মিশরের রাজনৈতিক পরিক্রমার এপিঠ ওপিঠ

লিখেছেন লিখেছেন অকপটশুভ্র ০৩ জুলাই, ২০১৩, ০৬:৪৩:২৪ সন্ধ্যা



মুরসির পক্ষে জড়ো হওয়া মানুষ জুমার নামাজ আদায় করছে

মিশরের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে অনেককেই বেশ উদ্বিগ্ন দেখা যাচ্ছে। আসলে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই, এটাই বরং ইতিহাসের পর্যায়ক্রমিক ধারা। বিশ্ব ইসলামি আন্দোলনের ঐতিহাসিক পরিক্রমা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে এমনটিই হয়ে এসেছে আবহমান কাল ধরে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যখনই ইসলামি শক্তি ক্ষমতার মসনদে এসেছে, সেটা কোয়ালিশন করে হোক বা একক শক্তি নিয়ে হোক উভয় ক্ষেত্রেই দেখা গেছে অগণতান্ত্রিক পন্থায় তাদেরকে জোর করে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। সম্ভবত মিশরেও অচিরেই সেনা ক্যু হতে যাচ্ছে। ইখওয়ানকে সম্ভবত আরেকটা লম্বা সময়ের জন্য শোষিতের কাতারে এসে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু সেটা অতটা সহজ না ও হতে পারে, একদিকে তাহরীর স্কয়ারে মুরসি বিরোধী আন্দোলন চলতে থাকলেও অন্যদিকে তাহরির স্কয়ারের অদূরেই কায়রো ইউনিভার্সিটির পাশে মুরসির পক্ষে জড়ো হয়েছে জনসমুদ্র। মুরসি বিরোধীরা এখন পর্যন্ত মিডিয়ার প্রত্যক্ষ সমর্থন পেয়ে এবং সেনাবাহিনী থেকে ইতিবাচক কোন ইঙ্গিত পেয়ে মুরসি সমর্থকদের থেকে বেশ এগিয়ে আছে। সেনাবাহিনীর ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটামের প্রতিক্রিয়ায় তাহরীর স্কয়ারে মুরসি বিরোধীদের উল্লাস তারই ইঙ্গিত করে।



মুরসি বিরোধীদের অবস্থান

এদিকে তাহরীর স্কয়ার থেকে ধেয়ে আসছে নারীদের শ্লীলতাহানির খবর অন্যদিকে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে জড়ো হওয়া মুরসি সমর্থকদের উপর চলছে নারকীয় হামলা। এটা যখন লিখছি তার মাত্র দু ঘণ্টা আগের খবরে প্রকাশ যে অজ্ঞাত একটি সন্ত্রাসী দল মুরসি সমর্থকদের উপর হামলা করে ১৬ জনকে হত্যা করেছে এবং ২০০ জনেরও বেশি হতাহত হয়েছে। অবস্থা দৃষ্টে অবশ্যই ধরে নেয়া যায় যে তাহরীরের মুরসি বিরোধীদেরই একটি সশস্ত্র গ্রুপ এ হামলা করেছে। তাছাড়া দুই গ্রুপের মধ্যে চলছে সংঘর্ষ গোটা দেশ জুড়ে, এটি ছড়িয়ে পড়ছে আশংকাজনক হারে। এদিকে মুরসির কেবিনেট থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর পদত্যাগের পরে অবশ্যই মুরসি অনেকটাই বেকায়দায় থাকবেন।



ইখওয়ানের হেড কোয়াটারে আগুন দেয়া হয়েছে

দুই দিকে পরস্পর বিরোধী দুইটি আন্দোলনের ব্যাপারে মিডিয়ার ভাষ্যমতে মুরসি সমর্থকদেরকে যুদ্ধংদেহী অবয়বে উপস্থাপন করা হলেও তাহরীরের মুরসি বিরোধীদেরকে দেখানো হচ্ছে শান্ত-শিষ্ট অবলা শিশু হিসেবে। অথচ আক্রমণের শিকার হচ্ছে মুরসি সমর্থকরা। লাঠি হাতে আন্দোলনকারীদেরকে সরাসরি মুরসি সমর্থক বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে কিন্তু আহত মুরসি সমর্থকের ছবির ক্যাপশনে ইজিপশিয়ান নাগরিক বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এদিকে মুরসি সমর্থকদের উপর হামলাকে " এ গ্রুপ অফ আনআইডেন্টিফাইড ম্যান" বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ইখওয়ানের হেড কোয়াটারে চালানো হয়েছে নারকীয় তাণ্ডব।



