বিয়ে: আকাঙ্ক্ষা থেকে অনীহা

লিখেছেন লিখেছেন অকপটশুভ্র ১৫ জুন, ২০১৩, ০৬:১৪:২০ সন্ধ্যা

আমার একটা অদ্ভুত পর্যবেক্ষণ। ছেলেদের কথাই বলছি, মেয়েদের সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নাই। সচেতন ছেলেরা একটা নির্দিষ্ট বয়সে বিয়ে করতে উঠে পড়ে লাগে। এদের মধ্যে যারা সময়মত বিয়ে করতে পারে না তারা সেই নির্দিষ্ট সময়টা পার হয়ে গেলে বিয়ের ব্যপারে অনাগ্রহী হয়ে উঠে, অনেকে ষ্টাবলিশড হওয়া, সবকিছু গুছিয়ে নেয়া এবং পর্যাপ্ত সেভিংস ম্যানেজ করার অজুহাত দিয়ে তাদের বিলম্বে বিয়ের ব্যপারটাকে আরও বিলম্ব করে। এর পেছনে সাইকোলজিক্যাল কারণটা কি হতে পারে তা নিয়ে আমার খুব আগ্রহ। তবে আমার ক্ষেত্রে যে জিনিসটা কাজ করছে সেটা হল, বাস্তবতা, কোরআন, হাদিস, যুক্তি তর্ক ইত্যাদি দিয়ে আমি আমার পিতামাতাকে বুঝাইতে ব্যর্থ হইসি। শুধু যে ব্যর্থ তা না, বরং তাদের চোখে আমি এখন ভিলেন। তারা ভাবছেন আমি একটা উন্মাদ! দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলে। যাই হোক, তথাকথিত বেয়াদবি যেন না হয় এবং উনাদের মনে যেন কষ্ট না লাগে সে জন্য আমি ধৈর্য ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। মোটামুটি সেই ধৈর্যের পিরিয়ড এখনও শেষ হয় নাই। আরও কতদিন চলবে তা আমার জানা নাই, জানার ইচ্ছাও নাই। এই মুহূর্তে আমি ২৯ বছর বয়সে পদার্পণ করে কয়েকটি মাসও অতিক্রম করে ফেলেছি। দিন দিন সিরিয়াসলি আমার বিয়ে করার ইচ্ছেটা ভয়ংকর ভাবে মরে যাচ্ছে। এর কারণ একটা সিম্পল ক্যালকুলেশন, ক্যালকুলেশনটা হল এই সমাজে যৌনতার যত্র তত্র ছড়াছড়ির মাঝে, যেখানে চাইলেই আপনি আপনার যৌনাকাংখ্যা বিভিন্ন ভাবে মিটাতে পারবেন, কেউ জানবে না, বুঝবে না। আকাম কুকাম করে যাবেন আর দৈনিক মসজিদে হাজিরা দিবেন। ব্যাস! আপনার মতো ভালো ছেলে দুনিয়ায় আর নাই। কিন্তু যখনি আপনি বিয়ের কথা বলবেন তখনই কেচ্ছা খতম। বেয়াদব, বেশরম বেহায়া ইত্যাদি উপাধির পাশাপাশি কুনজরে পড়ে যাবেন সবার। এরকম একটা সমাজে আমি আমার জীবনের প্রায় ত্রিশটি বছর কাটিয়ে দিয়েছি। এই ত্রিশ বছরের মধ্যে আমার চারিত্রিক ভাবে সবচেয়ে ঝুঁকি পূর্ণ সময়টুকুও অন্তর্ভুক্ত। আঠারো থেকে ত্রিশ বছর এর মধ্যে আমরা এমন একটা সময় পার করি যখন উঠতে-বসতে, হাঁটতে-চলতে, গাইতে-নাইতে প্রতিটি মুহূর্তে যৌন-উত্তেজক বিষয় বস্তুর মুখোমুখি হতে হয় আমাদেরকে। এবং এ সময়টাতেই আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাটা থাকে সবচেয়ে দুর্বল। জীবনের ঠিক এই ভয়ংকর সময়টাতে আমরা যারা চরিত্র সচেতন তাদের সামনে বিয়েটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। কিন্তু এই সময়ে একটা নিষিদ্ধ পল্লীতে গিয়ে হারাম কাজের মাধ্যমে সমুদয় তৃষ্ণা মিটিয়ে সমাজের চোখে খোকাবাবু সেজে থাকাটা যতটা সহজ, একটি হালাল কাজ (বিয়ে) করার ইচ্ছা ব্যাক্ত করে নিজের চরিত্রটাকে রক্ষা করে দ্বীনের পথে টিকে থাকা তার চেয়ে হাজার গুনে কঠিন। কারণ একটাই, এই বয়সে বিয়ের কথা বলা বা চিন্তা করা আলেম হোক জালেম হোক সব বাবা মা এর চোখেই চরম নিন্দনীয় কাজ। ব্যপারটা শুধু হাস্যকরই নয় বরং বড় বেশি আঁতলামী। যে সকল অভিভাবকরা নিজেরা সব কিছু বুঝেন বলে দাবী করেন তাদের পক্ষ থেকে এইরকম আচরণ কোন ভাবেই মানানসই নয়।

