আমার ঘরের বাহির (হোস্টেল লাইফ) - ১
লিখেছেন লিখেছেন অকপটশুভ্র ২৬ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৮:৫৭:৫৭ রাত
আমার হোস্টেল লাইফ নিয়ে লিখবো বলে কতবার যে এম এস ওয়ার্ডের পাতা খুলে দু চার লাইন লিখে আবার কেটে দিয়েছি তার শেষ নেই। এই হোস্টেল লাইফে কত রংবেরংয়ের সৃতি জড়িত হয়ে আছে তা বলে বা লিখে শেষ করা অসম্ভব। এমনিতেই জীবনের এমন কিছু মুহূর্ত থাকে যা লিখে পাঠককে বুঝানো কষ্টকর। তার উপর হোস্টেল লাইফটা এতটাই বিস্তৃত যে কিছু কথা বললে আরও কিছু কথা বাদ থেকেই যায়। সবসময় সব কথা মনে পড়ে না, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন কথা মনে আসে কিন্তু একসাথে সব কথা সিরিয়ালি মনে থাকে না। সেজন্য কিছু কথা লেখার পর কতকথা লেখা হলনা ভেবে যা লেখা হয় তাও কেটে দেই। আজও আমি শিওর না যে কিছু পথ গিয়ে আবার থেমে যাবো কি না। তবে আজকে লেখাটা শুরু করে দেয়ার ইচ্ছাটা অন্যদিন গুলোর চাইতে একটু বেশিই দৃঢ় মনে হচ্ছে।
হোস্টেল লাইফের শুরুটা লিখতে হলে এর পটভূমিতে একটু বিচরণ করে আসা অত্যন্ত জরুরী। একদিন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে ঢাকায়, আমরা তখন ঢাকার খিলগাঁওয়ের একটি বাসায় থাকি। সন্ধ্যার পর আমি টেবিলে বসে পড়ছি, আমার ছোট চাচা সামনে বসে আছেন, তিনি আমায় যতটা না পড়াচ্ছেন তার চেয়ে বেশী আমি পড়ছি কি না তা পাহারা দিচ্ছেন। সেই সাথে বড় ভাইয়াও আছেন। আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি, আর ভাইয়া পড়েন ক্লাস সিক্সে। চাচা দুজনকেই পাহারা দিচ্ছেন। এমন সময় বাসায় একজন লোক এলো, সাদা পাঞ্জাবী, মাথায় টুপি এবং চিবুকে পরিপাটি করে রাখা দাড়ি। আমাকে পড়ার টেবিলে দেখে একটা পটেটো চিপসের প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। চিপস আমি তখনও পছন্দ করতাম এখনও করি।
লোকটি চাচার সাথে কথা বলছিলেন, সদাহাস্যজ্জল ও চমৎকার উচ্চারণে কথা বলে যাচ্ছিলেন তিনি। বিনয়, ভদ্রতা ও গুছিয়ে কথা বলার মতো অনন্য কিছু গুণাবলীর সমাবেশ তাঁর মাঝে। সবমিলে তিনি চমৎকার একজন মানুষ। চাচার সাথে তাঁর কথোপকথন শুনে বুঝতে পারলাম তিনি মূলত আমাদের মসজিদে অনুষ্ঠিতব্য একটি শব্বেদারিতে দারসুল কুরআনের আলোচক হিসেবে আমাদের এলাকায় এসেছেন। তুমুল বৃষ্টির কারণে আমাদের বাসায় এসেছেন। আব্বুকে তিনি আগে থেকেই চিনেন। লোকটির নাম হাবিবুল্লাহ মুহাম্মদ ইকবাল, তিনি দেশের প্রথম ক্যাডেট মাদরাসা “তানযীমুল উম্মাহ ক্যাডেট মাদরাসার” প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। অবশ্য তখন তিনি একজন সাধারণ ছাত্র ছিলেন মাত্র। কথায় আছে “মর্নিং শোজ দ্যা ডে” এই তিনিই একদিন তানযীমুল উম্মাহ ক্যাডেট মাদরাসার মতো একটি সফল প্রজেক্টের উদ্যোক্তা হবেন তা আমি তখন বুঝতে পারিনি অনেক ছোট ছিলাম বলে। কিন্তু বড়রা কিন্তু আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন।
