আমার ঘরের বাহির (হোস্টেল লাইফ) - ২

লিখেছেন লিখেছেন অকপটশুভ্র ৩১ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৪:৩৮:১৪ বিকাল



ছবি: মাদ্রাসার ঢাকা ক্যাম্পাস

প্রথম হোস্টেলে এলাম, মা-বাবা, ভাই-বোন ও পাড়ার বন্ধুদের ছেড়ে এলাম। বাসা থেকে যখন তখন বেরুতে পারতাম না, আম্মুকে কোথায় যাচ্ছি, কখন ফিরবো সব বৃত্তান্ত জানিয়ে তবেই বেরুতে হতো। আমার স্বাধীন চেতা মন এই বারণ কিছুতেই মানতে রাজি ছিল না। তার চেয়ে বড় ব্যপার হল, ঘর থেকে বেরিয়ে ঠিক কোথায় যাবো তা তো আমি নিজেও জানতাম না। তাই কোথায় যাচ্ছি, কখন ফিরবো এসব বৃত্তান্ত মা কে জানিয়ে বের হওয়াটা পরীক্ষার হলের মোস্ট আনকমন প্রশ্নের উত্তরের চাইতেও কঠিন। তাই মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যেতাম। কিন্তু এভাবে আর কতদিন! একদিন না পেরে উঠে আমি বলেই ফেলেছিলাম “আমি বড় হয়ে বস্তিতে থাকবো, যেখানে ঘরের কোন দরজা থাকবে না, আমার বাচ্চারা যখন ইচ্ছা বেরিয়ে যাবে”। আত্মীয় স্বজন এখনও আমার ছোট্ট সময়ের বলা এই কথাটি নিয়ে বেশ হাস্যরস করে থাকেন। এমনিতেই খুনসুটি আর দুষ্টুমি আমার রক্তজাত। আমি কোন হাসির কাণ্ড ঘটালে সেটা ঢাকা থেকে সুদূর গ্রামের আত্মীয় স্বজনদের কাছে পৌছুতে সময় লাগতো না। বছরান্তে ছুটিতে গ্রামে গেলে সবাই খালি ঐ কাণ্ডগুলো নিয়ে আমার যুক্তি শুনতে চান, আমিও রসিয়ে রসিয়ে যুক্তি দেই, অভিনয় করে দেখাই আর তাঁরা এসব দেখে হেসেই লুটোপুটি। আমার সেই ব্যক্ষা ও অভিনয় থেকে তৈরি হতো আরও কত হাসির উপলক্ষ।

যাইহোক, আমাদের বাসার পাশেই ছিল বস্তিঘরের সারি, আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতাম বস্তিতে বসবাসকারী আমার সমবয়সী ছেলে মেয়েরা যখন তখন বেরোচ্ছে আবার ফিরে আসছে। তাদের এই অবাধ স্বাধীনতা দেখে আমার বেশ লোভ হতো। হোস্টেলে এই সুযোগটা বেশ আছে, অন্তত আড্ডায় মজে গেলে সময়ের আর বালাই থাকে না। বন্ধু-বান্ধবদের সাথেই ওঠা-বসা চব্বিশ ঘণ্টা। আম্মুর বকাবকি আর বিরামহীন নজরদারী নেই, চার দেয়ালে বন্দী হয়ে “কখন বাইরে যাবো” এই চিন্তায় হয়রান হওয়ার কিছু নেই। এমন স্বাধীনতার হাতছানি কল্পনা করে হোস্টেলে আসার উত্তেজনাটা আর লাগাম মানছিল না। ক্লাসে মন বসছিল না খুব একটা, মনে হচ্ছিলো আজ বুঝি চূড়ান্ত স্বাধীন হলাম।