তো ২৯ বছর বয়সের প্রাথমিক পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আমি দেখছি যে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময়টা আমি ইতিমধ্যেই পেরিয়ে এসেছি, এবং সেই সময়টা কোন ভাবেই পাপ ও পঙ্কিলতা মুক্ত ছিল না। বরং এই ঝুঁকিপূর্ণ জীবনে যতটুকু পাপ হয়েছে তা আল্লাহ ক্ষমা না করলে জাহান্নামের আগুন থেকে আমার যে রেহাই হচ্ছে না সেটাতে কোন সন্দেহ নাই। এখন আমি যদি বাংলাদেশের গড় আয়ু ৬০ বছরও বেঁচে থাকি, তাহলে সেখান থেকে ত্রিশ বছর অলরেডি চলে গেছে। আর বাদ বাকী ত্রিশ বছর সময়ের মধ্য থেকে পঞ্চাশের পরের দশ বছর আমার চারিত্রিক পরিচ্ছন্নতার জন্য কোন হুমকিই নয়। বাকী থাকলো আর বিশ বছর। এই বিশ বছরে অন্তত আঠারো থেকে ত্রিশ পর্যন্ত সময়ের মতো চরম ঝুঁকিপূর্ণ সময়ের পুনরাবৃত্তি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। সুতরাং আমার চারিত্রিক পরিচ্ছন্নতার জন্য ঝুঁকি পূর্ণ সময় অলরেডি গত হয়ে গেছে। এখন বিয়ে-শাদীর প্রশ্ন উঠলে সেটা নিতান্তই বংশ বিস্তারের প্রয়োজনীয়তাকে কেন্দ্র করেই উঠবে, সেই সাথে সামাজিক প্রথাটাও আসতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হল একটি সুন্দর চরিত্রের চাইতে এগুলো আদৌ গুরুত্বপূর্ণ ছিল কি না?

আরেকটা ব্যপার হল, বিগত ২৯ বছরের স্বাধীন জীবন যাপন, অফুরন্ত সময়, রঙের এই দুনিয়া দেখা এবং সমুদয় অনাচারের বিরুদ্ধে একটি সুন্দর কল্যাণ সমৃদ্ধ সমাজ গড়ার তাবৎ স্বপ্ন কে কেন্দ্র করে, আমার মন ও মগজে যে পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গুলো অংকিত হয়ে আছে, সেগুলোর বাস্তবায়নে যে অফুরন্ত সময়ের প্রয়োজন হবে সেটুকু সময় আঞ্জাম দেয়ার ক্ষেত্রে বিয়ে করাটা কি আমার জন্য অযাচিত সময় নষ্ট করার নামান্তর নয়? যখন আমার হাতে অগণিত কাজ পড়ে আছে, তখন আমি কেন বিয়ে করে একটা নতুন ঝামেলা পাকিয়ে ফ্যামিলি বানিয়ে তার পেছনে সময় নষ্ট করবো? কারণ সমাজে আমার মতো শতভাগ যুবক জীবনের কোন না কোন সময়ে গিয়ে বিয়ে করবে, সংসার করবে এবং বংশ বিস্তার করবে কিন্তু একটি কল্যাণময় সমাজ গড়ার চিন্তা এদের মধ্যে হাতে গোনা দু একজনের মাথাতেই শুধু কাজ করবে। এই হাতে গোনা কয়েকজনও যদি ত্রিশের কোঠায় এসে বিয়ে করে পরিবারের পেছনে সময় দিয়েই সার হয়ে যায় তাহলে কল্যাণময় সমাজ গড়ার কাজে আঞ্জাম দিবে কে?

আমার বাবা কলেজ লাইফেই বিয়ে করেছেন, আমরা ছয় ভাই বোন। আব্বুর বয়স ষাটের খুব বেশি হবে না। তিনি এখনও বেশ সবল এবং কর্মক্ষম। এমন সময়েই আমাদের ভাই বোনদের তিনি আর দু এক বছরের মধ্যেই নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে দেখবেন। এর পর তিনি নিজের মত করে তার নিজস্ব আদর্শিক কাজে মনোযোগ দিতে পারবেন। আগে আগে বিয়ে করার জন্যে আল্লাহ আব্বুকে এই অসাধারণ নিয়ামত দান করেছেন। কিন্তু আমি চিন্তা করছি, আমি যদি ঠিক ৩০ বছর বয়সেও বিয়ে করি তাহলে আমার সবচেয়ে বড় সন্তানটিকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে আমাকে ষাট বছর পার করে দিতে হবে, তাহলে ২য়, ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম সন্তান গুলোর ভাগ্যে কি হবে? তাদেরকে অনিশ্চয়তার হাতে ছেড়ে দিয়ে আমাকে অক্ষম জীবনে প্রবেশ করতে হবে। এটা যখন আমি এই মুহূর্তে বসেই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি তখন আমি কোন দুঃখে বিয়ের পিড়িতে বসবো?