ইখওয়ানের সাইন বোর্ড খুলে নেয়া হচ্ছে

বলা হচ্ছে বেকারত্বের সমস্যার আশাব্যঞ্জক সমাধান না করা মুরসির বড় ধরণের ভুল গুলোর মধ্যে একটি। মুবারকের পতন ও মুরসির গণতান্ত্রিক বিজয়কেই বিপ্লবের আপাদমস্তক মনে করে জনতাকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে "বিজয় এসে গেছে, এখন সুবর্ণ সময়" মনে করাটাও একটা মস্ত ভুল ছিল বলে বলা হচ্ছে। দাবী করা হচ্ছে যে জনগণ মুবারক বিরোধী আন্দোলনে জড়ো হয়েছিলো শুধুমাত্র তাঁকে সরিয়ে দিতে নয় বরং জনতার মৌলিক কিছু দাবীও ছিল। বেকারত্বের সমাধান সে দাবীগুলোরই একটি। এদিকে মুবারকের আমলে মিশরীয় পুলিশ ও বিভিন্ন প্যারা মিলিটারির বর্বরতা, টর্চার এবং অকথ্য নির্যাতনের একটা সুবিচারের দাবীও ছিল জনতার পক্ষ থেকে। কিন্তু বিরোধী পক্ষ থেকে দাবী করা হচ্ছে মুরসি এ ব্যাপারে একেতো কোন পদক্ষেপ নেনই নাই তার উপর এসকল বাহিনীর পক্ষ হয়ে কাজ করেছেন। শুধু তাই নয় তিনি পুলিশের বর্বরতার বিচারে হাত না দিয়ে বরং প্রেস ও বিচারকদের পেছনে লেগে ছিলেন। এক্ষেত্রে গত নভেম্বরে গণতান্ত্রিক সরকারের ক্ষমতায় সাংবিধানিক হস্তক্ষেপকে সংকুচিত করার মানসে মুরসির Constitutional Decree জারির বিষয়টিকে বার বার সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে।



আগুন দেয়ার পর ইখওয়ানের অফিস

বিগত ত্রিশ বছর মুবারক পন্থিরাই সাংবিধানিক, সামরিক ও রাজনৈতিক নীতিনির্ধারণী মহলের সর্বেসর্বা ছিলেন। তাই তারা বিগত ত্রিশ বছরের অবর্ণনীয় বহুমুখী অন্যায় অনাচার, দুর্নীতি ও স্বৈরাচারী শাসনের পরেও ক্ষমতার মসনদে শক্তপোক্ত ভাবে টিকে ছিলেন। দুহাজার এগারো সালের আগে তাদের টিকিটিও ছিড়তে সাহস হয়নি কারও। এদিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির পটপরিবর্তন এবং ওয়েস্টার্ন লবির স্বার্থে যখন তাদেরই আস্থা ভাজন মুবারক কে সরিয়ে দিতে হল তখন বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে প্রভাবিত করে একটি গন বিপ্লবের জন্ম দেয়া হল। যে সকল অনুযোগ অভিযোগ ও ক্ষোভের কারণে ইজেপশিয়ানরা তাহরীর স্কয়ারে জান মালের ভয়কে উপেক্ষা করে জড়ো হয়েছিলো সেই অনুযোগ অভিযোগ ও ক্ষোভ যুগ যুগ ধরে বিদ্যমান ছিল। কিন্তু তারা দুই হাজার এগারো সালের আগে আন্দোলনে নামে নি কারণ এর আগে মুবারককে সরিয়ে দেয়ার প্রয়োজনও অনুভূত হয় নি এবং এরকম একটি আন্দোলনের প্রচার ও প্রমোশনও কেউ করে নি। সুতরাং কেউ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলো যে "আমি তাহরীর স্কয়ারে যাচ্ছি যারা যারা যেতে চাও আসতে পারো" অথবা কোন এক মেয়ে পুরুষদের পৌরষে হিট দিয়ে ইউটিউবে দুই মিনিটের ভিডিও আপলোড করলো আর তাই দেখে একটা বিশাল বিপ্লব হয়ে গেলো এমনটি ভাবার মতো বোকামি করাটা এই যুগে সাজে না।