যাহোক সেদিন তিনি চলে যাওয়ার আগে আমাকে দাওয়াত দিয়ে গেলেন, বললেন তোমাকে তা’মিরুল মিল্লাত মাদ্রাসায় দাওয়াত। সে দিন থেকে আমার মধ্যে তা’মিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার একটা আকাঙ্ক্ষা শিকড় গেড়ে বসে গেলো। এর পর থেকে প্রসঙ্গ এলেই আমি আব্বুকে আমার ইচ্ছার কথাটা জানিয়ে দিতাম। আব্বু বলতেন ওখানে ভর্তি হতে হলে ভালো রেজাল্ট করতে হয়, ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে টিকতে হয়, তাই ভালো করে পড়াশোনা করো। আব্বু প্রায়শই মিল্লাতে যেতেন, কখনও দারস দিতে আবার কখনও কোন গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে। আর ওখানে গেলেই ইকবাল ভাইয়ের সাথে তাঁর দেখা হতো। দেখা হলেই ইকবাল ভাই আমার উদ্দেশ্যে একটি চিরকুট পাঠাতেন।
তিনি চিরকুট গুলো লিখতেন একটু ভিন্ন স্টাইলে, অসাধারণ সুন্দর হস্তাক্ষরে কিছু আলপনা এঁকে এঁকে লিখতেন। এক লাইনে দু-চারটা শব্দ লিখে পরের লাইনে গিয়ে শুরু করতেন ঠিক উপরের লাইন যেখান থেকে শুরু করেছিলেন তার চেয়ে আরেকটু ডান দিকে সরে এসে। এভাবে লিখার পরে সব গুলো লাইন মিলে একটা সিঁড়ির মতো সৃষ্টি হতো। সবগুলি চিঠিতেই সুন্দর সুন্দর কথা লিখা থাকতো এবং তা’মিরুল মিল্লাতে যাওয়ার আমন্ত্রণ থাকতো। প্রতিটি চিরকুট পেয়ে আমার মাঝে তা’মিরুল মিল্লাতে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছাটা শতগুণ বেড়ে যেতো। কিন্তু সে অনুপাতে পড়ালেখার গতি বাড়ত না একটুও।
আব্বু একজন মানুষ যাকে অকারণ আবেগ কিছুতেই ছুঁতে পারে না। তাই সময় যখন এলো তখন তিনি ভাইয়াকেই মিল্লাতে ভর্তি করালেন আমাকে করালেন না। তখন আমি ফাইভে পড়ি, ভাইয়া পড়েন এইটে। বাসা থেকে মাদ্রাসা বেশি দূরে না হলেও সায়দাবাদের ব্যস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ সড়কটির কারণে আব্বু ভাইয়াকে বাসা থেকে যাতায়াত করে পড়ালেখা করতে দিলেন না। তাই অবধারিতভাবেই তাঁকে হোস্টেলে গিয়ে উঠতে হল। বাসায় আমরা দুই ভাই একই রুমে থাকতাম, একই খাটে ঘুমতাম। ভাইয়া হোস্টেলে চলে যাবে শুনে বেশ খুশি হলাম। প্রতিদিন রাতে মশারি খাটাতে গিয়ে যে সংঘর্ষ ও ঝগড়া বিবাদ হতো সেটা আর হবে না। মাঝ রাতে ঘুম থেকে জাগিয়ে কেউ বলবে না “বেয়াদপ! ঠ্যাং সরা গায়ের উপর থেকে!” সকালে উঠেও বিছানা পাতি গোছানো নিয়ে বাধবে না কোন দ্বন্দ্ব। হঠাৎ করেই মাথার নিচ থেকে বালিশ টান দিয়ে বলবে না কেউ “আমার বালিশ নিয়েছিস ক্যান দে বালিশ!” এভাবে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবার আশায় আমি আনন্দে গদগদ হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম কোনদিন বাছাধন বাসাটা ছেড়ে হোস্টেলে যান সে দিনের জন্য। এদিকে এক রুমে আমার একাকী রাজত্বের কথাতো না বললেই নয়।