ক্লাস ছুটি হলো, নামাজ পড়ে দুপুরের খাবার খেতে ঢুকলাম মিল্লাতের ডাইনিং হলে। টিনের চৌচালা বিরাট একটা হলঘর (এখন সেটা চার তলা বিরাট বিল্ডিং হয়ে গেছে), একপাশে বিশাল কিচেন, অন্যপাশে ইয়া বড় বড় খাবার টেবিল। একেকটা টেবিলে দশজন করে খেতে পারে। পুরো ডাইনিং হলে দশ-পনেরটা টেবিল। প্রতিটি টেবিলে বড় বড় দুটি করে সিলভারের তৈরি পাত্র। একটিতে ভাত আর অন্যটিতে ডাল। কিচেন লাগোয়া একটি বড় কাউন্টার, সেখানে সারি সারি করে তরকারির বাটি সাজানো। যার যেটা পছন্দ নিচ্ছে, আর একটা পছন্দসই টেবিলে বসে খেয়ে নিচ্ছে। আমি প্রথম খেতে এলাম, এক বাটি তরকারি নিয়ে একটি টেবিলে বসলাম। তরকারির যে বাটি তার একটা বর্ণনা না দিলেই নয়। ছোট একটি বাটি, তাতে কয়েক পিস আলু, টমেটো কদাচিৎ মিলে কিন্তু সাথে পেঁপে রয়েছে বেশ ভাল সংখ্যক। এতকিছুর মাঝে মাত্র এক টুকরো গরুর গোশত বেশ হতাশার ব্যঞ্জনা বাজিয়ে দিয়ে যায়। হোস্টেলে এসে এই তরকারির দিকে তাকিয়েই হয়তো প্রথম দীর্ঘশ্বাসটি ফেললাম। এমনি মুহূর্ত যদি বাসায় হতো, বিশ্বাস করুন দীর্ঘশ্বাসটির তিলমাত্র আভা জন্ম নেবার আগেই মা নিজের প্লেট থেকে গোশতের টুকরোটি পাতে তুলে দিতেন। খেতে শুরু করলাম, বাঙ্গালির আবার দুপুরে পেটফুলায়ে না খেলে গায়েই মানে না যে কিছু খাওয়া হয়েছে। সাত-সকালেই যে জাতির প্লেট পুরে ভাত খেয়ে শুরু তার দুপুরে গামলা খানেক ভাত খাওয়া চাই ই চাই। কিন্তু অতিস্বল্প পরিমানের তরকারি দিয়ে কি করেইবা পেটফুলায়ে খাই!

আমরা বেশ মজা করেই বলতাম, প্রথম প্লেট ভাত গোশতের টুকরাটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই সাবাড় করে দিতে হবে, অর্থাৎ আলু আর ঝোলের কারিশমা দিয়েই প্রথম প্লেট ভাত চালান করে দিতে হবে। পরের প্লেট ভাত খেতে গিয়ে চিমটি চিমটি করে গোশতের টুকরাটা দিয়ে পুরো প্লেট ভাত শেষ করতে হবে। এতে মজার একটা ব্যপার ঘটে, গোশতটা সামনে রেখে খেতে থাকলে মনে হয় “আসলটাই তো রয়ে গেলো”, সুতরাং খাওয়া শেষ হয় নাই। এই চিন্তাটা পরবর্তী প্লেট ভাত খেতে বেশ মোটিভেশন যোগায়। কিন্তু এক্ষেত্রে সবাই ব্যালেন্স করতে পারে না, আমি নতুন ছিলাম তাই পারিনি। কোনদিন প্লেটে ভাত রয়ে যেতো কিন্তু তরকারি শেষ হয়ে যেতো, আবার কোনও দিন তরকারি রয়ে যেতো ভাত আর বাকি থাকতো না। কিন্তু এভাবে খেতে খেতে একসময় চমৎকার ব্যালেন্স আয়ত্ত করে ফেললাম একসময়।

কম তরকারি দিয়ে বেশী ভাত খাওয়া রপ্ত করেছি এই হোস্টেলে থেকেই। এখনও আমার ভাত শেষ হয়ে যায় কিন্তু তরকারি শেষ হয় না। প্রায়শই আন্দাজ করে যতটুকু তরকারি নেই তার সবটুকু শেষ করতে পারি না। অন্যরা ভাত নষ্ট করে আমি নষ্ট করি তরকারি। এমতবস্থা থেকে উত্তরণের আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। আর যাই হোক, খাবার নষ্ট করা বড় খারাপ কাজ। এবার আসি ডালের কথায়, আমার মায়ের হাতের ডালের আলাদা একটা সুনাম আছে, আত্মীয়-স্বজন বাসায় এলে গোশত-পোলাও রেখে আগে ডাল-ভাত খায় আমাদের বাসায়। কেউ কেউ বাটি ধরে পুরো ডালটুকু সাবাড় করে দেয়। একে বলতে পারেন আমাদের ফ্যামিলির সমৃদ্ধ ডালৈতিহ্য। এই সমৃদ্ধ ডালৈতিহ্য সম্পন্ন পরিবারের আমি হোস্টেলের ডাল চিনতে ভুল করে ফেললাম। ইয়া বড় এক পাত্রে ঘোলা পানিতে টইটুম্বুর অবস্থা, উপরে পোড়া পোড়া করে ভাজা কিছু পেঁয়াজ ও রসুন ভাসছে আর তলানিতে জমে আছে সমুদয় মরিচ ও অন্যান্য সবকিছু। একনজরে যাকে হাত-ধোয়া এঁটে পানির মতই মনে হবে। আমিও তাই মনে করলাম, ভাবলাম হাত ধুয়ে বুঝি লোকে এখানে প্লেটের পানি ফেলে। তাই হাত ধুয়ে এঁটে পানিগুলো ঐ ডালের মধ্যেই দিলাম ঢেলে। পাশ থেকে কয়েকজন বলে উঠলো “হেই হেই হেই করছো কি!”। ওরাও মনে হয় বুঝতে পারলো, একজন জিজ্ঞেস করলো “ভাই তুমি কি নতুন এলে হোস্টেলে?” আমি বললাম “হম! নতুন এসেছি, আজকেই প্রথম”। তার পর ওরা বলল “এইটা হল ডাল, হাত ধোয়া পানি না”

হোস্টেলে যারা থাকে তাদের প্রত্যেকের জন্য একটি করে কার্ড সরবরাহ করা হয়, হোস্টেল ফী ও খাবার টাকা জমা দিলে এই কার্ড টি ছাত্রদেরকে দেয়া হয়। একেক মাসে এই কার্ডের রং হয় একেক রকম। ডাইনিং এর দরজার সামনে একজন দাঁড়িয়ে থাকে, সে যাদের যাদের হাতে এই কার্ড আছে তাদেরকেই শুধু ডাইনিংয়ে ঢুকতে দেয়। কার্ড টি দেখতে প্রাইমারি স্কুলের পরীক্ষার প্রবেশপথের মতো। এই কার্ড নিয়ে রয়েছে অনেক অনেক বিড়ম্বনা, পরের পর্বগুলোতে সেকথা বলবো। আজ এই কার্ডের ইমপ্লিকেশন নিয়ে বলি, যাদের হাতে কার্ড আছে তাদের স্ট্যাটাস হল, এরা হোস্টেল ফী পরিশোধ করেছে এবং এদের নামে কোন এলিগেশন নেই। কিন্তু যাদের হাতে কার্ড নেই তাদের স্ট্যাটাস হল, হয় এরা হোস্টেল ফী পরিশোধ করেনি নয়তো কোন কারণে তাদের কার্ড সিজ করা হয়েছে। অর্থাৎ তাদের খাওয়া বন্ধ। বেশী বেশী নামাজ কাজা করলে, শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে, কিংবা যে কোন অনৈতিক কাজে ধরা খেলে ছাত্রদের কার্ড সিজ করা হয়। আবার যে সকল ছাত্র সপ্তাহান্তে বাসায় বা বাড়ি যায় তারা যদি এই কার্ড অফিসে জমা দিয়ে যায় তাহলে সে যে কয়দিন হোস্টেলে খায়নি সে কয়দিনের টাকা তাকে ফেরত দেয়া হয় বা অন্য মাসের ব্যালেন্সের সাথে যোগ করা হয়।

এভাবে কেটে গেলো হোস্টেলের প্রথম দিবালোক। দুপুরে খেয়ে দেয়ে মিলিত হলাম সমবয়সী হোস্টেলের ছাত্রদের সাথে। গল্পগুজবে কেটে গেলো দিন, বিকেলে মাঠে ক্রিকেট বা ফুটবল খেলা জমতো। মাগরিবের আজান হতেই পুরো মাঠ হয়ে যেতো ফাঁকা।

হোস্টেলে যেহেতু আমরা দুই ভাই থাকি এবং আমি বয়সে বেশ ছোট সেহেতু আমাকে ভাইয়ার সাথেই ডবলিং করে থাকতে হল। মনে রাখা উচিৎ বাসা-বাড়ির সিঙ্গেল খাটটাই হোস্টেলের জন্য ডাবল’স খাট। বাসায় ডাবল খাতে শুতে গিয়েই ভাইয়ার সাথে ঝগড়া লেগে যেতো। এখনো বলতে গেলে সিঙ্গেল খাটে দুজন! সেই মশারি টাঙ্গানো, বিছানা গুছানো ইত্যাদি নিয়ে আবার টেনশন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। এবার হোস্টেলের রুম গুলোর কথা বলি। হোস্টেলের রুম গুলো বিভিন্ন রকমের। কোন কোন রুমে ন’জন, ছয়জন ও পাঁচ জন করে থাকতো। রুম যত বড় সিট তত বেশী। একটা শোয়ার খাট, একটা টেবিল ও একটা বুকশেলফ রাখা যায় এমন যায়গা বরাদ্ধ থাকে প্রতি ছাত্রের জন্য। সবার আলাদা আলাদা চৌকি, টেবিল-চেয়ার ও বুকশেলফ থাকতো। অর্থাৎ থাকার দিক দিয়ে আমাদের হোস্টেল একটি ভার্সিটি হলের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। বিভিন্ন ভার্সিটিতে তো শুনি এক সিটে দুই জন শেয়ার করে থাকতে হয়, কিন্তু এখানে দুজন সহোদর ভাই ছাড়া ডাবলিং করা হয় না। তাও আবার যদি সহোদরদের কোন একজন বয়সে বেশী ছোট হয় তাহলেই ডাবলিং করা যায়।

চলবে...

বিষয়: বিবিধ

১৫১৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File