আমরা দেখতে পাই যে তাহরীর স্কয়ারের গণজাগরণের প্রথমদিকে ইখওয়ান সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ছিল। এবং একটা লম্বা সময় ধরে তাহরীর স্কয়ারের গণজাগরণ নিয়ে ইখওয়ানের অবস্থান অস্পষ্ট ছিল। পশ্চিমারা মিশর নিয়ে যে পরিকল্পনাই করুক না কেন মিশরের সামাজিক পরিমণ্ডলে ইখওয়ানের অভূতপূর্ব প্রাসঙ্গিকতা ও অবদান ইখওয়ানকে একটা শক্ত সামাজিক নিয়ন্তা হিসেবে পরিণত করেছিলো। তাই একটা পর্যায়ে যখন তারা তাহরীরের গণজাগরণে প্রকাশ্যে যোগ দিলো তখন সে জাগরণ চূড়ান্ত রূপ পেল, মুবারককে ভূলুণ্ঠিত হতে হল। ইখওয়ানের অর্জনের এই ধারাবাহিকতা মিশরের জাতিয় নির্বাচনেও অব্যাহত থাকলো। কিন্তু সমস্যা যেটা হয়েছে সেটা হল মিশরের সরকার গঠন ও দেশ পরিচালনায় গঠিত সরকারের পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বুর্জেয়া গোষ্ঠীর কর্তৃত্বের শক্তি একটা বড় বাধা ছিল। সেই সাথে সরকারের উপর সামরিক শক্তির প্রভাব এবং মিডিয়ার বাম ধারার আদর্শের প্রতি নাড়ীর টানের ব্যাপারগুলো অবশ্যই একটি গণতান্ত্রিক সরকারের সামান্যতম স্বাধীন ভাবে কাজ করার জন্যে অনেক বড় বাধা ছিল। অন্যদিকে মুবারকের জন্যে ছিল উলটো। এই একই বাধা গুলো মুবারকের তোষামদে ব্যস্ত ছিলো। মুরসি যদিও Constitutional Decree জারির মাধ্যমে একটা দিক কে কিছুটা হলেও হালকা করেছিলেন কিন্তু বাদ বাকি বাধা গুলো আগের মতই বলবত আছে এখনও। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দৈব বল ছাড়া চমক দেখানোর মত মুরসির পক্ষে কিছুই করার ছিলো না মিশরে। তাই মুবারকের উপর ক্ষীপ্ত মিশরীয় জনতাকে অনায়াসেই মুরসির উপর ক্ষিপ্ত করে তোলা ছিলো ডাল-ভাত টাইপের কাজ। সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি মুরসির বিপক্ষে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল আকারেই থেকে যাচ্ছে, কারণ এটা এখন মিডিয়ার জন্য টপ মোষ্ট এজেন্ডা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই, কিছু শক্তিশালী গোষ্ঠীর স্বার্থের কাছে গণতন্ত্রের পুন পুন পরাজয় না হলে গণতন্ত্রের মতো অথর্ব একটি রাজনৈতিক পন্থার কুফল জনতার মাঝে পরিষ্কার হবে না। বিশ্ব জনগণের এখন চাক্ষুষ সাক্ষী থাকা উচিৎ যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গণজাগরণ তথা বিপ্লব একটি চাহিবা মাত্র উৎপাদন যোগ্য পণ্য, নির্বাচন একটি একদিনের জন্য জনতার মহামূল্যবান হয়ে ওঠার গল্প, বাদ বাকি টা শুধুই জনতার রক্ত খেয়ে ক্ষমতাসীনের আলী-শান জীবনের সোনালী কাবিন রচনার বিষাদ সিন্ধু।

আপডেট ১

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী মুরসি ছয় মাসের মধ্যে নতুন সরকার গঠনের আহবান জানিয়েছেন। বুঝাই যাচ্ছে যেকোনো মূল্যে সামরিক সরকারের আগমন ঠেকাতে ইসলাম পন্থীরা বদ্ধপরিকর। শুধু তাই নয় ক্ষমতার প্রতি মুরসি ও তার দলের লোভটা যে অনেকটাই নিরীহ তা এই প্রস্তাবের মধ্যে পরিষ্কার অংকিত হয়ে আছে। হয়তো ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন হলে মুরসিরা হেরে যাবেন কিন্তু মিশরিয় জাতি তাদেরকে ভুলবে না কোনদিন। এতদিন তাহরীর স্কয়ারের একক নায়ক ছিল না কেউ। জনগণই ছিল সে নায়ক। কিন্তু তথাকথিত গণতন্ত্র রক্ষায় মুরসি যে ঘোষণা দিলেন তার কারণেই তিনি জাতীয় বীরে পরিণত হয়ে গেলেন। আরব বিশ্বে রক্তের স্রোতে দাঁড়িয়েও যখন ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার নজির নেই সেখানে দু দিনের মাথায় ক্ষমতাসীন কোন প্রেসিডেন্টের একবছর মেয়াদ পূর্ণ না হতেই নতুন সরকার গঠনের আগাম প্রস্তাব সারা বিশ্বের জন্য এক অনন্য নজির হয়ে থাকবে। এদিকে সেনাবাহিনীর হুমকিকে প্রত্যাখ্যান করে তিনি সাহসেরও পরিচয় দিয়েছেন। আমাদের দেশের রাজনৈতিক সচেতন মহল ও রাজনীতি বিদদের মাথায় নুন্যতম ঘিলু থাকলেও বলতাম ইখওয়ানের কাছ থেকে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু।

লাস্ট আপডেট: ২

প্রেসিডেন্ট মুরসি সেনাবাহিনীর দেয়া আল্টিমেটাম প্রত্যাখ্যান করারা পর এখন সেনাবাহিনী সেদেশের সরকারি টিভির অফিসটি ঘিরে রেখেছে। এখন সেনাবাহিনী সেদেশের সরকারি টিভির অফিসটি ঘিরে রেখেছে। ধারণা করা হচ্ছে আর্মি ডেডলাইন পার হয়ে যাওয়ার পর পরই অফসয়ালি স্টেটমেন্ট দিয়ে তাদের অবস্থান জানাবে। তবে সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আহমাদ মুহাম্মাদ আলী জানিয়েছেন ঠিক কোন সময় এই স্টেটমেন্ট দেয়া হবে তা এখনও ঠিক হয় নি। এদিকে বিবিসি জানিয়েছে সেনাবাহিনী এখন সরকারি প্রতিনিধি ও বিরোধী দলের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করছেন।সেনাবাহিনী এখন সরকারি প্রতিনিধি ও বিরোধী দলের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করছেন।



কিছুক্ষন আগের তাহরীর স্কয়ার



মুরসির সমর্থকরাও পিছিয়ে নাই



তাহরীর স্কয়ারে নারীদের শ্লীলতা হানি যেমন করা হচ্ছে তেমনি নামাজও হচ্ছে। সেলুকাস



কাফনের কাপড় নিয়ে জীবন বাজি রেখে মুরসির পক্ষে থাকতে রাজি এরা।



আল আযহারের আলিমগন মুরসির সাথে একত্বতা ঘোষণা করছেন

আপডেট ৩

মিশরীয় সেনাবাহিনী সে দেশের সরকারি টেলিভিশন ভবনে প্রবেশ করেছে। অতি অল্প সময়েই তাদের ষ্টেটমেন্ট আসতে যাচ্ছে। সুত্র বিবিসি

আপডেট ৪

মুরসির সিনিয়র এসিস্টেন্ট Essam al-Hadded, বলেছেন মিলিটারি ক্যু হতে চলেছে

আপডেট ৫

মিশরে সামরিক ক্যু হতে চলেছে, মুসলিম ব্রাদারহুডের মুখপাত্র আল হাদ্দাদ তাঁর টুইটারের মাধ্যমে জানিয়েছেন পূর্ণ মাত্রার মিলিটারি ক্যু হতে চলেছে, সেনাবাহিনীর ট্যাংক গুলো রাস্তা দিয়ে চলাচল শুরু করেছে।

আপডেট ৬

সেনাবাহিনী রাস্তায় নেমে পড়েছে, বিভিন্ন সূত্র বলছে তারা মুরসির সমর্থকদেরকে সরিয়ে দিতে ফাঁকা গুলি করা শুরু করেছে।

রাস্তায় সেনাযান সাজানো







বিষয়: বিবিধ

৩৮৭৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File