স্পষ্ট মনে পড়ছে, ভাইয়ার জন্য নতুন তোষক, লেপ, বালিশ, বিছানা চাদর ও ট্রাংক আনা হল। ব্যাগ ও ট্রাংক ভরে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র দিলেন আম্মু। একদিন সকালে ভাইয়াকে নিয়ে আব্বু হোস্টেলে দিয়ে আসলেন। এদিকে দিন গড়িয়ে রাত যতই এগিয়ে আসতে লাগলো আমার আকাশচুম্বী খুশির পাহাড় ক্রমশই ধ্বসে জমিনে মিশে যেতে লাগলো। সন্ধ্যা হতেই বুক ধুক ধুক বাড়তে লাগলো। ভেবে মরতে লাগলাম, সহস্র সমস্যার সমাধান যা দিয়ে হল তা এমন এক সমস্যা এনে দিয়ে গেলো যে একাই হাজারটা সমস্যার চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিলো। টেনশন একটাই, রাতে একা একা ঘুমবো কি করে! জীন-ভুত যদি এসে ঘাড় মটকে দেয়!! অবশ্য জীন-ভুতের চাইতে মার আজরাইলের ডরটা একটু বেশী। জীন-ভুত তো দোয়া কালাম পড়লেই দৌড়ে পালায় কিন্তু আজরাইল ব্যাটাতো দোয়া-কালামের ধার ধারে না। তাই মরার সময় কাউকে পাশে পাওয়াটা অকার্যকর ভরসা হলেও মানসিক স্বস্থির জন্য বেশ সহায়ক। শেষ পর্যন্ত আম্মু এসে পাশে ঘুমলেন কিছু দিন, এর পর আমি ঘুমিয়ে গেলে আম্মু চলে যেতেন। এভাবেই একদিন একাকী থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।
সপ্তাহান্তে ভাইয়া বাসায় আসতেন, আম্মুও বড় ছেলেকে বেশ আদর-যত্ন করতেন। এ দৃশ্য দেখে আমার নিজেরও হোস্টেলে গিয়ে থাকার আগ্রহ বেড়ে গেলো। এই আগ্রহ যে কিছুটা ঈর্ষা থেকেও সৃষ্টি হয়নি তা বলবো না। সব মিলে মিল্লাতে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছাটা আরেকটু জেঁকে বসলো। এর পরের বছর যখন ফাইভ পাশ করে সিক্সে উঠলাম তখন তামিরুল মিল্লাতে ক্লাস ফাইভের জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে টিকে গেলাম। আমি অবশ্য এক বছর ডিমোশনের ব্যপারে বেশ নাখোশ ছিলাম কিন্তু তামিরুল মিল্লাতে ভর্তি হওয়ার উত্তেজনয় সেটা খুব একটা প্রাধান্য পেলো না। এভাবেই ১৯৯৭ সালের কোন এক সকালে তামিরুল মিল্লাতের আঙ্গিনায় একজন বালক ছাত্র হিসেবে পা রাখলাম। সেই সাথে শুরু হল আমার হোস্টেল জীবনের শুরু। ছাড়া হলাম ঘর, মায়ের আচল। সেই জীবনের কতো উত্থান কতো পতন, কতো গৌরব কতো হাহুতাশ, কতো আনন্দ কতো বেদনা, কতো উচ্ছ্বাস কতো দীর্ঘ-শ্বাস সে সব কিছু তোলা রইলো আগামী পর্বগুলোর জন্য।
চলবে...
বিষয়: বিবিধ
২৬৪২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন