির মাধ্যমে স্বাগত জানালো, বস্তুত তারাই আন্দোলন করে এই সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে এলো তখন একটি প্রশ্ন খুব বড় হয়ে সামনে চলে আসে সেটা হল, ২০১১ সালের গণজাগরণ কি আদৌও প্রকৃত গণজাগরণ ছিল? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হল সে গণজাগরণের মঞ্চায়ন করার পেছনে নাটের গুরুদের যে উদ্দেশ্য কাজ করেছিলো সেটি হাসিল না হওয়াতেই কি সদ্য প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রকে অগণতান্ত্রিক পন্থাতে হত্যা করতে হল? প্রিয় পাঠক! আমাদেরকে বুঝতে হবে যে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে, যখন অর্থনৈতিক মন্দা চরম আকারে বিশ্বকে ঘিয়ে রেখেছে, বিশ্ব অর্থায়ন ব্যবস্থা যখন কিছুতেই আলোর মুখ দেখতে পারছে না তখন একটি সরকারের পক্ষে এক বছরের মাথায় জনগণকে দেয়ার মতো উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই। বিশ্ব পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই যখন ফেডারেল ইন্টারেস্ট রেট শূন্যের কাছা কাছি নামিয়েও অর্থনৈতিক মন্দা ভাবের কোন উন্নতি করতে পারছে না তখন মিশরের মতো সদ্য স্বৈরাচার মুক্ত একটি দেশ কি করে আপনাকে উন্নতির বহর দেখিয়ে চমকে দিবে তা গভীর ভাবে ভাবার দাবী রাখে। এ দিক থেকে চিন্তাকরলে দেখা যায় মিশরের সমুদয় সমস্যার সমাধান পাঁচ দশ বছরের কাজ নয় বরং যুগ-যুগান্তরের কাজ। কারণ যে সমস্যাগুলোর সমাধান পাবার আশায় সে দেশের জনগন রাজপথে নেমেছিলো সে সমস্যাগুলোর বীজ বপন করা হয়েছিলো প্রায় একটি শতাব্দিরও বেশি সময় আগে থেকে। এই লম্বা সময়ে এই সমস্যাগুলোর বিস্তার ক্যান্সারের মতো গোটা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে গিয়েছিলো।

মিশরের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো সম্পর্কে যারা ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে নুন্যতম ধারণা রাখেন তারা নিশ্চই জানেন শুধু মাত্র সরকারি এডমিনিস্ট্রেশনে একটি পরিবর্তনের মাধ্যমে সে দেশের জনতার ভাগ্যে পরিবর্তন আনা সম্পূর্ণ অসম্ভব। আজকের আধুনিক রাষ্ট্রে গণতন্ত্র যতই প্রতিষ্ঠিত হোকনা কেন মিডিয়া, সামরিক বিভাগ, আইন-আদালত, সংস্কৃতি ও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন না করা গেলে কোন আশাব্যঞ্জক পরিবর্তন সম্পূর্ণ অসম্ভব। মিশর কিংবা বিশ্বের যেকোনো দেশেই এটা সম্ভব নয়। মুবারক সরকারের পতনের পরে মিশরের আইন-আদালত, সামরিক বিভাগ ও প্যারা মিলিটারি ফোর্স, মিডিয়া, সংস্কৃতি ও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা যায়নি সঙ্গত কারণেই। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়, মিশর ও বাংলাদেশের মতো একটি দেশের শুধুমাত্র পুলিশ বাহিনীতেই শুদ্ধি অভিযান চালাতে গেলে লোম বাছতে গিয়ে কম্বলটাই হারিয়ে যাবার দশা হয়ে দাঁড়াবে। একই অবস্থা অন্যান্য ক্ষেত্রে। সেজন্য পরিবর্তনের ধারাটা অবশ্যই ধীর ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এটা গণতন্ত্রের বাই ডিফল্ট ঝুঁকি। জনগণ রাতারাতি পরিবর্তনের আশায় সরকার পরিবর্তন করবে কিন্তু কোন সরকারই সদিচ্ছা থাকা সত্বেও উন্নয়নে আশাব্যঞ্জক গতিসঞ্চার করতে পারবে না। সেটা করতে হলে সে সরকারকে সারা দেশের তাবৎ আমলা তান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা আইন-আদালত, সামরিক ও প্যারা মিলিটারি ফোর্স, মিডিয়া ও সংস্কৃতিতে গনছাটাই কার্যক্রমের মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে যা একমাত্র একটি যুদ্ধজয়ী অনুগত সেনাবাহীনির অধিকারী সরকারের পক্ষেই সম্ভব, গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে নয়।

মিশর গণতন্ত্র ফিরে পাবার পর সে দেশের যেকোনো পটপরিবর্তন গণতান্ত্রিক উপায়েই হওয়া উচিৎ ছিল। মুরসি বিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই মিডিয়া অস্বাভাবিক ভাবে এই আন্দোলনকে হাইলাইট করা শুরু করে। যার কারণে একটা পর্যায়ে মুরসির সমর্থকদেরকেও রাস্তায় নেমে আসতে হয়। এরই মাঝে সেদেশের সামরিকবাহিনী এক রকম তড়িঘড়ি করেই মাত্র ৪৮ ঘণ্টার সময় সীমা বেধে দেয়। এই তড়িঘড়ি পদক্ষেপই প্রমাণ করে যে গণতন্ত্রকে হত্যা করার সমুদয় ব্যবস্থা আগে থেকেই ঠিক-ঠাক করে রাখা হয়েছিলো। এদিকে প্রেসিডেন্ট মুরসি সেনাবাহীনির আল্টিমেটামকে প্রত্যাখ্যান করে ছয় মাসের মধ্যে নতুন সরকার গঠনের প্রস্তাব দিলে মূলত সেখানে একটি গণতান্ত্রিক সমাধানের দার উন্মোচিত হয়। এই প্রস্তাব শুধু মুরসির দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা ও মহৎ হৃদয়ের পরিচায়কই নয় বরং গণতন্ত্র রক্ষার্থে তাঁর ত্যাগের মহান মানসিকতার পরিচায়কও বটে। ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে এমন ত্যাগী প্রস্তাব গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেও অতি বিরল। এরকম প্রস্তাব আসার পরেও সেনাবাহিনীর সামরিক ক্যু হয়ে যাওয়াই প্রমাণ করে যে গণতন্ত্র কোন মুখ্য লক্ষ্য কখনই ছিল না। ইসলাম পন্থিদেরকে ক্ষমতা থেকে সরানোই ছিল আসল উদ্দেশ্য। এখন সেটা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেই তারা করে নিয়েছে। এই ষড়যন্ত্রের খলনায়ক হিসেবে মিশরের ইতিহাসে সেদেশের ধর্মনিরপেক্ষ মৌলবাদী ও বাম পন্থিরা জাতিয় গাদ্দার হয়ে রইবে এখন থেকে। এরা মানব জাতির কল্যাণের জন্য সবসময়েই হুমকি হয়ে থাকবে। আজকে মিশরের গনতন্ত্র হত্যাকে সমর্থন করে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ মৌলবাদী ও বাম পন্থিরা উল্লাসে ফেটে পড়ার কারণও একটাই। সেটা হল এদের আদর্শই হল নিজেদের স্বার্থে মানবতা কে হত্যা করা, গণতন্ত্রকে হত্যা করা এবং দেশকে বিক্রি করে দেয়া। মিশরের ধর্মনিরপেক্ষ মৌলবাদী ও বাম পন্থিরা এবং বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ মৌলবাদী ও বাম পন্থিরা উভয়েই আত্মার আত্মীয়। এরা বাংলাদেশের জন্যও আজীবন শত্রু। নিজেদের ক্ষমতা ও দখলদারিত্বের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে এরা সকল কিছুই করতে পারে।

বিষয়: বিবিধ

১৬৬৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File