মোট কথা, যেই আমি বিগত চারটি বছর, যুবমাজের চারিত্রিক পরিশুদ্ধতাকে রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্যে অন্তত পঁচিশের আগেই বিয়ের করার বিভিন্ন যৌক্তিক দিক তুলে লেখালেখি করেছি, সেই আমিই কি না ত্রিশের দোর গোঁড়ায় এসে বিয়ের ব্যপারে সম্পূর্ণ আগ্রহ হীন হয়ে পড়েছি। এবং এর সপক্ষে আমি হাজারটা যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখতে পাচ্ছি। এই র‍্যাডিক্যাল চেঞ্জটা আমি অনেকের মাঝেই দেখেছি। তাদের মাঝে আমার বলা কারণ গুলো না থাকলেও অন্য অনেক কারণ আছে। সেগুলো জানা দরকার। তাছাড়া আমার বলা কারণ গুলো কেউ রিয়ালাইজ করুক বা না করুক, ম্যাক্রো লেভেলে কত মানুষ এই কারণ গুলোর শিকারে পরিণত হবে তার কোন হিসেব নেই। সুতরাং বিষয়টা যা দাঁড়ালো সেটা হল, সময় থাকতে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি না নিলে ভুক্তভুগী মুরুব্বীরা হবেন না, বরং আমরাই হবো। কারণ মুরুব্বীরা সত্তুর কিংবা ষাটের দশকের জেনারেশন। তারা তখনকার ধ্যান ধারণা দিয়েই একবিংশ শতাব্দীর দুনিয়াকে বিচার করেন। দুনিয়া কিভাবে ঘুরে, কিভাবে কি হয়, তা উনারা জানেন না। এখনকার যুবকরা কি সিচুয়েশনগুলো অতিক্রম করে তার ব্যপারে তাদের কোন ধারণাই নাই। তাদের কাছে বাস্তবতা হল আয়-রোজগার, সহায় সম্পত্তি, ওয়ালিমার খানা খাদ্যের খরচ-পাতি আর মোহরানার টাকা। আমাদের জন্যে সেখানে বাস্তবতাটা একেবারেই ভিন্ন, একটা গার্ল ফ্রেন্ড জোগাড় করতে আমাদের আয়-রোজগার, সহায় সম্পত্তি, ওয়ালিমার খানা খাদ্যের খরচ-পাতি আর মহরানার টাকার দরকার হয় না। সুতরাং আমাদের যুবকরা থেমে নেই, উনারা লিগ্যালি বিয়ে করতে না দিলে আমাদের যুবকরা ইল্লিগালি প্রেম করে বেড়াবে, নিষিদ্ধ পল্লীতে যাবে, পর্ণ দেখবে, আরও যা যা আছে তা তা করবে। মুরুব্বিরা কোনও ধারনাই রাখেন না, যে কতভাবে এই যৌন আসক্তিকে চরিতার্থ করার সহজ পথ ও পদ্ধতি যুবকদের হাতের কাছে পড়ে থাকে। কেউ জানবে না, বুঝবে না কিন্তু ইমান আকীদা ও চরিত্র খুইয়ে অথর্ব হয়ে যাবে গোটা যুব সমাজ। এটাই হল আমাদের বাস্তবতা, যা মুরুব্বিদের বাস্তবতার চেয়ে একেবারে ভিন্ন কিন্তু বড় বেশি ভয়ংকর। তাই সিদ্ধান্তটা আসতে হবে যুব সমাজের মাঝ থেকেই, যারা নৈতিকতা ভিত্তিক সমাজ গড়তে চায়, তাদের মধ্য থেকে। বিয়ে করুন সঠিক সময়ে, ছেলেদের ওয়ালীর দরকার হয় না, সুতরাং আপনাদের কোন বাধা নেই। মুরুব্বীদের দিকে চেয়ে থাকলে অন্য দশটা ছেলের মতো জন্ম নিয়ে শিক্ষিত হয়ে চাকরি করে দু একটা সন্তান জন্ম দিয়ে মরে যাবেন কিন্তু সমাজের কোন পরিবর্তনই আপনারা করতে পারবেন না। সমাজে ছড়িয়ে পড়া নোংরামী, বেহায়াপনা, ব্যাভিচার চলতে থাকবে হরদম। এগুলোর ক্ষতিকর দিক আপনি আমি ততোদিন হৃদয়ঙ্গম করতে পারবো না যদি না কোন দিন আপনার বা আমারই নিজের কোন ভাই বা বোন ধ্বংশের অতলে হারিয়ে যায়। সুতরাং সে দায় আপনিও এড়াতে পারছেন না কারণ আপনি কোন কার্যকর পদক্ষেপই নেন নি।

আমি আমার লজ্জার মাথা খেয়ে এগুলো বলছি তার কারণ হল লজ্জায় মুখ বুজে থাকলে কি এমন সুখ বা লাভ হবে তা আমি এখনও বুঝে উঠতে পারিনি।

বিষয়: বিবিধ

৪৪৩৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File